‘গণদেবতা’র দূর্গা: স্বৈরিণী, না বিপ্লবী?

ইশরাত জাহান ঊর্মি: 

প্রথম মহাযুদ্ধের গুমো আঁচে পোড়া ভারতবর্ষের এক নিভৃত গ্রাম শিবকালিপুরের গল্প হলো “গণদেবতা”র প্লট। এই বাক্যটি বহুক্লিশে হতে পারে, কিন্তু বিশ্বাস করুন, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্স্ট ইয়ারে যখন প্রথম পড়েছি ‘গণদেবতা’, আমার তখনই মনে হয়েছে, এই উপন্যাসের নায়ক দেবু ঘোষ বা অনিরুদ্ধ বা নজরবন্দী যতীন বা অন্য কেউ-ই না, আসল নায়ক “সময়”।

মানুষের যেমন ভালো-খারাপ থাকে, দ্বিধা আর পরিবর্তন থাকে, প্রেম আর অপ্রেম থাকে, ‘গণদেবতা’য় যে সময়টার কথা বলা হয়েছে, সে সময়টা্রও ঠিক মানুষেরই মতো এসমস্ত আছে। ১৯২৬ সালে লেখা এই উপন্যাস। প্রায় একটা দশকের গল্প আছে এতে।

গ্রাম তখন দ্বিধান্বিত ভাঙছে, বদলে যাচ্ছে আচার-সংস্কার। যা ভাঙছে, তা কি ভাঙাই উচিত ছিল? আর যা গড়ে উঠছে, তা কি সঠিক গড়ে উঠছে?-রাজনৈতিক কর্মী এবং লেখক তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই গণদেবতার নানান চরিত্রর মধ্যে ঢুকে সেসব প্রশ্ন করেছেন। আমার কখনই মনে হয়নি সেসব প্রশ্ন নজরবন্দী যতীনের, অনিরুদ্ধ কামারের বা দেবু ঘোষালের।

এইখানে বারবার তারাশংকর যেন নিজেই নিজের দ্বিধা আর বিভ্রম নিয়ে ঢুকে পড়ছেন উপন্যাসে। আরেকটা শ্রেণী খুব সুন্দর ফুটিয়ে তুলেছিলেন তিনি এই উপন্যাসে। যুদ্ধের সময় সুযোগসন্ধানী যে শ্রেণীটি অনেকের সম্পদ কেড়ে নিয়ে ভুঁইফোড় বড়লোক হয়ে ওঠে -সেই শ্রেণী যারা ছিরু পাল থেকে শ্রীহরি পাল হয়-যাদের গাঁয়ের লোক সম্মান করে না, কিন্তু তাদের পয়সার ঠাঁটে সামনাসামনি কিছু বলতে ভয় পায়। এই ভুঁইফোড়, মধ্যসত্ত্বভোগীদের আমি প্রথম দেখতে পাই শ্রীহরির মধ্য দিয়ে।

বাংলাদেশের যমুনা, বসুন্ধরা ইত্যাদি ইত্যাদি শ্রীহরিকে যেন তারাশংকর আরেকটা যুগে বসেই স্পষ্ট দেখতে পেয়েছিলেন। যাই হোক বিশাল প্লটের এই উপন্যাস নিয়ে নয়, আমি তারাশংকরের স্বৈরিণী দূর্গাকে ধরতে চেষ্টা করছি। যুদ্ধ, যেকোনো যুদ্ধই নারীকে আরও ভালনারেবল করে তোলে। তারাশংকর তাঁর এই উপন্যাসে আরও অনেক অনেক পুরুষ লেখক এর মতো নারীকে ভাগ করেই দেখিয়েছেন।

ইশরাত জাহান ঊর্মি

সতী, কপালে সিদুঁর জ্বলজ্বল করা, স্বামী সোহাগী দেবু ঘোষাল এর বউ বিলু, অনি কামারের বউ লম্বা-চওড়া, সারাদিন নি:শব্দে কাজ করা, শক্ত-সমর্থ সন্তানহীনা, স্বামীর একনিষ্ঠ হিতাকাঙ্খী, এমনকি শ্রীহরির কামনার চোখকে উল্টো চোখ রাঙানো পদ্ম আর স্বৈরিণী দূর্গা। অন্য নারী চরিত্রের জন্য অনেক বিশেষণ ব্যবহার করতে হলেও দূর্গার জন্য বিশেষণের দরকার নেই। সে কারো বউ নয়, সে পতিতা।

ছোট জাতের মুচিঘরের মেয়ে সে। তারাশংকর লিখছেন, দূর্গা বেশ সুশ্রী সুগঠন মেয়ে। তাহার দেহ পর্যন্ত গৌর, যাহা তাহাদের স্বজাতির পক্ষে যেমন দুর্লভ, তেমনি আকস্মিক। ইহার উপর দূর্গার রূপের মধ্যেও এমন একটা বিস্ময়কর মাদকতা আছে, যাহা সাধারণ মানুষের মনকে মুগ্ধ করে, মত্ত করে-দুর্নিবারভাবে টানে। পাতু (দুর্গার বড় ভাই) নিজেই দ্বারকা চৌধুরীকে বলিয়াছিল, আমার মা-হারামজাদীকে তো জানেন। হারামজাদীর স্বভাব আর গেল না!”

দূর্গার রূপের আকস্মিকতা পাতু-দুর্গার মায়ের সেই স্বভাবের জীবন্ত প্রমাণ। দূর্গারা যে সমাজের মানুষ সে সমাজে নারীদের স্বৈরিণী হতে বাধা নেই। একটু-আধটু উচ্ছৃঙ্খলতা স্বামীরাও মেনে নেয়। বিশেষ করে সেই উচ্ছৃঙ্খলতা যদি বড়লোক কোন পুরুষের সাথে সম্পর্কিত হয়, তবে তারা “বোবা হইয়া যায়”। কিন্তু দূর্গা এইসবকে ছাড়িয়ে গিয়েছে।

“সে দূরন্ত স্বেচ্ছাচারিণী; উর্ধ্ব বা অধ:লোকের কোনো সীমাকেই অতিক্রম করিতে তার দ্বিধা নাই। নিশীথ রাত্রে সে কঙ্কনার জমিদারের প্রমোদভবনে যায়, ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্টকে সে জানে; লোকে বলে দারোগা হাকিম পর্যন্ত তাহার অপরিচিত নয়। সেদিন ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের ভাইস চেয়ারম্যানের সহিত গভীররাত্রে সে পরিচয় করিয়া আসিয়াছে। নিজেকে স্বজাতীয়দের অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ মনে করে, নিজের কলঙ্ক সে গোপন করে না।”

তো, দূর্গা স্বৈরিণী হলো কী করে? তার শাশুড়ী যোগসাজশ করে কঙ্কনার জমিদারবাড়ির বাবুর ঘরে তাকে পাঠিয়েছিল। প্রথমরাত্রের পরে বিহ্বল দূর্গা শ্বশুরবাড়ি না গিয়ে মায়ের কাছে চলে এসেছিল। সব শুনে মায়ের চোখে “বিচিত্র দৃষ্টি ফুটে উঠেছিল”।

একটা উজ্জ্বল আলোকিত পথ সহসা যেন তার সামনে উদ্ভাসিত হয়েছিল। ইনফ্যাক্ট, মা-ই তাকে আর শ্বশুরবাড়ি না পাঠিয়ে এই পথ ধরিয়ে দিয়েছিল। সেই পথেই ছিরু পালের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠতা দূর্গার। দূর্গা কারো বউ নয়, নিজের দেহ বিক্রির টাকায় বাঁচে, সম্মানের সাথেই বাঁচে কিন্তু, গরীব স্বজাতিদের সে সহযোগিতাও করে। দাদা পাতুর সাথে তার ঝগড়া হয়, মার সাথে মারপিট, তবু সে ভালোই থাকে।

দূর্গা কারো বউ নয়, সে স্বাধীন। তারাশংকরের শিবকালিপুর সমাজে স্বাধীন নারীরা আসলে বেশ্যা। বা এভাবে বলা যায় যে স্বাধীনতা ভোগ করতে হলে ঐ নারীদের বেশ্যা হতে হতো। তো বেশ্যাই সই। কারো ধার সে ধারে না। তো তারাশংকর কি তারে স্রেফ বেশ্যা বানিয়েই রাখলেন? শেষপর্যন্ত শরীরসর্বস্বই কি সে?

না। এইখানে অন্যান্য নারী চরিত্রগুলো থেকে দূর্গা স্বতন্ত্র। তাই গল্পের প্রধান চরিত্র দেবু ঘোষাল-যার মধ্য দিয়ে লেখক দুইটা যুগের ভাঙা-গড়া আর মেলবন্ধন দেখাতে চেয়েছেন, তার আন্দোলন, সংগ্রাম, আদর্শ সবকিছুকে ধারণ করে পোড়ারমুখী স্বৈরিণী দূর্গা প্রেমে পড়ে তার। এই ধারণ করা সশব্দে কোথাও ঘোষণা করেননি লেখক। কিন্তু ছিরু পালের শয্যাসঙ্গীনির দেবু ঘোষালের আদর্শ ধারণ করা সত্যি অভিনব! দেবু ঘোষালের তো টাকা নাই অত, চরিত্র আগুনের মতো, ঘরের বউ বিলুকে সে শান্তভাবে ভালোবাসে, তাদের দুজনের রাজযোটক। কিন্তু এতোসব সত্ত্বেও দেবু পণ্ডিতকে দূর্গার ভালো লাগে।আর এই পোড়ারমুখী যে কিনা “ভ্রষ্টা, পাপিনী বিশেষত ছিড়ুর ঘনিষ্ঠ” তারে ঘৃণা করে দেবু।

তো, দেবুর প্রেমে পড়েই অথবা ছিরু পালের অসহ্য কদর্যতায় দূর্গাও একসময় জীবন বদলে ফেলার চেষ্টা করে। সে জংশনে যায় দুধ বেচতে, তখন আবার অনিরুদ্ধ কামারের সাথে তার ঘনিষ্ঠতা হয়। কিন্তু এ ঘনিষ্ঠতার রকম আলাদা। এখানে সে দেহ বেচে টাকা পায় না, উল্টো নানান কারণে প্রায় সর্বস্বান্ত অনিরুদ্ধকে সে সাহায্য করে।

কামারের বউ পদ্ম’র শাপশাপান্ত হাসিমুখে শোনে। আসলে এই সম্পর্কটা দূর্গার রূপান্তর। তারপর গ্রামের সেটেলমেন্ট নিয়ে যখন হুলস্থুল হয়ে গেল, জেলে যেতে হলো দেবু ঘোষালকে, তখনও দূর্গা তার শরীরটিকেই কাজে লাগায়। রূপ আর শরীর ছাড়া তার তো আর কোনো অস্ত্র নাই। কঙ্কনার সেটেলমেন্ট ক্যাম্পের পেশকার যারা “দূর্গা শ্রেণীর নারীর প্রতি অনুগ্রহ করিয়া থাকে” তাদের কাছে সে রাত্রে গিয়ে বলে আসে, পণ্ডিতকে কিন্তু হাকিমকে বলে কয়ে ছাড়িয়ে দিতে হবে। সে তার সাধ্যানুযায়ী করে, যদিও ১৫ মাসের জেল হয় দেবুর।

এভাবে বারবারই দেবুর পক্ষে দাঁড়ায় দূর্গা। নজরবন্দি যতীন যে কিনা অনিরুদ্ধ কামারের বাড়িতে ভাড়া থাকে, দেবু ১৫ মাসের জেল খেটে বেরিয়ে এলে এই দুজনের আদর্শে মেলে। গ্রামের উন্নয়নে তারা প্রজা সমিতি করে। তো সেই মিটিং এ নজরবন্দীকে ধরতে যখন ছিরু পাল ডেকে আনে পুলিশ, তখনও দারুণ এক কায়দায় দূর্গা বাঁচিয়ে দেয় যতীন, অনিরুদ্ধ আর দেবু ঘোষালকে। নিজের পায়ে বেলকুঁড়ির কাটা দিয়ে ক্ষত করে সাপের কামড়ের নাটক করে সে সে যাত্রা বিভ্রান্ত করে পুলিশকে।

তো, এই হচ্ছে দূর্গা। পুলিশ যখন পরে সব বুঝতে পারে তখন দূর্গাকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। তীক্ষ্মদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে জানতে চায়, শুনেছি, তোর যত দাগী বদমায়েশ লোকের সাথে তোর ওঠাবসা। দূর্গা উত্তর করে ” আজ্ঞে আমি হুজুর নষ্ট-দুষ্ট একথা সত্যি। তবে মশায় আমাদের গাঁয়ের ছিরু পাল, থানার জমাদারবাবু, ইউনিয়ন বোর্ডের পেসিডেনবাবু – এঁরা সব দাগী বদমাশ নোক-এ কী করে জানবো বলুন! মেলামেশা আলাপ তো আমার এঁদের সঙ্গেই।”

তারাশংকর সম্ভবত না বলেই বললেন, আসল বদমাশ কারা এবং কেন! স্বৈরিনী দূর্গা আসলে আপন আলোয় উজ্জ্বল এক চরিত্র। গণদেবতা’য় জনগণের দেবতার পাশাপাশি তারাশংকর তৈরি করলেন এক নারীকেও, যে জনগণের আরাধ্য নয়, যে অস্বস্তির, কিন্তু ভীষণ সত্য, এবং প্রাসঙ্গিক।

শেয়ার করুন: