দ্যা রয়্যাল লাইফ – রানী জীবন – নারী জীবন

তানবীরা হোসেন:

বিদ্রোহী বধূ হিসেবে প্রয়াত ব্রিটিশ রাজবধূ লেডি ডায়না ইতিমধ্যে কয়েক জেনারেশানের চর্চার বিষয়। স্বামী, শাশুড়ি কেউ খুশি ছিলেন না তার ওপরে। সম্প্রতি তাতে যোগ হয়েছে তারই পুত্রবধূ প্রিন্স হ্যারির স্ত্রী মেগান মার্কেলের নাম। মেগান তো আরও এক ডিগ্রী বেশি, তিনি সংসার ভেঙে দেয়ার অপরাধে অপরাধী। রাজকীয় ঐতিহ্য ভেঙে স্বামী নিয়ে আলাদা সংসার পাতা? ভাবা যায়! সম্প্রতি নেটফ্লিক্সের সিরিজ “হ্যারি এন্ড মেগান” আর “দ্যা ক্রাউন” এই বির্তক আরো উস্কে দিয়েছে।

নেদারল্যান্ডসের রাজবধূ থেকে রানী’র সিংহাসনে বসা মাক্সিমা কিন্তু সবসময় আলোচনার আড়ালেই থেকে যান তার কারণ-

১। প্রিন্স অফ অরেঞ্জ আলেকজান্ডার আর আর্জেন্টিনিয়ান সামরিক জান্তার মেয়ে মাক্সিমার প্রেম হওয়ার পর যখন তাদের বিয়ের কথা উঠলো, জানা গেলো, ১৯৭০ সালে আর্জেন্টিনার সামরিক সরকার জেনারেল জর্জ রাফায়েল ভিদেলা’র কৃষিমন্ত্রী ছিলেন মাক্সিমার বাবা। একনায়ক সেই সরকারের বিরুদ্ধে বহু খুনের অভিযোগ ছিলো, এবং মাক্সিমার বাবা  Jorge Horacio Zorreguietaকে সেই হত্যাকারী দলের একজন সদস্য মনে করা হয়। সামরিক জান্তার কর্মকর্তার মেয়েকে রাজবধূ করা প্রায় অসম্ভব। অনেক আলোচনার পর ডাচ পার্লামেন্ট জানালো, ঠিক আছে, প্রেম যখন হয়েই গেছে, বিয়ে তাহলে হোক। কিন্তু মাক্সিমার বাবা, মেয়ের বিয়ের মূল অনুষ্ঠানে আসতে পারবে না। কারণ বিয়ে শুধু রাজার একান্ত ব্যাপার নয়, ডাচ জাতিরও ব্যাপার। তবে, মূল অনুষ্ঠানের পরের রাজকীয় নৈশভোজ ও অন্যান্য ক্লোজ ডোর অনুষ্ঠানে তিনি উপস্থিত থাকতে পারবেন। এই শর্ত মেনে নিয়েই মাক্সিমা বিয়ে করেছেন। ইগিলি পিগিলি দেশের হেন কোন রাষ্ট্রদূত নেই যারা বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দেননি, সারা পৃথিবী থেকে নানা দেশের প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, গায়ক, নায়ক সব উড়ে এসেছে বিয়ের দাওয়াতে কিন্তু মেয়ের বাবা ছিলেন, বাড়ির বাইরে।

২। ডাচ দেশের কোন রাজকীয় অনুষ্ঠানে মাক্সিমার বাবা কখনো অংশগ্রহণ করেন নি। ২০১৩ সালে প্রিন্স উইলাম আলেকজান্ডার রাজা হিসেবে আর তার নিজের কন্যা নেদারল্যান্ডসের রানী হিসেবে শপথ নিয়েছেন সেই অনুষ্ঠানেও তাঁর বাবা ছিলেন না। কিন্তু বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশের মেহমান উপস্থিত ছিলেন সেখানে। প্রিন্স  উইলাম রাজা হওয়ার পর থেকে, ডাচ ট্র্যাডিশন অনুযায়ী রাজকীয়ভাবে তার মেয়ে জামাইয়ের জন্মদিন পালন হয়। পুরো নেদারল্যান্ডস ছুটি থাকে, পুরো দেশ আনন্দ করে কিন্তু জামাইয়ের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে শ্বশুর নেই।

২০১৭ সালে মাক্সিমার বাবা ক্যান্সারে মারা যান। যদিও ডাচদের কলোনী করার ইতিহাস এখনো পুরনো হয়নি। মাত্রই ২০২২ সালে প্রাক্তন ডাচ প্রাইম মিনিস্টার মার্ক রুতে ১৯৪০ এর ভয়াবহ রক্তক্ষয়ের জন্যে ইন্দোনেশিয়ার কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। ২০২৩ সালে রাজা উইলাম আলেকজান্ডার “দাস প্রথা”র অমানুষিক সুবিধা নেয়ার কথা স্বীকার করে দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। সুরিনাম, আরুবা, বোনার, কুরাসাও সহ বহু রাষ্ট্র এখনও তাদের নির্দয় রক্তপাত আর কলোনিয়াল ইতিহাসের সাক্ষী।

৩। নেদারল্যান্ডসের রাজবধূ হওয়ার জন্যে মাক্সিমাকে বিভিন্ন পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে লাগাতার যেতে হয়েছে। এক একটি পরীক্ষায় তিনি কৃতকার্য হতেন আর রেডিও টিভি সেটি ফলাও করে প্রচার করতো, তিনি রাজবধূ হওয়ার ক্যান্ডিডেট হিসেবে আর এক ধাপ আগালেন। প্রিন্স আলেকজান্ডারকে আর্জেন্টিনার জামাই হওয়ার জন্যে কোন পরীক্ষা দিতে হয়েছিলো কিনা জানা নেই। কিন্তু মাক্সিমাকে পোশাক, খাওয়া, ভাষা, আবহাওয়া সব কিছুতেই নতুন করে অভ্যস্ত হতে হয়েছে।

৪। বিয়ের আগে তাকে মেডিক্যাল চেকাপের মধ্যে দিয়েও যেতে হয়েছে। রাজবাড়ির মেডিক্যাল টিম তাকে পরীক্ষা করে দেখেছে, সন্তান ধারনে তিনি সক্ষম কিনা, সেটি পজিটিভ হবার পরই রাজবাড়িতে তাঁর বিয়ের কথা পাকা হয়। রেডিও টিভিতে সেই নিউজও প্রচার হয়েছিলো।

৫। বিয়ের প্রায় সাথে সাথে তাকে গর্ভধারণ করতে হয় এবং আমাদের ক্রাউন প্রিন্সেস এমেলিয়ার জন্ম হয়।

বাংলা ভাষাভাষীদের কাছে “ঠাকুরবাড়ি” একটি খুব পরিচিত নাম। সেখানে মাতঙ্গিনী হয়েছেন কাদম্বরী, ভবতারিণী হয়েছেন মৃণালিনী। আর্জেন্টিয়ান কন্যা মাক্সিমার রানী মাক্সিমা হয়ে ওঠার গল্পের সাথে এই গল্পটার কিংবা বাস্তবতার পার্থক্য কোথায়?

পুড়বে মেয়ে উড়বে ছাই,

তবেই মেয়ের গুণ গাই।

 

শেয়ার করুন: