মুশফিকা লাইজু:
বাংলাদেশের শতকরা ৯৫ ভাগ পুরুষই জেনে বা না জেনে, সচেতনে-অবচেতনে এক একজন পেডোফিল (paedophile) অর্থাৎ শিশুযৌন নিযার্তক। শিশুকে স্পর্শ করে স্নেহ বা আদর করা এদেশের একটা অপসংস্কৃতি। যার প্রচ্ছন্ন ছত্রছায়ায় ক্রমেই বেড়ে ওঠে একজন যৌন নিপীড়ক।
আমি নিশ্চিত করে বলতে পারতাম না, যদি না আমার একটা কিশোরী কন্যা থাকতো এবং তার প্রাত্যহিক জীবন আমি গভীরভাবে প্রত্যক্ষ না করতাম। নিজে যখন শৈশবে আত্মীয়-অনাত্মীয় বা স্বজন পুরুষ দ্বারা এই ধরনের molest হতাম। তখন মোলেস্ট কি তার সম্পর্কে আমার কোন ধারণা ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এসে প্রথম পেডোফিল সম্পর্কে জানলাম, দেখলাম বুঝলাম এবং সচেতন হলাম।

লক্ষ্য করলাম, যখনই কোন শিশু নাগালের মধ্যে আসে, বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি পুরুষের চোখ চকচক আর হাত নিশপিশ করে ঐ শিশুটিকে কচলে দেয়ার জন্য। কন্যা শিশুর বেলায় তো কোন ছাড় নেই। ছেলে শিশুরাও রেহাই পায় না তা থেকে। সে ৩ থেকে ১৮ বছর পযর্ন্ত যেই হোক না কেন। প্রথমত: টেনে কোলে বসাবে, গাল টিপে দেবে, পিঠ কচলে দেবে, হাত ধরে টিপতে থাকবে, উরুতে হাত দিয়ে কুশলাদি জিজ্ঞাসা করবে। কেউ কেউ আবার চেয়ারে বা টুলে উঁচু করে বসতে সাহায্য করতে গিয়ে বগলের নিচে হাত ঢুকিয়ে আস্তে করে স্তন টিপে দিচ্ছে। যারা এসব করেন, তারা ভেবেই নেন অন্যরা বিষয়টি নির্দোষ মমতা হিসেবেই দেখছেন। কারণ শিশুরা তো পবিত্র, তাদের প্রতি কারো কোন রকম যৌনানুভূতি হতে পারে না। তাই যদি হবে তবে তিন মাসের কন্যা শিশু ধর্ষণের শিকার হয় কীভাবে? সত্যিকার অর্থে পুরুষ সর্বদাই তার পাশবিকতা নিয়ে নিরীহ গোবেচারা হয়ে সুযোগ খুঁজতে থাকে।
আমাদের দেশের পুরুষেরা জানেনই না বা জানতে চানও না, নিজের বা অন্যের শিশুদের সাথে কতটা দূরত্ব রাখা নিরাপদ এবং ভদ্র-জনোচিত। শিশু হলেই যে তাকে স্পর্শ করা যাবে, দলাই-মলাই করা যাবে, এই পাশবিক আচরণ তিনি বা তারা সমাজ-প্রতিবেশ থেকে রপ্ত করেন। সকলের চোখে মমতাময় আঙ্কেল, মামা-চাচা-খালু-ভাইয়া-শিক্ষক সেজে দারুণ একটা যৌনসুখ উপভোগ করে নেন তারা।
সমাজ যখন স্খলনকে বৈধতা দেয়, তখন ব্যক্তি চরিত্র দুর্দমনীয় হয়ে ওঠে। এমনকি, আমি অনেক বাবা-মাকে বলতে শুনেছি, কাকা বা মামা ডাকছে, যাও, কাছে যাও। যদিও বা শিশুটি যেতে গড়িমসি করে, তখন তাকে বলা হয় বেয়াদবি করো না। আবার অনেক অভিভাবককে বলতে শুনেছি, ‘যাও পায়ে হাত দিয়ে সালাম কর’। আর সেই সালামের ফজিলত হিসেবে দেখেছি ঐ আগন্তুক খপ করে বুকে জড়িয়ে একটু যৌন সুধা পান করে নেয়। কেউ কেউ বলতে পারেন, সব স্পর্শ কামযুক্ত থাকে না।
তাদের জন্য বলছি, অনুগ্রহ করে এই ‘মাইন্ড সেট’ থেকে বেরিয়ে আসুন। অন্যের কন্যা শিশুকে খুব কম পুরুষই নির্দোষ স্পর্শ করে। আজ যদি আপনি সতর্ক না হোন, যদি প্রচলিত ধারণার বশবর্তী হোন, তবে আপনার শিশুটিও কোন শকুনী মামা-চাচার লালসার শিকার হয়ে এক রকমের ট্রমা নিয়েই হয়তো বড় হতে থাকবে। আমাদের দেশে যদিও শিশুযৌন নির্যাতনের বিরুদ্ধে কিছু আইন আছে, আমরা আন্তর্জাতিক শিশু সনদে স্বাক্ষরকারী একটি দেশ। যদিও সে সকল আইনের ব্যবহারিক দিক শূন্যের কোঠায়; তবু তো কিছু আইন আছে- হোক না সেটা শুধুই কাগজে।
কিন্তু সবচেয়ে ভয়াবহ দিক হলো, আমাদের কোন সামাজিক প্রতিরোধ নেই। পারিবারিক বা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। আজকাল কিছু বেসকারী উন্নয়ন সংস্থা শিশুর যৌন হয়রানির বিষয়ে সচেতনতামূলক কাজ করছে বটে, কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। কিন্তু পশ্চিমা দেশগুলোতে এই বিষয়ে সকলে ১০০ ভাগ সচেতন। শিশু, অভিভাবক কিংবা আত্মীয়-অনাত্মীয়। তাদের আছে কঠোর আইন, সামাজিক প্রতিরোধ এবং বিচারব্যবস্থা। কী নারী, কী পুরুষ, অন্যের শিশুকে অনাকাংখিত স্পর্শ কেউ করতে পারবে না।
একটা কেস স্টাডি দিয়ে শেষ করি, আমার একজন কিশোরী কন্যা আছে। আমি নিজেকে একজন সচেতন মা বলেই বিশ্বাস করি। তথাপি আমার কন্যা একদিন আমাদেরই এক বন্ধু সম্পর্কে অভিযোগ করেছে যে, ঐ আঙ্কেল সব সময় তার কাঁধে হাত রেখে কথা বলে- যে স্পর্শ তার জন্য স্বস্থিকর নয়। এর পরবর্তিতে আমি তীক্ষ্ণ নজর রাখলাম আমাদের ঐ বন্ধুর আচরণের প্রতি।
সত্যিকার অর্থে আমি লক্ষ্য করলাম, আমাদের ঐ বন্ধু আমার বা আমার অন্য বন্ধুদের কন্যা সন্তান দেখলে কেমন একটা অস্থিরতা দেখায়। সকলের আগে উঠে এসে হাত বাড়িয়ে দেয় যেন কত মমতাময় আঙ্কেল সে। আমি তার আঙ্গুুলগুলো লক্ষ্য করেছি, তার আঙুলের কম্পনও লক্ষ্য করেছি। অবশেষে তাকে স্পষ্টই বলে দিয়েছি, আমার কন্যাকে স্পর্শ না করতে। নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখেই যেন তিনি স্নেহ করেন। আর একটি পর্যবেক্ষণ আমার আছে, যারা পুত্র সন্তানের পিতা তাদের মধ্যে বেশির ভাগেরই এই শিক্ষার খুবই অভাব যে অন্যের কন্যা শিশুকে কতটা নিরাপদ দূরত্ব থেকে স্নেহ করা যায় বা করা উচিত।
বর্তমান পেডোফিলদের বলছি, কন্যাশিশুরা জন্মের মধ্য থেকেই তৃতীয় নয়নের অধিকারী। প্রকৃতিই তাদের শিখিয়েছে কোনটা নষ্ট স্পর্শ। সুতরাং শিশু বলে তাদের বেবোধ বা শক্তিহীন ভাবেন না। মনে রাখা উচিত, আগুন জ্বালাতে একটা দেশলাইয়ের কাঠিই যথেষ্ট। সময়ের পরিক্রমায় আপনি ক্ষমা নাও পেতে পারেন।