মুসলিমরা কি হিন্দু নারীর উত্তরাধিকার আইন নিয়ে কথা বলবে?

মুশফিকা লাইজু:

কথা হলো, হিন্দু নারীদের সম্পত্তির অধিকার নিয়ে কি মুসলিমরা কথা বলতে পারবে? হ্যাঁ, পারবে। কারণ বিষয়টা অধিকারের, বিষয়টা ন্যায্যতার। মানুষ হিসেবে মানুষের অধিকারহীনতার কথা বলা, যা অন্য মানুষের স্বাধীনভাবে কথা বলার মৌলিক অধিকারের মধ্যে পড়ে।

বিগত এক মাস ধরে বিষয়টি নিয়ে আলোচনার ঝড় বয়ে যাচ্ছে। তবে খুবই কম বিজ্ঞ-বিচক্ষণ মানুষেরা এই বিষয়ে ইতিবাচক কথা বলছেন বা বিষয়টি গোচরে আনছেন। আমরা অনেক সচেতন নাগরিক চাল, ডাল, ইভিএম মেশিন, আগামী নির্বাচন বহুকিছু নিয়ে অনর্গল কথা বলতে থাকি। কিন্তু সম্পত্তিতে হিন্দু নারীদের অধিকার নিয়ে আমরা খুব একটা কথা বলতে চাই না। আমরা মূলত একটি গা বাঁচানো জাতি। ডাল-ভাত আর দিনের শেষে নিজের মাথাটা নিরাপদে কোথাও গুঁজে দিতে পারলেই আমাদের কর্ম সাবাড়! কারণ আমরা আপন প্রাণ বাঁচার মধ্য দিয়ে এই জীবনটাকে যাপন করে যাই। না পরিবার, না সমাজ, না রাষ্ট্রের কোনো অন্যায্যতা নিয়ে আমরা কথা বলতে চাই! না পারি। বীর বাঙ্গালীর তকমাটা আমাদের ধীরে ধীরে ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে যাচ্ছে।

হিন্দু নারীদের সম্পত্তির অধিকার বিষয়টিতে এখানে হিন্দু নারী কোনো বিষয় নয়, এখানে বিষয়টি পুরোপুরি মানবাধিকারের। একজন মানুষ পৃথিবীতে জন্মের অধিকারের সঙ্গে সঙ্গে তার উত্তরাধিকারের অধিকার পাবে সেটাই স্বাভাবিক। পুরুষ লিখিত ধর্মগ্রন্থের মধ্যে পুরুষের পক্ষে লিখিত যেসব নিয়মাবলী যুক্ত বা সংযুক্ত করা হয়েছে তার জন্য একজন নারী কোনোভাবেই অভিযুক্ত থাকতে পারে না।

এটা কোনো জ্ঞানগর্ভ বোঝার বিষয় নয়, খুবই স্বাভাবিক একটি বিষয় যে একজন নারী তার জন্মের আগে তার লিঙ্গ নির্ধারণ করতে পারেন না। প্রকৃতির নিয়মে সে পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করে। পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্র তার সেই জন্মের অধিকারকে রক্ষা করবে সংরক্ষণ করবে এবং ভোগ করার অধিকার নিশ্চিত করবে এটাই চিরন্তন। এখানে ঠুনকো ভঙ্গুর অযৌক্তিক ধর্মগ্রন্থের ফোপড় দালালিকে মেনে নেওয়ার কোনো মানে হয় না। যিনি ধার্মিক, ধর্মগ্রন্থ তার কাজে আসতে পারে বা ধর্মগ্রন্থ নিয়ে তিনি শান্তি ও স্বস্তিতে থাকতে পারেন, সেটা ব্যক্তির সম্পূর্ণ স্বাধীন অধিকার বা স্বাধিকার কিন্তু মানুষের জন্মের থেকে যে অধিকার নিশ্চিত হওয়া দরকার সে অধিকারকে ধর্মগ্রন্থ আড়াল করে দেয় কোন সাহসে? আর দেশের আপামর বুদ্ধিমান সভ্য মানুষ এ দুঃশাসন মেনেই বা নেয় কেনো?

এখানে হিন্দু আইন নিয়ে বিষয়টি আলোচনা হচ্ছে বলে হিন্দু আইনের কথা বলছি। কিন্তু সত্য হলো এই যে, কোনো ধর্মগ্রন্থই পারে না একজন নারীর মানবাধিকারকে লঙ্ঘিত করতে, খণ্ডিত করতে। এই বিষয়টি সভ্যতা কখনও মেনে নেবে না। আর আমরা সভ্য হিসেবে নিজেদের প্রমাণ করতে চাই আসলে ধর্মগ্রন্থের এই অধিকারের আইন-কানুনকে মেনে নিয়ে অধর্মকে প্রতিষ্ঠা করি। কারণ এখানে যে পুরুষতন্ত্রের সার্থকতা নিহিত আছে।

অত্যন্ত সাদা, সহজ এবং উজ্জ্বলভাবে প্রমাণিত যে পুরুষ রচিত ধর্মগ্রন্থগুলি নারীকে অধিকার থেকে তথা মানবাধিকার থেকে যতটা দূরে রাখবে তারা ততই এই পৃথিবীতে স্বস্তিতে থাকবে, শান্তিতে থাকবে এবং রাজকীয়তা উপভোগ করবে। একটি ধর্মগ্রন্থ যখন নারীদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে তখন একজন পুরুষ উভয়দিক থেকেই লাভবান হয়ে থাকে। প্রথমত শ্বশুরবাড়ি থেকে প্রচুর উপঢৌকন এবং টাকা-পয়সা পেয়ে লাভবান হয় সে গরীব হউক বা ধনী, অল্প বা বিপুল দ্বিতীয়ত পিতার উত্তরাধিকারের সম্পত্তির সম্পূর্ণটা ভোগ বা উপভোগ করে এই পৃথিবীতে তার বসবাস এবং দিনযাপনকে উদযাপন করে।

যারা বলেন দেবীদের সম্পত্তির প্রয়োজন নেই, দাসীদেরই সম্পত্তির প্রয়োজন আছে, তারা নিত্যান্তই মূর্খের পৃথিবীতে বসবাস করেন। কেউ কি কখনও দেখেছেন কতগুলো মাটির মূর্তি ব্যতীত আর কোনো নারী দেবীর আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছেন? আমি তো অন্তত দেখিনি। সুতরাং নিজের চোখকে নিজের হাত দিয়ে আড়াল করে দিয়ে আকাশের চিলের পানে আর কতদিন ঢিল ছুঁড়বেন? একবারও কি ভেবে দেখেছেন যারা পুরুষতান্ত্রিক এই সকল ধর্মগ্রন্থ লিখেছেন, চর্চা করেছেন এবং গত হয়েছেন, তারা হয়তো চলে গেছেন। কিন্তু বর্তমানে যারা এই সকল নিজেদের বানানো রীতি ও আইনগুলোর দ্বারা অন্যের অধিকারকে খর্ব করে নিজেরা সম্পত্তি ভোগ করছেন, বৈভবের অধিকারী হয়েছেন, তাদের উত্তরাধিকার পুরুষকূলকে এই সকল অপরাধের দায়-দেনা উচ্চমূল্যে শোধ করতে হবে এটাই প্রকৃতির নিয়ম।

সুতরাং আমি সবাইকে বলতে চাই রাষ্ট্র যখন একটি ইতিবাচক উদ্যোগ নিয়েছে যে হিন্দু নারীরাও তার পৈর্তৃক সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবেন। তখন নেতিবাচক, ভূয়া শর্ত আলোচনায় না তুলে রাষ্ট্রকে এবং দেশের আইন ব্যবস্থাকে সহযোগিতা করুন। বাংলাদেশ হলো এমন একটি দেশ যে কিনা নারীর অধিকার, ন্যায্যতা, প্রাপ্তি ও উত্তারাধিকারের ক্ষেত্রে দুই নৌকায় পা দিয়ে আছে। মহান সংবিধানে আছে যে রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের সমান অধিকার এবং বাংলাদেশ একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। কিন্তু ‘বাঘের ঘরে গোঘের বাসা’র মতন সংবিধানের নির্ধারিত অধিকার নারীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, তাকে ধর্ম দিয়ে খণ্ডিত করা হয়েছে। নারীর চলার পথটিকে অপ্রশস্ত ও বন্ধ করে দিয়েছে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে। নারীকে তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিক করে রাখা হয়েছে।

একথা সকলেই স্বীকার করে যে বিয়ে হলো একটি সামাজিক চুক্তিভিত্তিক সম্পর্ক। চুক্তির ভিত্তিতে অপরপক্ষ একজন নারীকে কীভাবে তার অর্জিত সম্পত্তির অধিকার দিল বা দিল না সেটা দ্বিতীয় পর্বের ভাবনা। কিন্তু জন্মসূত্রে, উত্তরাধিকার সূত্রে, একজন নারীকে নারী হওয়ার সুবাদে পুরুষতন্ত্র ধর্মকৌশলের যন্ত্র ব্যবহার করে নারীর অধিকারকে খর্ব করেছে! খণ্ডিত করেছে! নারীকে মানবী, দেবী, মায়াবতী, সুশীলা ও সুনিপূণা জাতীয় স্তুতিমূলক শব্দ পুরুষরাই তৈরি করেছে। নারী মূলত একজন মানুষ! স্বাভাবিক বুদ্ধিসম্পন্ন, অনুভূতি সম্পন্ন, সমান ক্ষমতা সম্পন্ন বিপরীত লিঙ্গের একজন পরিপূর্ণ মানুষ। নারীকে দেবী বানানোর বা ধৈর্যশীলা বানানোর বা আত্মত্যাগী বানানোর যে কুৎসিত ষড়যন্ত্র পুরুষ করেছে- ধর্মগ্রন্থ তা নিশ্চিত করেছে। রাষ্ট্র সেই নিশ্চয়তাকে আইনের মাধ্যমে সুরক্ষা দিয়েছে। অমানবতার বাতাস দিয়ে সেটিকে আরো প্রোজ্জল্যমান করেছে। অর্থাৎ রাষ্ট্র তার নিজের চেহারাকে ধর্মতান্ত্রিক, পুরুষতান্ত্রিক ঘেরাটোপের মধ্যে আটকে রেখেছে।

মূলত রাষ্ট্র একটি ভূখণ্ড ও তার জনগণকে পরিচালনা করার নিমিত্ত ব্যবস্থাপনা মাত্র একটি সুপরিকল্পিত অবকাঠামো। এখানে ধর্ম বা কোন পুরুষষতন্ত্রের প্রশ্রয় থাকার কথা নয়। কিন্তু রাষ্ট্র যখন পুরুষতান্ত্রিকতাকে এবং ধর্মান্ধতাকে আশ্রয় প্রশ্রয় করে তার নিজের স্বার্থকে নিশ্চিত করতে চায়, মূর্খ ও বিমূঢ় জনসাধারণের সাপোর্টকে পুঁজি করে ক্ষমতায় থাকতে চায়, তখন নারীর ভাগ্য যে খুব সহজেই দুর্ভাগ্যে পরিণত হবে, সে তেমন বিস্ময়কর কিছু নয়।

একজন সুস্থ ও সচেতন নাগরিক হিসেবে আশা করি এবং চাই যে, ধর্ম নয় বর্ণ নয় মানবাধিকারকে নিশ্চিত করার জন্য একজন মানুষকে মানবাধিকারের পক্ষে সোচ্চার থাকা উচিত। হিন্দু নারীর তো বটেই, ধর্মীয় দুঃশাসনের বাইরে গিয়ে সকল নারীরই তার যাবতীয় অধিকার এবং সম্পত্তির সমান অধিকার থাকা উচিত এবং পাওয়া উচিত। রাষ্ট্রের উচিত এই হীনমন্যতা থেকে বেরিয়ে এসে নারীর মানবাধিকারকে নিশ্চিত করা।

মুশফিকা লাইজু
লেখক, অ্যাক্টিভিস্ট

শেয়ার করুন: