যে গল্পগুলি কাল্পনিক নয়: ভয় – ৩

জিনাত আরা হক:

রিতার মতো ওমন স্মার্ট মেয়ে হাতে গুনে পাওয়া যায় না, বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় সবাই ওকে চিনতো। লেখাপড়ার পাশাপাশি বিতর্ক, থিয়েটার,গান সবকিছুতে ওর সমান উপস্থিতি। ওড়না পরতে রিতার কখনো ভালো লাগে না, অবশ্য বন্ধুরা বলে ওকে ফতুয়া-জিন্স বেশি মানায়। পুরো ক্যাম্পাস জীবনে একটা প্রেম হলো না ওর, হবেই বা কীভাবে! ছেলেগুলো হয় ওর বন্ধু অথবা ভাই। মাস্টার্স ফাইনাল দেয়ার পর পরিচয় হয় থিয়েটার গ্রুপের এক বড়ভাই এর সাথে। জাহিদ ভাই তখনও সেভাবে প্রতিষ্ঠিত না, কিন্তু ভালো ছাত্র, বাম রাজনীতি করা, ভালো তবলা বাজান। খুব শিগগিরই ভালো বেতনের একটা চাকরি পেয়ে যাবে। জাহিদ সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দেয় রিতাকে। রিতা বাড়ির বড় মেয়ে, মনে করে, বিয়ে তো করতেই হবে, জাহিদ ভাই এর মতো সংস্কৃতিমনা একজন মানুষ জীবনসঙ্গী হলে বরং ওর সুবিধা। রিতার প্রতি ওর মা বাবার গভীর আস্থা, তারাও অমত করেন না।
রেজাল্টের আগেই রিতার এক এনজিওতে চাকরি হয় ভালো বেতনের, তখনও জাহিদ বিভিন্ন সরকারি পদগুলিতে পরীক্ষা দিচ্ছে। রিতার কাজের এলাকা গাইবান্ধা।

জাহিদ জানায়, তার পক্ষে ঢাকা ছাড়া সম্ভব না। রিতা একা গাইবান্ধায় বাসা ভাড়া নেয়। প্রতি সপ্তাহে আসে ঢাকায়, জাহিদকে তার অচেনা লাগে, সারাক্ষণ রাগ রাগ আচরণ, রিতা মনে করে বোধহয় মনমতো চাকরি হচ্ছে না, তাই এমন করে। প্রথম মাসের বেতন পেয়ে রিতা অর্ধেকটা জাহিদকে দেয়, নিজের জন্য রাখে আর মা-বাবাকে কিছু পাঠায়।

দ্বিতীয় মাসে যখন মা-বাবাকে টাকা পাঠাবে জাহিদ আপত্তি জানায়, “তোমার কেনো ওনাদের টাকা দিতে হবে? মা-বাবাকে দেখা মেয়েদের দায়িত্ব না।” রিতার বিস্ময়ের ঘোর কাটে না। বাম দল করা, নারী অধিকারের পক্ষে আন্দোলন করা জাহিদের মুখে একি কথা! কথা কাটাকাটি, ঝগড়াঝাঁটি, রিতা তবু নিজেকে বোঝায়, ভালো চাকুরি না থাকায় জাহিদ এমন করছে।

লেখক

চাকরিতে রিতার বেশ সুনাম হচেছ, আগে থেকেই বন্ধু বান্ধবের সংখ্যাও কম না, তারা বাসায় আসে, আড্ডা দেয়, জাহিদের এতেও আপত্তি। এতো বন্ধু কেনো? রিতার ফেসবুক, মেসেঞ্জার, হোয়াটস আপ সবকিছুর পাসওয়ার্ড জাহিদের কাছে।

এবার রিতার পোষাক নিয়ে আপত্তি জাহিদের। রিতাকে সে হিজাব পরতে বলে, “রিতা যে যথেষ্ট সংসারি না”, এ কথা জাহিদ রিতাকে বোঝাতে থাকে। রিতাকে দোযখের ভয়, পরিবারের সম্মানের কথা, স্বামী-স্ত্রীর ভালো সম্পর্কের উপায় হিসেবে হিজাব যে একমাত্র সমাধান, তা বোঝাতে থাকে।

রিতা আমাকে প্রশ্ন করে, “আপা, এতোবড় ভুল কেমনে করলাম, সারাজীবন কীভাবে এই লোকের সাথে থাকবো? কখনো কি সে বদলাবে? কখনো কি আমার স্বামী বুঝবে, যে সে যা বলছে, তা অন্যায়?”

রিতার মতো ওমন আত্মবিশ্বাসী মেয়েটি বলে, “আমি ভয় পাই। সব ছেলেরাই কি এমন আপা? তাহলে জাহিদকে ছেড়ে আর একজন পুরুষের কাছে গেলে সেও তো একই কাজ করবে। আমি যদি বদলে যাই, তাহলে কি সংসারে শান্তি আসবে? তাহলে আমাকে সে পছন্দ করলো কেনো?”
কোনটা ভয়ের জাহিদের সাথে থাকা, না একাকি স্বাধীন জীবন বেছে নেয়া!

(নামগুলি ছদ্মনাম)

লেখক: উন্নয়ন ও নারী অধিকার কর্মী
# IPV
# Domestic Violence

শেয়ার করুন: