শেখ হাসিনা এখন কবরস্থানের প্রধানমন্ত্রী

মাসকাওয়াথ আহসান:

শেখ হাসিনার রাজনীতি কেবল তার ব্যক্তিজীবন ঘিরে। এই ব্যক্তিজীবনে তার একটি খেলনা রয়েছে; এই খেলনাটির নাম টাইম মেশিন। এই টাইম মেশিনটিতে উনি ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল, ১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল আর ২০০১-২০০৬ পর্যন্ত ঘটা মানবতাবিরোধী অপরাধ দেখতে পান। আর ১৯৭১ থেকে ১৯৭৫, ১৯৯৬ থেকে ২০০১ আর ২০০৯ থেকে ২০২৪ সময়কালটিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিশুদ্ধকাল বলে বিশ্বাস করেন।

আওয়ামী লীগের শাসনকালগুলোকে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্বর্গীয় সুখের সময় বলে বর্ণনা করেছিলেন। বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আওয়ামী লীগের শাসনকালকে বাংলাদেশের সিঙ্গাপুর কিংবা সুইটজারল্যান্ড বলে বর্ণনা করেন।
২০০১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে নৈর্ব্যক্তিক ও সুশিক্ষিত কিছু প্রবীণ আওয়ামী লীগের সমর্থক ছিলেন। যারা শেখ হাসিনার ভুলগুলো ধরিয়ে দেবার সাহস রাখতেন। কিন্তু ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় এলো তখন বিচারপতি মানিকের মতো সাংস্কৃতিক মানের লোকেরা আওয়ামী লীগের সমর্থক বুদ্ধিজীবী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলো। আপনি যদি অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে মানিক দিয়ে রিপ্লেস করেন তখন আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক সংস্কৃতি একটি কট্টর আওয়ামী ধর্মে পরিণত হয়।

এই কট্টর আওয়ামী ধর্ম হেফাজতের কট্টর ইসলামের মতোই ভয়ংকর। আপনাদের মনে আছে হেফাজতের মোল্লা শফি ফতোয়া দিয়েছিলেন, নাস্তিক কতল করা ওয়াজিব। সম্প্রতি আওয়ামী ধর্মের সাংবাদিক প্রভাষ আমিন ও ফারজানা রূপা, প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্ন নয় প্রশংসা করতে এসেছির আসরে কোটা সংস্কারবিষয়ক উস্কানি উপস্থিত করলে শেখ হাসিনা তার একান্ত টাইম মেশিনে বসে বললেন, চাকরির কোটা মুক্তিযোদ্ধার নাতিপুতি পাবে না তো রাজাকারের নাতিপুতি পাবে।

কোটা সংস্কার আন্দোলনের ছাত্রছাত্রীরা এতে গভীরভাবে অপমানিত হয়। ১৯৭১ সালে নগন্য সংখ্যক রাজাকার ছিলো। দেশের সাতকোটি মানুষের রক্ত-ঘাম-ত্যাগে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিলো। অথচ শেখ হাসিনা “কেবলমাত্র তার সঙ্গে সহমতভাই ও বোন ছাড়া”; দেশের বাকি সবমানুষকে রাজাকার তকমা দিলেন। একবিংশ শতকের জেনজি প্রজন্ম গভীর অভিমানে বিক্ষুব্ধ হয়ে বললো, “তুমি কে আমি কে রাজাকার, কে বলেছে কে বলেছে স্বৈরাচার!”
সেখান থেকে কেবল আক্ষরিক অর্থে রাজাকার শব্দটি তুলে নিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ফতোয়া দিলেন, যারা নিজেদের রাজাকার দাবি করেছে; এই উদ্ধত আন্দোলনকারী যোগ্য জবাব দেয়া হবে।

শেখ হাসিনা বললেন, নিজেদের রাজাকার বলতে লজ্জাও করলো না! বুদ্ধিজীবী জাফর ইকবাল তো “রাজাকার” শব্দটিকে তুলে নিয়ে ফতোয়া দিলেন, তিনি ঐ “রাজাকার” ভর্তি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবেন না বলে সাদাসিধে বয়ান দিলেন। ডা দীপুমণি কোটাসংস্কার আন্দোলনকারী ছাত্র-ছাত্রীদের শ্লোগান থেকে “রাজাকার” শব্দটি তুলে নিয়ে বললেন, এরা যেন বাংলাদেশের পতাকা হাতে না নেয়। পুলিশ এরপর থেকে কারো হাতে বা পকেটে বাংলাদেশের পতাকা আছে কিনা তা খুঁজতে থাকে।
কিন্তু গোটা বাংলাদেশের মানুষ ঐ শ্লোগানে, স্বৈরাচার শব্দটি শুনে ফেলেছে। যে স্বৈরাচার বৃটিশ ও পাকিস্তান আমলের নিষ্ঠুর জমিদারদের মতো চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের লুণ্ঠন ও নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে গত ১৫ বছর ধরে।

সেই যে কট্টর ইসলামন্থীরা নারায়ের তাকবির বলে যেমন লেখক ও ব্লগার হত্যা করেছিলো; একইভাবে কট্টর আওয়ামীপন্থীরা “জয় বাংলা” শ্লোগান দিয়ে হেলমেট পরে কিশোর-তরুণ হত্যা করে চলেছে। হাসিনার সাবেক আইজিপি বেনজির মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে “জয় বাংলা” শ্লোগান দিয়ে সহস্র-মানুষের ক্রসফায়ার করেছে। পাকিস্তানের খুনে সেনারা যেমন “পাকিস্তান জিন্দাবাদ” শ্লোগান দিয়ে গণহত্যা করেছিলো, শেখ হাসিনার খুনে পুলিশ, RAB, বিজিবি, ছাত্রলীগ-যুবলীগ “জয় বাংলা” শ্লোগান দিয়ে ছাত্রগণহত্যা করে চলেছে।

আমরা বাংলাদেশের মানুষ ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি খুনে সেনাদের গণহত্যায় স্বজন হারিয়ে “মানবতাবিরোধী অপরাধী”-দের বিচার চেয়েছিলাম। যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা-ধর্ষণ-লুন্ঠন করেছিলো; তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হলে, বাংলাদেশে আর কেউ মানবতাবিরোধী অপরাধ করতে সাহস পাবে না। দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। এরকম আশা আমাদের মনে ছিলো।

আওয়ামী লীগ সরকার ঐ ৭১-এর মানবতাবিরোধী অপরাধীদের শাস্তি দিয়ে নিজেই বাংলাদেশে আরেকটি এথনিক ক্লিনসিং শুরু করে। যে-ই আওয়ামী লীগের দুর্নীতি-লুণ্ঠন-ক্রসফায়ার-গুম-বৈষম্যের সমালোচনা করবে, তাকেই “রাজাকার” তকমা দিয়ে সিসটেমেটিক এথনিক ক্লিনসিং চালাতে থাকে স্বৈরাচারি হাসিনা সরকার।

বাংলাদেশ প্রত্যক্ষ করেছে; যে ভারত সরকার ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য করে আমাদের ঋণী করেছে; সেই ভারত সরকার মুক্তিযুদ্ধের ঋণ শোধ পেতে “শেখ হাসিনা”-কে তাদের মনপছন্দ শাসক হিসেবে বারবার ফুলমাল্যে বরণ করেছে; ২০১৪-১৮-২৪-এর নির্বাচনের পর। প্রণব মুখার্জি থেকে সুজাতা সিং হয়ে নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশে হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখতে প্রকাশ্য তৎপরতা চালিয়েছে। বাংলাদেশ ২০০১ থেকে ২০১৪ কট্টর ইসলামপন্থার অপতৎপরতায় বিপদাপন্ন ছিলো। ২০১৪ সালের পর ভারতে কট্টর হিন্দুত্ববাদ ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশে কট্টর হিন্দুত্ববাদের বিপদ প্রকাশ্য হয়েছে। শেখ হাসিনা লেখক ও ব্লগার হত্যাকারী ইসলামি কট্টরপন্থার সঙ্গে শোকরানা মেহেফিল করে, আর সীমান্তে ধারাবাহিক হত্যাকারী কট্টর হিন্দুত্ববাদী ভারতের সঙ্গে “মুক্তিযুদ্ধের ঋণ শোধ করে” বাংলাদেশের মানুষকে জীবন্মৃত অবস্থায় ফেলে দিয়েছেন।

ইতিহাস থেকে শিক্ষা না নেয়াই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটায়। তা নাহলে বৃটিশের অত্যাচার থেকে রক্ষা পেতে যে বঙ্গবন্ধু ” পাকিস্তান জিন্দাবাদ” শ্লোগান দিয়েছিলেন; তিনিই যখন ১৯৪৭-এর স্বাধীনতা সংগ্রামী মুসলিম লীগের সতীর্থদের লুন্ঠক ও ঘাতক হতে দেখলেন; তখন “জয় বাংলা” শ্লোগান দিয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৯৭১-এ স্বাধীনতা খুঁজলেন। যে “জয় বাংলা” শ্লোগান বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্মারক তা গত ১৫ বছরে কী করে ঘাতকের শ্লোগান হয়ে উঠলো!

নিরাপদ সড়ক আন্দোলন থেকে আজকের কোটা সংস্কার আন্দোলন পর্যন্ত এই একবিংশের শিশু, কিশোর, তরুণের সামনে “জয় বাংলা” কী করে ভীতিপ্রদ এক মারণঘাতী শ্লোগান হয়ে উঠলো। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কী করে গত দিন দিন পাখির মতো গুলি করে হত্যা করতে থাকলো আজ ও আগামীর বাংলাদেশকে।
একদিনে ৩২ জন শিশু-কিশোরের লাশ ১৯৭১ সালের পর এই প্রথম ২০২৪ সালের ১৮ জুলাই প্রত্যক্ষ করলো বাংলাদেশ। ১৭ জুলাই ৬টি লাশ। হাসপাতালে শত শত আহত কিশোর-কিশোরী। শেখ হাসিনা কার্যত এখন এক মহাশ্মশান ও কবরস্থানের প্রধানমন্ত্রী।

উনি যদি গণভবনের টাইম মেশিনের কমফোর্ট জোনের বাইরে বেরিয়ে এসে বাংলাদেশকে দেখেন, হত্যা লুন্ঠন ও বৈষম্যের বেনিফিশিয়ারি আওয়ামী জমিদার, দরবেশ ও ঘাতকদের “সব ঠিক আছে”-র জাস্টিফিকেশন পর্দার বাইরে চোখ রাখেন; দেখবেন আজকের আওয়ামী লীগের মুখাবয়বে এখন একাত্তরের খুনে ইয়াহিয়ার রক্তমাখা দাঁত।

শেয়ার করুন: