ধর্ম, অধর্ম ও পশ্চাৎপদতা!

ফারদিন ফেরদৌস:

সম্প্রতি বাংলাদেশের একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের রান্না বিষয়ক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলেন কলকাতার জনপ্রিয় অভিনেত্রী ও রন্ধনশিল্পী সুদীপা চ্যাটার্জি। ওই অনুষ্ঠানের অ্যাংকর তারিন জাহান বিফ রান্না করে দেখিয়েছিলেন। রান্না, খাওয়া বা ঘ্রাণ নেয়া কোনোটিতেই মিজ সুদীপার অংশগ্রহণ ছিল না।

ওই অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের অভিনেত্রী তারিন জাহানের পাশে দাঁড়িয়ে গরুর মাংস রান্না করতে দেখেন সুদীপা। এরপর হিন্দু ধর্মের অনুসারীদের তীব্র রোষানলে পড়েন তিনি। সোশ্যাল মিডিয়ায় ধর্ষণ ও খুনেরও হুমকি পেয়েছেন। ভয়ে নিজের ছেলেকে স্কুলেও পাঠাতে পারছেন না।

পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে গণমাধ্যমকে সুদীপা বলেছেন, ভালো থাকার চেষ্টা করছি। এতদিন হয়ে গেল আজও আমার ছেলেটাকে স্কুলে পাঠাতে পারিনি। কিছুদিন পর হয়তো পাঠাতে পারবো। পুলিশ খুব সাহায্য করছে। ওরা জানিয়েছে, নিরাপত্তা দেওয়ার চেষ্টা করবে।

অনুষ্ঠানটি বাংলাদেশের কোরবানি ঈদকে কেন্দ্র করে নির্মিত হয়েছিল। গরু বঙ্গভূমির কোরবানির অন্যতম অনুষঙ্গ। কাজেই বিফ রান্নাতে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায়নি। খোদ ভারতও বহির্বিশ্বে গরু এবং গোমাংস রপ্তানি করে। বাংলাদেশে ওই অনুষ্ঠান নিয়ে কোথাও তেমন কোনো কথা ওঠেনি। কিন্তু সুদীপা পড়েছেন বড় বিপাকে। পারলে একশ্রেণীর কলকাতাবাসী তাঁকে শহরছাড়া করে। সুদীপার সন্তানদের স্কুলে যেতে বাধা দিচ্ছে এক্ট্রিম হিন্দুরা। ধরে নেয়া যায় কেন্দ্রীয় সরকারের কাউ পলিটিক্সে একরকম মজে আছে একশ্রেণীর ভারতবাসী। সুদীপা তাদের বোঝাতেই পারছেন না যে তিনি বিফ ছুঁয়েও দেখেননি, এমনকি গরু খাওয়ার পক্ষে একটা শব্দও উচ্চারণ করেননি। মোটের ওপর এই হলো আমাদের সাব কন্টিনেন্টাল ধর্ম পালনের হালহকিকত।

তর্কের খাতিরে ধরে নেই বিফ কুকিং প্রোগ্রামে অংশ নিয়ে সুদীপার জাত গেছে, তিনি যবন হয়ে গেছেন। তাতে অন্যের কী? ধর্মীয় বিধি লঙ্ঘনের ঐশ্বরিক শাস্তি সুদীপার নিজেরই পাওয়ার কথা। তার পাপ তো অন্যের ওপর বর্তাবে না। তারপরও কট্টরপন্থিরা সুদীপার জীবন জেরবার করে ছাড়ছেন কেন? ধর্মগুরু ও পলিটিশানরা তাঁর নাম নিয়ে মাঠ গরম করছেন কেন? একজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে অনেক বড় ধর্মকে দাঁড় করিয়ে দেয়া হচ্ছে।ব্যাপারটি যে অনভিপ্রেত এই বুঝ গোঁড়ামিতে মজে থাকা ওইসব ব্যক্তিবর্গের নেইই।

মানুষ দিন দিন আধুনিক হচ্ছে। বিজ্ঞানমনস্ক হচ্ছে। দুনিয়া মঙ্গলগ্রহে পৌঁছে যাচ্ছে। কিন্তু আমাদের উপমহাদেশের একশ্রেণির মানুষ ধর্মকে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য অপব্যবহার করছে।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে আজকেই খবরটি বের হয়েছে। ধর্মকে ব্যবহার করে মোহাম্মদ রিজওয়ানের মতো পাকিস্তান ক্রিকেটাররা তাঁদের বাজে পারফরম্যান্সকে ঢাকার চেষ্টা করছেন, এমন অভিযোগ তুলেছেন অপর খেলোয়াড় আহমেদ শেহজাদ।

শেহজাদ তাঁর এক্স হ্যান্ডেলে বলেছেন, ‘তোমাকে মাঠে পারফর্ম করতে টাকা দেওয়া হয় আর তুমি দলের মধ্যে দলাদলিতে অংশ নাও। ধর্ম আমাদের দায়িত্ব পালনের শিক্ষা দেয়, আমাদের ভোগান্তি নিয়ে মিথ্যা বলা শেখায় না।’ তার মানে ধরেই নেয়া যায় পাকিস্তানের কোনো প্লেয়ার ব্যক্তিস্বার্থে ধর্মকে ব্যবহার করছেন।

অপরদিকে বাংলাদেশে কী হচ্ছে?
এখানে ধর্ম শব্দটি উচ্চারণ করলেই সাতবার ভাবনা চিন্তা করতে হয়। কখন জানি কার অনুভূতি টিকটিকির লেজের মতো খসে পড়ে। তেড়ে এসে শারীরিক বা মানসিকভাবে নিগ্রহ করে বসে। অথচ ধর্মের সূতিকাগার খোদ সৌদি আরবের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ বিন সালমান ফলাও করে নিজেদের ধর্মীয় অসঙ্গতির সমালোচনা করতে পারেন। হাদিস দিয়ে ইসলাম ধর্ম বিবেচনা না করবার আহ্বান জানাতে পারেন। এমবিএস দুই পবিত্র মসজিদ ও কাবা শরীফের অন্যতম কাস্টডিয়ান।

আমাদের ক্রিকেটারদের খেলায় না যতটা মনোযোগ তার অনেক বেশি লোকদেখানো ধর্মপালনে তাঁদের আগ্রহ। মাঠের প্রার্থনা সোশ্যাল মিডিয়া কিংবা মূলধারার গণমাধ্যমে প্রচার করতে তাদের যতটা আগ্রহ তার ছিটেফোঁটাও সত্যিকারের ধর্মপালনে নেই। ক্রিকেটে যেহেতু বাজির সংশ্রব আছে। ধর্মীয় বিধান ক্রিকেট খেলাকে বৈধতা দেয় না।

এই কথাগুলো বলতে গেলেই একদল তেড়েফুঁড়ে আসবে, তুমি একথা বলবার সাহস পাও কেমনে? ব্ল্যাসফেমি করছো তুমি! অথচ ধর্মের আসল মর্মবাণীর অবমাননা তারাই করছে যারা ধর্মাচারকে দেখনদারির পর্যায়ে নিয়ে গেছে।

মানুষের প্রশংসা, সামাজিক প্রভাব ও কারো দৃষ্টি আকর্ষণ ইত্যাদির মোহে ইবাদত করাকে ইসলামি পরিভাষায় ‘রিয়া’ এবং বাংলা ভাষায় লোকদেখানো বা প্রদর্শনপ্রিয়তা বলা হয়।

রাসুল (সা.) রিয়া বা লোক দেখানো আমলকে ছোট শির্ক বলেছেন। তিনি বলেন, ‘আমি তোমাদের ব্যাপারে ছোট শির্ক নিয়ে যত ভয় পাচ্ছি, অন্য কোনো ব্যাপারে এত ভীত নই।

সাহাবিরা বলেন, হে আল্লাহর রাসুল, ছোট শির্ক কী? তিনি বলেন, রিয়া বা প্রদর্শনপ্রিয়তা। মহান আল্লাহ কিয়ামতের দিন বান্দার আমলের প্রতিদান দেওয়ার সময় বলবেন, ‘তোমরা পৃথিবীতে যাদের দেখানোর জন্য আমল করতে তাদের কাছে যাও। তাদের কাছে দেখো তোমাদের কোনো প্রতিদান আছে কি না?’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ২২৫২৮)।

এইসময়ের বাংলাদেশে আধুনিকতার কথা বলা টোটালি বৃথা। প্রগতিশীলতা শব্দটিই এখন মুখে নেয়া যায় না। ব্যাপকভাবে তুচ্ছতাচ্ছিল্যের শিকার হতে হয়ে। সরকার একদিকে পড়াশোনায় আধুনিকতার নামে কারিকুলাম পরিবর্তনের কথা বলছে। অন্যদিকে বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠী ওই কারিকুলাম থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে নিজেদের সন্তানদেরকে ধর্মীয় শিক্ষায় বসিয়ে দিচ্ছে। গেল একবছরে তিন শতাধিক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ হয়ে গেছে। এইসময় ১০ লাখ প্রাইমারি শিক্ষার্থী স্কুলছাড়া হয়েছে।

একদিকে ফেসবুক-ইউটিউবের মতো অত্যন্ত জনপ্রিয় সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রগতিবিরোধীদের ওয়াজ বক্তৃতায় ভরিয়ে রাখবার সুযোগ দেবেন, অন্যদিকে কারিকুলামকে বৈশ্বিক মানদণ্ডে নিয়ে যাওয়ার কথা বলবেন, এটা সম্পূর্ণতই নিচ দিয়ে গাছ কেটে ওপর দিয়ে জল ঢালবার শামিল।

ব্রিটিশ বিদায় হয়েছে। কলোনিয়ালিজম পার হয়ে এসেছি ভাবছি। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে ডিজিটাল উপনিবেশবাদে আমাদের সবাইকে আটকে দিচ্ছে সেখান থেকে কারোরই নিস্তার নেই। ফেসবুক-ইউটিউব উগ্র ধর্মের প্রচারের পক্ষে যতটা সরব অন্যবিধ নীতি নৈতিকতা, শুদ্ধ শিল্প সংস্কৃতিতে তাদের অত আগ্রহ নেই। পাবলিক ডিমান্ড বুঝে চলে সোশ্যাল মিডিয়ার স্বয়ংক্রিয় অ্যালগরিদম। ইভোলিউশন থিউরির বিশ্ববিশ্রুত সায়েন্স মুসলিম বাঙালি‌ বাতিল করে দিয়েছে। ওই বাতিলের বাহুল্য প্রচারটাও সোশ্যাল‌ মিডিয়া করে দিচ্ছে। ওই প্রচারেই প্রচুর মানি। আমরা যত নির্বোধ হবো সাম্রাজ্যবাদীদের ততো লাভ।

লেখক

এমন জটিল বাস্তবতায় মানুষের মনস্তত্ত্ব বুঝে তাকে ঠিক লাইনে ফেরানো এত সহজ নয়। অনগ্রসরতা ও পশ্চাৎপদতার মতো অধর্মকে যারা পারলৌকিক মঙ্গল বলে ধরে নিয়েছে তাদেরকে শোধরানোর সাধ্য এইসময়ের কোনো লৌকিক মহামানবের নেই। অশুভকে নার্সিং করে শুভবোধের পক্ষে বলাটা পুরোদস্তুর নির্বুদ্ধিতার নামান্তর।

‘যে ধর্মের নামে বিদ্বেষ সঞ্চিত করে, ঈশ্বরের অর্ঘ্য হতে সে হয় বঞ্চিত’ -কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই অমোঘ বাণী উপমহাদেশের হিন্দু-মুসলিমদের মানবার ফুরসৎ আর নেই। ‘মানবতাই মানুষের একমাত্র ধর্ম হওয়া উচিত’ -দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেলও আমাদের উদ্দেশ্যে অমন কথা আর বলতে পারবেন না।

-ফারদিন ফেরদৌস
৪ জুলাই ২০২৪

শেয়ার করুন: