ভাতঘুম

রুমানা সোবহান পরাগ:

দুপুরের ভাত ঘুমটা আমার ভীষণ প্রিয়। সেই সুবহে সাদিকে উঠে পরি। তারপর থেকে তো চরকিতে উঠে নাচি। নাস্তা বানাই, বিছানা গোছাই। বাচ্চাদের নিয়ে স্কুলে যাই। জিমে যাই। বাসার এসে বুয়ার সাথে হেঁসেল সামলাই। তারপর আবার বাচ্চাদের স্কুল থেকে নিয়ে আসি। দুপুরের খাবার টেবিল রেডি করি। খাওয়া শেষে বাচ্চারা যখন ঘুমায় তখন আমার একটু শান্তি হয়। কারণ তখন আমিও একটু ঘুমাতে পারি। দুপুরের এই এক ঘন্টা না ঘুমালে আমার প্রচণ্ড মাথা ব্যথা হয় । সন্ধ্যাটাই বরবাদ হয়ে যায় বলতে গেল।

সেদিনও কেবল পিঠটা বিছানায় ঠেকিয়েছি এর মধ্যেই কলিং বেল বেজে উঠল। সবে মাত্র খাবার টেবিলে মুছে শুতে আসলাম। আহারে, এগুলো সহ্য হয়! এই বৃষ্টির মধ্যে আবার কে আসল।হয় পাশের ফ্লাটের ভাবী আড্ডা দিতে এসেছে আর না হয় ময়লাওয়ালি মাসের বিল নিতে এসেছে। আর তো কারো আসার কথা না। থাক চুপ করে শুয়ে থাকি, পাঁচ মিনিট দাঁড়িয়ে থেকেই চলে যাবে।

কিন্তু বেল বেজেই যাচ্ছে। মানুষের আজকাল কমন সেন্সের বড্ড অভাব। এভাবে সময় জ্ঞান না করে কেউ অন্যর বাসায় যখন তখন আসে! আর আমার পুত্র কন্যারা তো এক এক জন লাট সাসেব। বাসায় ডাকাত পরলেও বিছানা থেকে তারা নামবে না। ওদেরই বা দোষ দিয়ে লাভ কি, স্বয়ং আল্লাই তো আমার কপালে সুখ রাখেন নাই ।যাই দরজা খুলি গিয়ে।

বিরক্ত নিয়ে ওড়না ঠিক করতে করতে গেটের কাছে গেলাম। এমা! একি! শুপ্তি কেন আসছে এখন?

এই তুই একা আসছিস?

‘হুম।

‘ক্যান? ‘

‘আমার ইচ্ছা। ‘

‘মেয়েকে তো সাথে করে আনতে পরতি।’

‘বলছিলাম ওকে। বলে মামার বাসায় ওর ভালো লাগেনা। তোমাদের বাসার সবাই চুপচাপ থাকো। ওর আবার হৈ হুল্লোড় ছাড়া ভালো লাগেনা।’

‘ও আচ্ছা, চল ভেতরে চল। টেবিলে ভাত দেই, হাত মুখ ধুয়ে আয়।

না ভাবী, এখন আর ভাত খাবো না। তোমার হাতের চা’টা ফার্স্ট ক্লাস হয়। তুমি এক মগ চা দাও তো।’

‘দুইটা পরোটা ভেজে দেই? মিষ্টি দিয়ে খা। তুই তো আগে খুব পছন্দ করতি।’

‘আচ্ছা দাও, বলে শুপ্তি ওয়াশরুমে চলে গেল। এরকম শান্ত স্বরে কখনও শুপ্তি কথা বলেনি। প্রতিবারই এসেছে হয় ঝগড়াঝাঁটি করে কাঁদতে কাঁদতে চোখ মুখ ফুলিয়ে বা স্বাভাবিকভাবে। কিন্তু কেন যেন মনে হচ্ছে আজকে ভয়ংকর কোনো গণ্ডগোল পাকিয়ে এসেছে।

আমার বিছানাতেই খাবার দিলাম। আমি আধশোয়া হয়ে ওর খাওয়া দেখছিলাম। মনে হচ্ছে খায়নি বহুকাল। মুখের খাবার শেষ হবার আগেই খাবার পুরে দিচ্ছে। আহারে। আহারে বলেও লাভ নেই, ওর মতো স্বাধীনচেতা, বদমেজাজি, জেদি মেয়ের সংসার হওয়া মুশকিল আছে।

এই তোকে আর একটা পরোটা ভেজে দিই?

না ভাবী, খুব ক্ষুধা লাগছিলো, তাই কপাকপ খেলাম। তুমি চা আনো।

শুপ্তি আর আমি প্রায় একই বয়সী। সম্পর্কে বড় ভাইয়ের বউ বলে আমি একটু গম্ভীর আচরণ করার চেষ্টা করি সবসময়, কিন্তু ও সেটা মানেই না। টিপিক্যাল ননদের মতো আচরণ না করে বরং বন্ধুর মতোই আচরণ করে।

এখন বল তো এভাবে আসলি কেন?’

‘ভাবী, আমি একেবারেই চলে এসেছি। ‘

‘আবার কী হলো?’

‘তোমার মতো এরকম গরু-ছাগলের জীবন আমি যাপন করতে পারবো না, তাই আসছি।’

‘হেসে বললাম, গরুর কাছেই তো আসছিস। তাহলে এতো অহংকার কীসের!’

‘গরুর কাছে আসিনি ম্যাডাম। আসছি আমার ভাইয়ের কাছে, আর তুমি আমার ভাইয়ের গৃহপালিত গরু। গরু বললাম কারণ তোমার নিজস্ব কোনো ব্রেন নাই। তোমার ব্রেনের উপর আমার ভাইয়ের পুরো কন্ট্রোল।

‘এভাবে অসম্মান করে কথা বললে কেউই তোকে পছন্দ করবে না, সে যেখানেই থাকিস না কেন।’

‘ভাবী, অন্যকে খুশী করার এই বৈশিষ্ট্যগুলো তুমি এডাপ্ট করছো, ভালো কথা, আমাকে শিখাতে এসো না। স্লেভ মাইন্ডেড জীবন আমি কল্পনাও করতে পারি না। এই ১০ বছর আমি ভুল করছি তোমাদের মতো মানুষের কথা শুনে। আর একটা মুহূর্তও আমি পরনির্ভরতার জীবনযাপন করতে পারবো না। ‘

‘কী বলছিস এগুলো? মাথাটা কি পুরাই খারাপ হয়ে গেল? তোর বা আমার কারোরই মা খালা, চাচী, ফুপু তো ঘরের বাইরে কাজ করেননি। তাহলে তারা কি সংসারে অসম্মানিত হয়েছিলেন? গুছিয়ে সংসার করাও একটা আর্ট; সবাই তা পারে না। আর আমি সংসারের কাজ ভীষণ এনজয় করি। কারণ এখানে আমিই আমার বস। আমিই সবকিছুর হেড। এমনকি তোর ভাইয়া কবে কোন শার্ট পরবে সেটাও আমি ঠিক করে দেই।’

হাসালে ভাবী! এ সংসার তোমার? এখানে কী কী তোমার বলো তো! আচ্ছা সেটা বলতে হবে না, তুমি বলো, ভাইয়া কোন শার্ট কোন দিন পরবে সেই সিদ্ধান্ত নেওয়া ছাড়াও আর কী কী সিদ্ধান্ত তুমি নাও?

দেখ শুপ্তি, আমাকে হুট করে জেরা করলে আমি কথার খেই হারিয়ে ফেলি। সময় দে, মনে করে করে সব বলছি। তোর ভাই আমাকে সব কিনে দেয়। হাত খরচের জন্য ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড দিয়েছে। টাকা চাইলে দেয়। তারপর সে প্রচুর কেনাকাটা করে আমার জন্য। ভালোবাসে বলেই তো করে। আর কী কী জানতে চাস?

সেরকম খরচ তো তুমিও ময়না বুয়ার জন্য করো খুশি হয়ে। তোমার সাধ্যমতো। ভাইয়া যেমন খুশি হয়ে তোমাকে দেয় তুমিও তেমনি খুশি হয়ে ময়না বুয়াকে দাও। আর তুমি তো আমার প্রশ্নের উল্টাপাল্টা জবাব দিলে! আচ্ছা বলতো, ভাইয়ার বেতন কত?

আমি কখনও জিজ্ঞেস করিনি।

কেন করোনি? এই সংসার তো তোমারও। তাহলে এখানে কত টাকা আসছে, তা তুমি জানোনি কেন?

আমার জানার দরকার হয়নি, তাই।

তুমি চাকরি কর না কেন ভাবী?

‘আমার ভালো লাগে না। তাছাড়া আমার প্রয়োজন হয়নি, তাই চাকরি করি না।’

‘এই রকম স্বেচ্ছাচারী আচরণ তো তুমি করতে পারো না। তোমার এই ঘর-গৃহস্থালি কাজের জন্য তো বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রী লাগে না। তুমি জানো চার বছরের একজন শিক্ষার্থীর পেছনে রাষ্ট্রের ব্যয় হয় প্রায় দশ লাখ টাকা। এই টাকাটা তুমি নষ্ট করলা কেন? তুমি যদি ঘর গৃহস্থালির কাজই করবে তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা সিট তোমার নষ্ট করা ঠিক হয়নি। তোমার জায়গায় একটা ছেলে যদি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তো তাহলে সে তার এই সার্টিফিকেটের মূল্য দিত। পড়ালেখা করে পরিবারের খরচ বহন করার সক্ষমতা অর্জন করতো। বাংলাদেশের মতো একটা দরিদ্র দেশে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা সিটের মূল্য অনেক। কে কী করবে সেটা তার একান্ত, তার পারসোনাল চয়েস। আর সেভাবেই নিজেকে তৈরি করা উচিত। আমি মোটেই গৃহকর্মে এনগেইজ থাকাকে ছোট করে দেখছি না। আমার কথা হচ্ছে দায়িত্ববোধের জায়গা থেকে প্রত্যেকেরই কিছু না কিছু অর্থনৈতিক কাজের সাথে সম্পৃক্ত থাকা উচিত। এখন আবার তুমি ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা দিও না। ইসলামের ইতিহাস পড়লে জানতে পারবে বহু মুসলিম নারী ব্যবসা-বাণিজ্য করতেন তাদের সংসারের কাজের পাশাপাশি। তাদের কথা কিন্তু কেউ বলে না। উল্টো বলে, একজন নারী বাপের সম্পত্তি, স্বামীর সম্পত্তি পেয়ে অনেক বড়লোক। একজন নারী যদি অনলাইনে কাপড় বিক্রি করেন বা আখের গুড় বিক্রি করেন, তাকে তোমরা অসম্মান করো। অথচ তিনি ঘর সামলে সাবলম্বী হবার চেষ্টা করছেন। এটা যথেষ্ট সম্মানের কাজ। অন্যদিকে এক থেকে দুইটা বুয়ার উপর ভর করে তোমরা যারা সংসারের কাজের কথা বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলে ফেলো তাদের দেখে সত্যিই আমার করুণা হয়। তোমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিটাকে একটা অলংকারের মতো ব্যবহার করো। একটা প্রতিষ্ঠিত ছেলের গলায় লটকে পরার উদ্দেশ্যেই মনে হয় এই ডিগ্রী নিয়েছো। আর এখন বলছো, ভালো লাগে না তাই চাকরি করছি না।

আমার তো মনে হয় ভাইয়া সংসারে অশান্তি করবে সেই শংকায় চাকরি করার কথা বলার সাহস পাওনি তুমি। আর সেটা ঢাকার জন্য বলছো ভালো লাগে না!’

‘আচ্ছা ভাইয়া কোন কোন খাতে টাকা ব্যয় করে তা জানো তো? কয়টা ক্লাবের মেম্বার? কোথায় জায়গা কেনে বা ফ্লাট কেনে তা তোমার সাথে শলাপরামর্শ করে কেনে, নাকি তোমাকে জানায়ও না? ‘

অতসব জানি না। তবে একটা কথা বলি, সে এতো পরিশ্রম করছে তো আমাদেরই জন্য। আর তাছাড়া তোর ভাই সবকিছুতেই আমাকে সমান শেয়ার দেয়। আলাদা করে জানার কিছু নাই। আমার নামে ব্যাংকে ডিপোজিট করে, সঞ্চয়পত্রের নমিনি করে। অরনামেন্ট কিনে দেয়। আর কী দরকার রে একটা মেয়ের?’

‘তোমার ধারণা ভুল। সে পরিশ্রম করে, কারণ তার সামাজিক মর্যাদা দরকার। তোমার নামে সবকিছু কেনে ট্যাক্স ফাঁকি দেবার জন্য। আর তোমাকে যেসব কার্ড দিয়েছে, তার সবই তো স্পাউস কার্ড। যাতে তুমি কোথায় কতো খরচ করো তার হিসেব রাখতে পারে। এই সংসার যদি তোমার হতো তাহলে তো সব বড় বড় বিষয়ে তুমিই ডিসিশন নিতে। তা কি নাও? বড় বড় ডিসিশন বাদ দাও। সামান্য কয়টা যাকাতের টাকা তোমার চাচীকে দেয়ার জন্য তুমি ভাইয়ার কাছে কতই না ধরনা ধরেছিলে; মনে নাই? ভাইয়া তো ঐ ঈদে সব যাকাত আমাদের গ্রামে পাঠালো, তুমিই নিজেই তো ফোনে আমাকে সব জানিয়েছিলে সেবার। তাহলে এটা তোমার সংসার হয় কীভাবে? ভাইয়া তো গরীব না, তাহলে এমন ব্যবহার সেদিন কেন করেছিল, একবার ভেবেছিলে? আসলে তুমি তার উপর পুরোপুরি অর্থনৈতিকভাবে নির্ভরশীল বলেই তোমার কথার গুরুত্ব কম তার কাছে। আজকে তুমি যদি নিজে ইনকাম করতে তাহলে ভাইয়ার কাছ থেকে এই টাকাটুকুও চাইতে হতো না।

তোমার মতো মেয়েরা যারা স্বামী সোহাগে গরবিনী স্ত্রীর রোল প্লে করো, সমাজে একটা সুখী সুন্দর জীবনের চিত্র তুলে ধরো, তারা স্রেফ এক একজন অভিনেত্রী। তোমরা পার্লারে গিয়ে স্পা করো, আর ঘরে এসে জ্বি হুজুর জাঁহাপনা করো। তোমাদের কাজ হচ্ছে স্বামীর কামাই খেয়ে বাইরে ফুটানি করা, আর ঘরে স্বামীর মন বুঝে চলার চেষ্টা করা। বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতর ডিগ্রী থাকার পর নামের আগে শুধু গৃহবধু এই পরিচয় দিতে তোমাদের লজ্জা হয়। আর এই লজ্জা ঢাকার জন্য স্বামীর কাছে হাত পেতে টাকা নিয়ে তোমরা সোশ্যাল ওয়ার্ক করো।’

‘আচ্ছা, তুই তো তোর সমস্যা নিয়ে আসছিস, তাহলে আমার পিছে পড়লি কেন? তোর সংসারে কী হয়েছে, সেটাই বল। দেখি কোনো সমাধান দিতে পারি কিনা!’

‘ভাবী, প্লিজ তুমি মনে কষ্ট পেওনা আমার কথায়। আমি তোমাকে অপমান করার জন্য এগুলো বলিনি। জাফর সারাক্ষণ তোমার উদাহরণ টেনে কথা বলে। সবকিছুতে তোমার মতো হবার কথা বলে। আর আমি মন থেকে তোমার মতো জীবনযাপন করতে পারবো না কখনোই। আমি স্বাবলম্বী হতে চাই। আমি মানুষের মর্যাদা নিয়ে বাঁচতে চাই। এখন তুমি বা আমি যে জীবন যাপন করছি তা অসম্মানের। আমি স্বামীর দেয়া হাতখরচে জীবন পার করতে পারবো না, কারণ আমার উপার্জন করার মতো শিক্ষা আর দক্ষতা আছে। মা-খালাদের উদাহরণ তুলে কোনো জ্ঞান দিও না প্লিজ। ওনারা অনেক পরিশ্রম করেছেন সংসারে এবং অনেক নিগৃহীতও হয়েছেন। আত্মীয়-স্বজন, পাড়া প্রতিবেশীর আর গল্প উপন্যাসে তাদের নিগৃহীত জীবনের ভুরি ভুরি উদাহরণ আছে। গৃহবধু হওয়াকে আমি অসম্মান করছি না, তবে প্রত্যেকেরই অল্প হলেও কিছু আয় উপার্জন করা উচিৎ। তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে ঘরে বসেই অনলাইনে হাতে বানানো সবকিছুই বিক্রি করা যায়। গান, নাচ, রান্না, ছবি আঁকা শেখানো যায়।

দেখো, আমার নিশ্চয়ই ভালো লাগতো না জাফরকে বলতে যে ভাইয়ের বাসায় যাচ্ছি, কিছু টাকা দাও। আমি বাচ্চাদের জন্য এটা-সেটা কিনে নিয়ে যাবো। আমি জানি জাফর কখনই না করতো না। কিন্তু আমার আত্মসম্মানে বাধে হাত পেতে টাকা নিতে। নিজেকে ভিক্ষুক ভিক্ষুক মনে হয়। আমি যদি মূর্খ হতাম তাহলেও হয়তো এইভাবে স্বামীর কাছ থেকে হাত পেতে টাকা নিতে পারতাম না। সেলাই ফোঁড়াই করে বা যুব উন্নয়ন থেকে একটা কোর্স করে জীবিকা নির্বাহ করতাম সংসারের কাজের পাশাপাশি। আর সেখানে তো আমি উচ্চশিক্ষিত। আমার মনটা কারো কথায় উঠতে বসতে চায় না ভাবী।

এছাড়া জাফরের জীবনের উপর আমি যেমন কোনো নিয়ন্ত্রণ রাখি না, তেমনি আমার জীবনের উপরও যেন জাফরের কোনো হস্তক্ষেপ না থাকে সেটা আমি চেয়েছিলাম। আমার কাছে সংসার মানে পারস্পরিক সহঅবস্থান। কারো ওপর কারো কর্তৃত্ব না।

প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করা জাফরের পছন্দ না, অনলাইনে ব্যবসা করা জাফরের পছন্দ না। সে আমার কাজের জায়গা ঠিক করে দেয়! একজন শিক্ষিত মেয়ের জীবনের সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার কি অন্য কারো আছে? আমার জীবনের ওপর অন্যের কর্তৃত্ব আমি মানতে পারি না। আর যেখানে আমাদের দুজনের যোগ্যতাই সমান, সেখানে একে অপরের উপর নির্ভরশীল হওয়ার তো কোনো প্রশ্নই ওঠে না।

আমি এবার ঝগড়া করে আসিনি। আমি শুধু আমার জীবনটা আমার মতো করে কাটাতে চাই। আর কিচ্ছু না। প্রথমে কিছুদিন তোমাদের কাছে থাকবো। তারপর চাকরি হলে একটা ফ্লাট ভাড়া নিয়ে চলে যাবো।’

‘বাচ্চাটার কী হবে ভেবে দেখেছিস একবার?’

‘ভাবী, মানুষ মাত্রই ভুল করে। আমিও করেছিলাম। ভূত-ভবিষ্যত না ভেবে গর্ভধারণ করেছিলাম। এখন যদি এই সম্পর্ক কন্টিনিউ করি তাহলে আরও বড় ভুল হবে। আমার মেয়েটার সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা কোনো দিনই তৈরি হবে না। আর আমি তো চেষ্টা করেছিলাম সংসারের পাশাপাশি নিজের একটা পরিচয় তৈরি করার। আর এটাই আমার কাল হয়েছে। জাফরের একটাই কথা, ওর সংসারে থাকতে গেলে এসব স্বপ্ন মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে হবে।’

আমি শুপ্তির দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভেবেছিলাম, আসলেই তো ওর আর আমার মাঝে যোগ্যতায় কোনো পার্থক্য নাই,পার্থক্য শুধু মন-মানসিকতায়। আমার মতো পরনির্ভরতার মনোঃবৃত্তিকে ও ধারণ করতে পারেনি। সবাই সবকিছু পারে না। যেমন আমি পারি না। আমার নিজের কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা নেই। কোনকিছু পছন্দ না হলেও পরিবেশ নষ্ট হবার ভয়ে জোর দিয়ে নিজের মতামতকে প্রকাশ করতে পারি না আমি।

বুকের ভেতরে দীর্ঘশ্বাসকে আটকে রেখে সন্ধ্যা বাতি জ্বালাতে উঠে পড়েছিলাম। দুপুরের ভাতঘুমটা না হওয়ায় মাথাটা প্রচণ্ড ধরেছিল সেদিন। ইদানিং অবশ্য আর আগের মতো ভাতঘুমের নেশা নেই আমার। দুপুরে শুই ঠিকই, এপাশ-ওপাশ করে আবার খানিক বাদে উঠে পরি।

আজকে শুপ্তির কথা বড্ড মনে পড়ছে। শুপ্তি এখন একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে ডিরেক্টর পদে কাজ করছে। জাফরের সাথে ডিভোর্স নিয়েছিল। এরপর এমন একজন জীবনসঙ্গী সে বেছে নিয়েছিল যে ওর চলার পথের বাধা হয়নি। জাফর আর ওর মেয়েটা বাবা-মায়ের দুটো আলাদা সংসারেই এডজাস্ট করে নিয়েছে।

শুপ্তি যেভাবে জীবনটাকে সাজাতে চেয়েছিল ঠিক সেভাবেই সাজাতে পেরেছে। আর আমি এখনও সেই চার দেয়ালের মাঝেই ঘূরপাক খাচ্ছি; সকলের মন বুঝে চলছি।

এই এক জীবনে তো আর নিজের জীবনটা যাপন করতে পারলাম না, তবে অপেক্ষায় আছি সেই দিনের যেদিন আমার এই দেহটা এই পরজীবী পরগাছার জীবন থেকে মুক্তি পাবে। সেদিন শুধু ভাতঘুমের মুক্তি নয়, চির মুক্তি পাবে আমার এই দেহটা দ্বিতীয় শ্রেণির মানবজীবন যাপনের হাত থেকে।

শেয়ার করুন: