প্রগতিমনষ্ক মেয়েদের জীবনে যে বঞ্চনাগুলো প্রাপ্য

সুচিত্রা সরকার:

একজন আটপৌরে আর সাবেকী চিন্তার মেয়ের জীবন।
কেমন সে জীবন? জন্ম দিয়েই বাবা- মা মনে করলো, এ মেয়ে পরের ঘরের। আমাদের দায়িত্ব সেই পর্যন্ত প্রতিপালনের।
সুতরাং যত্ন করো প্রচুর, যদি সে যত্ন আর না পায়!
অথবা, একটুও যত্ন কোরো না।
ও পরের! ওকে যত্ন করা বৃথা শ্রম। সুতরাং ঘরের ছেলেদের পুরো যত্ন ঢেলে দাও। পুরো সম্পত্তি। পুরো ভালবাসা।
সাবেকী চিন্তার বা সাধারণ মেয়েটি কী করবে? হয়তো সে মনে করবে, নারীভাগ্য এমনই। যা পাচ্ছি, তাই সই।
অথবা ধরে নেবে, মেয়েদের জীবন এমন হয়েই থাকে। সুতরাং স্বামীগৃহেই সুখ আর অবারিত শান্তি। এখান থেকে যা পাবো, তা উপরি!
আর উপরি মানেই তো, বেতনের বাইরের আয়। যতটা চেটেপুটে নেয়া যায়।

অথবা পিতৃগৃহের যাবতীয় বঞ্চনা সহ্য করে দিনাতিপাত করবে মেয়েটি। স্বপ্ন দেখবে স্বামী সোহাগ আর কোমল ভবিষ্যতের।
সমাজে গুটিকয় মেয়ে জন্মের পরের এই পরিস্থিতিতে খাপ খাওয়াতে পারে না। অবহেলা, বঞ্চনা, অধিকার কম বা অধিকার না থাকাটা মেনে নিতে পারে না। সে পরিবারে থেকেই অন্যায় দেখিয়ে দেয়, আওয়াজ তোলে।

আজকের কথা, কেবল এই মেয়েদের জন্য। কারণ এদের কথা কেউ বলে না।

প্রথমে পরিবার বিরক্ত হয়, মেয়েটির চিন্তার ভুল ধরিয়ে দেয়। অথবা গর্জে ওঠে।
দিনে দিনে দু পক্ষের লড়াইয়ে ক্লান্ত হয়ে মেয়েটি বিদায় নেয়।
মা বাপ হাঁপ ছেড়ে বাঁচে।
বাপরে! কী বাঁচা বেঁচে গেছে এরকম মেয়েকে পার করে! যে ভাইদের বেশি খাওয়া, বেশি পাওয়া দেখতে পারে না, সে গেছে, হাড় জুড়ালো!
সে নিজের প্রাপ্য বুঝে নিতে চায়, কী অন্যায় আবদার! কী হিংসুটে।
বেয়াদপটা জানে না, এ সংসারে তার নিজের বলে কিছু নেই। সমান অধিকার বলে কোনো বস্তু এ জগতে তার জন্য নয়।

এর মধ্যেও ছোট্ট একটি দৃশ্য ঢোকানো যায়। অনায়াসে। যদি তার একজন প্রেমিক থাকে। যদি সে প্রেমিকের সঙ্গে ন্যায্য-অন্যায্যের লড়াই বজায় রাখে!
মুশকিল এখানেও।
অথবা প্রেমিককে প্রতিপালন করে একজন প্রগতিমনষ্কের মতো? আর প্রেমিকটি যদি প্রগতিশীল না হয়?
পোয়া বারো নয়। একেবারে সাড়ে ষোলো আনা। একে তো মেয়েটির দ্বারা লাভবান। দুইয়ে, মেয়েটির দায়- দায়িত্ব নিতে হয় না। প্রেম জীবনের নানান খাঁজে আর বাঁকে এরকম টুকরো ছবি।
অত:পর যা হবার তাই।

এই জীবনেও মেয়েটি দেখে, তার চিন্তা থেকে যে সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে, প্রেমিকটি তা আকণ্ঠ পান করলো। আর বিপরীতে ‘তোমার মত মেয়েরা’ স্বাভাবিক না, এমন তকমা জুটলো।

আর দ্বিতীয় জীবনে? বিয়ের পর? শ্বশুরবাড়িতে?
সে যেহেতু মনে করে, সে বংশগতির বরাতে মা-বাবার মেয়ে, সুতরাং তাদের জন্য দরজা তার খোলাই রইলো। রইলো বিবেক। রইলো মমতার হাত!
অন্যদিকে মানিয়ে নেবার চিরাচরিত গল্পটি তো আছেই। বিয়ের পর কিছুটা মানিয়ে বা পুরোটা মেনে নিতে চেষ্টা করলো বা পেরে গেল।
স্বামী সেবা, শ্বশুরবাড়ির সদস্যদের যত্ন, খেয়াল আবদার। সব সে পারলো।
একশতে একশ। এবার যদি সে চায় একই রকম সেবা, যত্ন, আবদার?
আরেহ! পাগল নাকি? বউকে যত্ন, সেবা? বউয়ের অধিকার? এসব হয় নাকি?
বউদের এসব পেতে নেই। মেনে নাও।
মানিয়ে তো নিয়েছো ষোলো আনা। সুতরাং সাধারণ মেয়ের মতো এবার এটাও মেনে নাও, তুমি জন্মেছো ‘ সার্ভিস’ দেবার জন্য। পাবার জন্য নয়।

আর যে মেয়েটি পারলো না মানতে, মানাতে আর মেনে নিতে?
ভুল বলছি, মেয়ে সম্বোধন বড় ভুল এই জীবনে। এই জীবনের নাম ‘বউজীবন’!
এই মানিয়ে না নেয়া বউটি বদমাশ, ঘাড়ত্যাড়া আর শয়তান।
বরের জীবন, শ্বশুরের ঘর- সব জ্বালিয়ে পুড়িয়ে একাকার করে।

কেমন সে জ্বালানো? হয়তো, সেই অধিকার চাইতে যাওয়া? অর্থনৈতিক অধিকার বা সামাজিক অধিকার। অথবা ‘বউজীবনের’ বঞ্চনাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা?
যা শ্বশুরবাড়ি বা সমাজের চোখে অন্যায়। ঘোরতর।

এদিকে ঈশ্বর মহাশয় একটি দাবার চাল মেয়েটির জন্য দিয়ে রাখে।
খুব সরল অথবা অন্যদিক থেকে দেখলে খুব জটিল সে চাল।
তুমি তো নারী অধিকারের কথা বলো। তুমি তো স্বাধীনচেতা। প্রগতিশীল। সময়ের আগে জন্মানোর পাপ তুমি করেছো।
আটপৌরে মেয়েরা শ্বশুরবাড়িতে, স্বামীর কাছে যা চায়, তুমি কেন চাইবে?
আটপৌরে অবলা মেয়েরা যেসব সুবিধা পেয়ে অভ্যস্ত, কেন দাবি করবে সেগুলো?
এ অসম্ভব! এ তো দুই নৌকায় পা! একদিকে চাইছো নারী স্বাধীনতা। অন্যদিকে চাইছো কেউ, তোমার জন্য করুক? কী হাস্যকর! কী জটিল তুমি!

ঈশ্বর বলেন, তুমি বেছে নিয়েছো, প্রগতির পথ, লড়াইয়ের পথ।
অবলা, অচলা নারীরা যা চায় এ সমাজে, সেটার ব্যবস্থা আমি করেছি। নারী-পুরুষের বেঁচে থাকার ভারসাম্যের জন্য।
তোমার জন্য এ নয়। তুমি যাও। ফোটো এবার!

কিছু করার নেই। ঈশ্বরের থেকে, সমাজের থেকে ‘যাও ফোটো’ আদেশ নিয়ে চলে তার জীবন। আর ভেতরে ভেতরে দ্বিখণ্ডিত, তৃখণ্ডিত হয়ে, নারী জীবনের বঞ্চনা আর অধিকারের গান গাইতে গাইতে সে ঈশ্বরের তৈরি করা দৃশ্যপট থেকে সে বিদায় নেয়। কারণ ব্যকরণ তো বলে, নিপাতনে সিদ্ধ যে জিনিস, তাকে সকলের সঙ্গে এক করলে চলে না। এসব আগাছাদের ভিড়ে, অন্যরা বিগড়ে যেতে পারে।

সুতরাং প্রগতিমনষ্ক জীবন পুরুষের জন্যই ভালো। নারীর জন্য এ কেবল শাঁখের করাত!

শেয়ার করুন: