ফারজানা নীলা:
দীর্ঘ ৪০ বছরের বাস আমার এই বাড়িতে। আজ অন্যত্র চলে যাচ্ছি। জীবনের শেষে আজ হিসেবে বসেছি, জীবনে কি সুখী ছিলাম? একজন স্বামী ছিল, দুটি সন্তান ছিল। তাদের জন্ম, তাদের লালন পালন, পড়াশোনা, বিয়ে, স্বামী সেবা। সুখী হওয়ার জন্য আর কী লাগে! সুখীই যদি হতাম তাহলে কি “আমি কি সুখী?” প্রশ্নটি উঁকি দিতো মনে? এতো লোকের ভিড় আজ বাসায়। সবাই নাকি আমাকে দেখতে এসেছে। সবাই নাকি আমার আপনজন। তাও এতো নিঃসঙ্গ লাগছে কেন? ছিলাম নাকি কখনো সঙ্গিময়?
ওই যে বারান্দায় দরজা বন্ধ করে সিগারেট ফুঁকছেন যিনি, তিনি আমার স্বামী। রাতে কিছুক্ষণ চোখ মুছেছেন, এখন শুধু মুখটাই গম্ভীর করে রেখেছেন। পানি শুকিয়ে গেছে বোধ হয়। এই মানুষটিকে সুখে রাখার সকল চেষ্টা আমি আজীবন করে গেছি। তার ইচ্ছেয় চলেছি, পরেছি, খেয়েছি, শুয়েছি, মেনে নিয়েছি। ফলাফল তিনিও আমাকে শাড়ি গয়না খাওয়া পরা দিয়ে গেছেন। শুধু আমার ভাইয়ের সাথে আজীবন যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিলেন কোনো এক কথা কাটাকাটি নিয়ে। একদিন বিকেলে ফিরে নাস্তা পাননি। রেগে গিয়ে খানিক মেরেছিলেন। ছোট মেয়ে ক্লাস এইটে ফেল করেছিল। রেজাল্ট দেখে হাতের কাছে জুতা ছুঁড়ে মেরেছিল আমার দিকে। পারতপক্ষে তর্ক করিনি কখনো। তবুও মাঝে মাঝে কিছু কথা বলে ফেলতাম। সেই বলে ফেলার ফলস্বরূপ জুতার বারি খেয়েছিলাম কয়েকবার। আর বেশি কিছু করেনি।
মাঝ বয়সে ব্রেস্ট টিউমার হয়। স্বামী আমাকে কিন্তু ভালো চিকিৎসাই করিয়েছিলেন। প্রায় সুস্থই হয়ে যাই। আবার কিছু শারীরিক সমস্যা দেখা দিলে জানা গেল, চিকিৎসা এখানে করানো সম্ভব না, ভারত যেতে হবে। মনে হয়েছিল নিয়ে যাবেন। এতোবার উনি বিদেশ যান, একবার আমাকেও নিয়ে গেলেন! সেদিনই জীবনে বুকভাঙ্গা কান্না এসেছিল, যেদিন বললেন, “এতো টাকা খরচ করে যাবা?” হায়! আমার যে গলা দিয়ে স্বর বের হলো না। চোখ দুটো নামিয়ে জলটুকু লুকিয়ে খুব স্বাভাবিক সুরে বলেছিলাম “হ্যাঁ কী দরকার এতোগুলো টাকা খরচ করার!”
ছোট মেয়েটা কান্নাকাটি করে বাবাকে ধরায় শেষ পর্যন্ত নিয়ে গেল। ততোদিনে দেরি হয়ে গিয়েছিল অবশ্য। টাকার শ্রাদ্ধ হলো আসলেই।
মেয়েটা কোথায়? ওই তো রান্নাঘরে পা ছড়িয়ে বিলাপ করছে। আহা! বড় বোকাসোকা মেয়েটা আমার। মাকে মারলে মেয়ে পাগলের মতো কাঁদতো। বুঝতাম দরজা বন্ধ করে বহু রাত সে শুধু আমার জন্যই হাহাকার করতো।
ছেলেটা সকালে বের হলো, এখনো এলো না। এতো মানুষের সামনে সিগারেট খেতে অসুবিধা হচ্ছে হয়তো। কতবার বলেছিলাম, খোকাকে একটু খালার বাসায় নিয়ে যেতে। ছেলের সময় হয় না, কিন্তু কয়দিন আগে কক্সবাজার গিয়েছিল বন্ধুদেরসহ। ছোটবেলায় খোকা মায়ের চুল না ধরে ঘুমাতে পারতো না। আজ মায়ের চুল সাদা হয়ে গেলে ছেলেকে অনেক দূরের মনে হয়।
সকাল থেকে দুপুর, দুপুর থেকে সন্ধ্যা, সন্ধ্যা থেকে রাত এ ঘর থেকে ও ঘর করাই ছিল আমার একমাত্র কাজ। অফুরন্ত কাজ!
শুধু কি জেলই জেলখানা হয়? ঘরও হয়। যদি ঘর থেকে বের হয়ে যাওয়ার কোনও জায়গা না থাকে। এই সুবিশাল দেশে আমার যাওয়ার কোনো জায়গা নেই।
বারান্দায় বসে সময়কে বয়ে যেতে দেখা ছাড়া দেখারও কিছু নেই।
ঐ যে রাস্তা ধরে এক মহিলা চলে যাচ্ছে কাঁধে ব্যাগ নিয়ে, নিশ্চয়ই চাকরি করে। ফিরছে বোধহয় অফিস থেকে বাসায়। এমন যদি আমিও পারতাম। হাহাহ। মনে মনেই হেসে ফেললাম। মেয়ে মানেই তো বিয়ে দাও, বাচ্চা নাও ঘর করো, স্বামীর সেবা করো। এই তো ছিল আব্বার চিন্তা। ছিল আমারও। মেয়েরা চাকরি করবে কেন? এ তো ছেলেদের কাজ। মেয়েদের কাজ বাসায় থাকা। কিন্তু তখন তো বুঝিনি মেয়েদের এই কাজ কতো যন্ত্রণাদায়ক, কতো অপমানজনক, কতো ক্লান্তিকর, কতো নির্জীব বেরঙ এবং কতো সীমাহীন। দিনশেষে, জীবন শেষে দীর্ঘশ্বাস ছাড়া অবশিষ্ট কিছুই থাকে না। হায় জীবন! জীবন এমনও হয়!
কারও কাঁদো কাঁদো চোখ, কারও বিলাপ, কারও বিমর্ষ মুখ অথবা কারও গম্ভীর মুখ। সবাই ওই সাদা কাপড়ে ঢাকা লাশটিকে দেখতে এসেছে। জীবিত অবস্থায় এতো মানুষকে কখনো একসাথে দেখিনি। সময়ের তখন আকাশচুম্বী দাম ছিল, কেউ দিতে চায়নি। আজ মনে হয় পানির দামে বিলিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু সস্তার তিন অবস্থা। তাই সময় গ্রহণ করার জন্য আজ আমি জীবিত নই। আজ আমি মুক্ত। কারও জন্য রান্না করতে হবে না, রান্না ভালো না হলে শুনতে হবে না গালাগালি, কাউকে কিছু কিনে আনার জন্য বলতে হবে না, সইতে হবে না ভাত কাপড়ের খোটা। থাকতে হবে না ঘর সংসার নামক জেলখানায়। আজ আমার সকল ক্লান্তির সমাপ্তি। ছাড়া পেলাম।