প্রাইভেসি ও নারী যখন একে-অপরের সমার্থক!

সঙ্গীতা ইয়াসমিন:

প্রাইভেসি বিষয়টি যদিও সকল মানুষের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ, তথাপিও আমাদের সমাজে নারীর প্রাইভেসি যেন আমজনতার সম্পদ! তাই আলাদা করে জেন্ডার বৈষম্যের প্রেক্ষাপটে এ বিষয়টি নিয়ে ভাববার অবকাশ রয়েছে বৈকি।

বিষয়টি অতীব পুরাতন, বহুল চর্চিত হলেও বহুল আলোচিত নয়, বরং আজকের এই সোশ্যাল মিডিয়াকেন্দ্রিক জীবনে এটি ততোধিক সময়োপযোগী। নারী স্বাধীনতার আলোচনায় নারীর মবিলিটি, নারী শিক্ষা, নারীর উৎপাদনশীলতার মতোই নারীর প্রাইভেসিও এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। যদিও আমাদের মত দেশগুলোতে নারী যখন কেবলই সেক্স অবজেক্ট, সেখানে নারীর প্রাইভেসিও বহুলাংশে আনন্দ-বিনোদনের উৎসের মধ্যেই পড়ে। আর সেকারণে যেকোনো নারীর প্রাইভেসি নস্যাৎ করার জন্য নারীকে সেই কৈশোর থেকেই নানাবিধ আক্রমণাত্মক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। এটা একধরনের সোশ্যাল পুলিশিংও বটে। যেহেতু নারী গুল্মলতা, বৃক্ষের ন্যায় তার শক্ত মেরুদণ্ড (?) নেই, তাই তার প্রাইভেসির বিষয়েও জগতের সকলের মাথাব্যথা, এবং এটাই যেন স্বাভাবিক।

ইংরেজি private শব্দের বিশেষ্যরূপ privacy; যার ইংরেজি সংজ্ঞা-“the state of being free from being observed or disturbed by other people, or free from public attention” সহজভাবে বললে ব্যক্তির ব্যক্তিগত বিষয়াদি, যা একান্ত গোপনীয়, যা দশ কান হবে না এবং দশের সে বিষয়ে কৌতূহলও থাকবে না। আর এই ব্যক্তিগত বিষয়াদিকে সুরক্ষিত করার ব্যবস্থাপনাই হলো প্রাইভেসি। ব্যক্তি তাঁর ব্যক্তিগত তথ্যসমূহ কীভাবে সংরক্ষণ, পরিবেশন ও সন্নিবেশন করবেন সে ব্যাপারে অবশ্যই ব্যক্তির নিজস্ব মতামত এবং সিদ্ধান্তই শেষ কথা। স্থান-কাল-পাত্র ও পরিবেশ বিশেষে ব্যক্তি তাঁর গোপনীয়তা কতটুকু উন্মুক্ত করবেন, অথবা করবেন না, সেটা ব্যক্তির নিজস্ব এখতিয়ার।

সংস্কৃতিভেদে ব্যক্তির গোপনীয়তার ধরন এবং গোপনীয় তথ্যের ধরন ভিন্ন হতে পারে। একইসাথে ব্যক্তির একান্ত নিজস্ব তথ্য সকলের জন্য উন্মুক্ত করা হবে কিনা, কিংবা কতটুকু তথ্য ব্যক্তির কাছে প্রত্যাশা করা যাবে, এসব বিষয়ে লিখিত আইনের বাইরেও সামাজিক সীমানা নির্ধারণ করা আছে।

পাশ্চাত্য সমাজে রাষ্ট্র ব্যক্তির ব্যক্তিগত তথ্যাদি সংরক্ষণের দায়ভার গ্রহণ করে থাকে। কানাডায় Personal Information Protection Act (PIPA) নামে ব্যক্তির ব্যক্তিগত তথ্যসমূহের সুরক্ষা প্রদানের আইন রয়েছে। কেউ যদি মনে করে কোনো প্রতিষ্ঠান তাঁর ব্যক্তিগত তথ্যাদি পাবলিক করেছে, তাঁদের বিরুদ্ধে এই আইনের আওতায় মামলা করা যায়, এবং বিষয়টি প্রমাণিত হলে বড় অংকের ক্ষতিপূরণ দিতে হয়। প্রতিষ্ঠান ছাড়াও এই অভিযোগে কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারিও অভিযুক্ত হতে পারেন, সেক্ষেত্রেও নিয়মের ব্যত্যয় ঘটে না।

সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন উঠতে পারে কী সেই ব্যক্তিগত তথ্য যা এতোটাই মূল্যবান! আদতে যে সমাজে মানুষ মূল্যবান উপাদান, সেখানে মানুষের সবকিছুই মূল্যবান। কোনোরূপ আইনি প্রয়োজন ছাড়া কেউ আপনার নাম-ধাম, জেন্ডার, বৈবাহিক তথ্য, সেক্সুয়াল অরিয়েন্টেশন, স্বাস্থ্যগত তথ্য, বয়স, ধর্ম, ও রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতাবিষয়ক কোনো তথ্য পাবলিক করবেন না। একবার ভেবে দেখুন আমাদের চর্চায় ব্যক্তিগত তথ্যের বহরে আমরা কোন উচ্চতায় আছি! ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এবং আশৈশব পর্যবেক্ষণকৃত চর্চার ফসল হিসেবে যেটা অনুমান করি সেটা এমন, আলোচনার কেন্দ্রে যখন নারী তখন সেটা উপাদেয়, সহজপাচ্য এবং নিঃসন্দেহে আনন্দের খোরাক।

কানাডিয়ান সমাজে প্রাইভেসি সংক্রান্ত আইন ( PIPA) ছাড়াও অলিখিত অথচ, কঠোরভাবে পালনীয় সামাজিক রীতি রয়েছে, যেখানে ব্যক্তিগত প্রশ্ন করার বিষয়ে সকলেই সতর্ক থাকেন। সুতরাং আইনে বর্ণিত উপরোল্লিখিত সকল ব্যক্তিগত তথ্যাদি স্বল্প পরিচয়ে কিংবা প্রাথমিক পরিচয়ে কেউ আপনাকে সহসা জিজ্ঞেস করবেন না। যদি কেউ আপনাকে এ জাতীয় কোনো প্রশ্ন করেন সেক্ষেত্রে আপনি তাঁকে বলতেই পারেন, This is none of your business. সেটি আদৌ অভদ্রতার বিষয় বলে গণ্য হবে না। বরং প্রশ্নকর্তাই অনধিকার চর্চা করেছেন বলে লজ্জিত হবেন।

বাংলাদেশের সমাজে পরিবার কিংবা আত্মীয় ছাড়াও সমাজের যেকোনো ব্যক্তি আপনাকে আপনার বেডরুমবিষয়ক প্রশ্নও করতে পারেন অবলীলায়। এক্ষেত্রে জেন্ডার, পেশা, শিক্ষা-দীক্ষা, বয়স, ধর্ম কোনোকিছুই খুব বেশি প্রভাব ফেলে না। অন্যের ব্যপারে জানার কৌতূহল আমাদের জাতিগত বৈশিষ্ট্যের অংশ! বলাবাহুল্য অত্যন্ত সফলতার সাথে নারী সমাজই এ কর্মটিকে সুডৌল পারঙ্গমতায় এগিয়ে নিয়েছেন যুগপরম্পরায়। তবে পুরুষ ভ্রাতাগণও কিছুমাতা কম যান না এ বিষয়ে!

প্রাক-বিবাহ যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতার ঝুলি হাতড়িয়ে এমন অনেক অস্বস্তিকর গল্পের সন্ধান মেলে। উদাহরণ হিসেবে দুচারটে এখানে বলাই যেতে পারে, কাজের সূত্রে ইউএনও, সচিব, ডিসি মহোদয়দের সাথে নানা সময়ে মিটিং-সিটিং করতে হয়েছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ডিসির, ইউএনওর গেস্ট হাউজের অতিথিও হয়েছি জীবনে বহুবার।

প্রথম সাক্ষাতে দু’চার লাইন কাজের কথা শেষ হলেই আমার প্রতি অতি অবশ্যই উত্তরদানে বাধ্য নির্ধারিত প্রশ্নগুলি ছিল এমন, কোথায় থাকেন? একা এলেন এদ্দূর? এখনও বিয়ে করেননি? বাড়ি ছেড়ে এতদূর একা মেয়েমানুষের থাকা কি ঠিক? যার কোনটিরই জবাব দিতে আমি পেশাগতভাবে দায়বদ্ধ নই। অথচ প্রতিবারই সেইসব অস্বস্তিকর প্রশ্নের জবাব আমায় নিখুঁতভাবে মাথা নত করেই দিতে হয়েছে। একবার ভাবুন আমার পরিবর্তে কোনো ছেলে থাকলে তাঁকে কখনই এই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হতো না। প্রশ্নকারীদের পদমর্যদা উল্লেখ করে বোঝাতে চাইলাম- দেশের শীর্ষ মেধাতালিকাসম্পন্ন লোকজনের যখন কৌতূহলের মাত্রা এই তখন অন্যেরা কয়েক কাঠি এগিয়ে থাকবেন সে বিষয়ে আপনারা নিশ্চিত থাকতে পারেন।

স্বাভাবিক বয়সের তুলনায় খানিক দেরিতেই বিয়ে করে ভেবেছিলাম, এবার অন্তত একটা প্রশ্নের হাত থেকে পরিত্রাণ পেলাম! এবার নতুন প্রশ্ন, ছেলেপুলে ক’টি? দুলাভাই কী করেন? বিয়ে যখন করেছেন মন দিয়ে সংসার করুন। স্বামীর আয়ে সংসার চললে আপনার কাজ করার দরকারই বা কী? এরপর কন্যা সন্তানের জন্ম দিয়ে ভেবেছিলাম-এবার বুঝি রেহাই পাওয়া গেল! কিন্তু হায় ভগবান! একটি মাত্র সন্তান? তায় আবার কন্যা? আপনার আরেকটি সন্তান নেওয়া দরকার! বুঝলেন! অন্ততঃপক্ষে একটি পুত্র সন্তানের চেষ্টা করাতো ন্যয়ত কর্তব্য, আর তাও যদি না ভাবেন এই কন্যাটিরও একজন সঙ্গী চাই তো, সুতরাং নমো নমো করে এবারটি বিছানায় লেগে পড়ুন।

একবার ভাবুন, কে কখন সন্তান নেবে, কয়টি নেবে কিংবা কেন নেবে না এর সকল যৌক্তিক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ আপনার শুনতে হবে আপনার পরমাত্মীয়, প্রতিবেশী, অফিস কলিগ, কিংবা বস এর কাছে থেকে। বেডরুমও কি আলোচনার বাইরে থাকল কোনোভাবে? সেইসব সিদ্ধান্তও কি জনগণ দিয়ে দিল না!

সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন আসতে পারে মানুষ কেন অন্যের বিষয়ে এতো কৌতূহলী? আমার ধারনামতে, অনেকগুলো সামাজিক অপচর্চা, অপশিক্ষা কিংবা ঈর্ষার কারণে মানুষ অন্যের বিষয়ে অতিমাত্রায় আগ্রহী হয়ে ওঠে। সেগুলো হতে পারে এরকম;

১। শিক্ষার অভাব, খুব কাছের জন হলেও ব্যক্তিগত তথ্য কতটুকু জানায় অন্যের অধিকার রয়েছে সেই বিষয়ে নির্ধারিত সীমাজ্ঞান না থাকা। এটি পারস্পারিক সম্মানের বিষয় এই বোধ না থাকা।

২। নিজেদের জীবনের নানাবিধ জটিল সম্পর্ক তথা অশান্তির কারণে নিজেরা ভালো থাকতে পারি না বিধায় অন্য কারও বিষয়ে হাস্যরসাত্মক কিংবা মুখরোচক গল্প ফাঁদলে মনের অজান্তেই একধরনের তৃপ্তি পাওয়া যায় সম্ভবত।

৩। নিজেদের কাঙ্ক্ষিত সাফল্যে পরাজয়ের গল্পের সম্ভার; তখন অন্যের সফলতায় মানুষ হতাশা বোধ করে, কিংবা ঈর্ষা অনুভব করে, এটিও কুশিক্ষার ফসল।

৪। নারী সকল আলোচনায় যেহেতু দুর্বলের প্রতিভূ(!) সেখানে, নারীর ব্যক্তিগত বিষয় বলে কিছু থাকতে নেই। তার প্রেম, বিয়ে, সন্তান, চাকরি, শিক্ষা, এসবই পুরুষ নিকটাত্মীয়ের ( বাবা-ভাই-স্বামীর) সিদ্ধান্তে এবং পছন্দে হবে, সেটাই সামাজিক রীতি! সুতরাং এখানে প্রাইভেসি বিষয়টি অবান্তর।

৫। বিশেষ করে নারী যদি স্বাধীন চিন্তার অধিকারী হন, নিজেকে মানুষ ভাবতে চান, তা নিশ্চিতভাবে সমাজের চোখে একধরনের ধৃষ্টতা! নারীকে দমিয়ে রাখার জন্য তাঁর দুর্বলতম বিষয়গুলো যত বেশি নড়াচড়া করা যায় ততই আনন্দ, ততই বিনোদন।

উল্লেখ্য বিনোদন সংবাদ নামে আমাদের দেশের ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার শীর্ষস্থানীয় সংবাদ মাধ্যমগুলোতে যেধরনের গল্প প্রচার হয়ে থাকে তা একধরনের কুৎসা এবং মানুষের ব্যক্তিগত তথ্যদির ওপর হুমকিস্বরূপ। যদিও সেলিব্রেটিদের কিছুই প্রাইভেট নয়, সেখানেও নারী সেলিব্রেটিরা অতিমাত্রায় আক্রমণের শিকার। যা নিন্দনীয়।

আমরা যেমন জানিই না কোনটা ব্যক্তিগত আর কোনটাতে জনগণের প্রবেশাধিকার রয়েছে। তেমনি মানুষ কী শুনতে বা জানতে চায় কিংবা কতটুকু বললে নিজেকে হাস্যস্পদ, এবং বালখিল্য করে তুলব না সে বিষয়েও আমাদের যথেষ্ট অসচেতনতা রয়েছে বলেই মনে হয়। আজকাল ফেজবুকে আমরা এমন অনেক কিছু লিখি যা আমাদের প্রাইভেসিকে যথাযথ রক্ষা করে কিনা ভেবে দেখা দরকার। বেডরুম থেকে পরীক্ষা পাশের নম্বর ফর্দ কিছুই বাদ নেই এই তালিকায়।
নিজস্ব তথ্য প্রচার ও প্রকাশের স্বাধীনতা অবশ্যই ব্যক্তির নিজস্ব সিদ্ধান্ত। তবে, এই তথ্য অধিক প্রচারে নিজের গ্রহণযোগ্যতা কমার আশঙ্কা থেকে যায়, কখনও সখনও তা অন্যের মনোকষ্টের কারণও হতে পারে। সুতরাং ব্যক্তিগত তথ্য প্রচারে আরও বেশি যত্নবান হওয়া দরকার!

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বাংলাদেশের সংবিধানে বর্ণিত ব্যক্তির মৌলিক অধিকারের আওতায় ব্যক্তির ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষা তথা গোপনীয়তার দায় রাষ্ট্র গ্রহণ করেনি। যদিও ৪৩ এর (খ) এ চিঠিপত্র যোগাযোগ ও তাঁর গোপনীয়তা রক্ষার কথা বলা হয়েছে, যা অস্পষ্ট। উপরন্তু বহুল বিতর্কিত তথ্য ও প্রযুক্তি আইনে ডাটা সুরক্ষাকে প্রাধান্য দিয়ে ব্যক্তির ব্যক্তিগত তথ্য প্রচার ও প্রসারের অপব্যবহারই দেখেছে এযাবৎ দেশের মানুষ। যদিও আইন হলেই সকল সমস্যা অচিরেই দূরীভূত হবে না। জনসাধারণকে হতে হবে সুশিক্ষিত। তথাপিও এতদসংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিবর্গের কাছে বিষয়টি নিয়ে ভাবনার আহ্বান রেখে গেলাম।

পরিশেষে বলবো, যে সময়টা অন্যের ভেতর বাড়ি খুঁড়ছি, চলুন না সেই সময়টা নিজেকেই খুঁড়ি! দেখি নিজের ভেতরে কী কী সম্ভাবনা আছে, যা আপন আলোয় সমৃদ্ধ করে নিজেকে! যা হতে পারে পরচর্চার থেকেও অনেক বেশি নির্মল আনন্দের খোরাক।

সঙ্গীতা ইয়াসমিন
টরন্টো, কানাডা।

শেয়ার করুন: