কেরালা থেকে নরসিংদী, প্রতিক্রিয়ায় এতো প্রভেদ কেন?

পূর্ণাশা অরোরা:

কেরালায় বোরখা ইস্যুতে এদেশীয় কথিত ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিদের দেখেছিলাম তুমুল প্রতিবাদ করতে। হিজাব/বোরখা মেয়েদের চয়েজ, অধিকার, কত শত কথা বলে তারা প্রতিবাদ জানিয়েছিলো। নারীর অধিকার নিয়ে কত‌ই না সোচ্চার হয়ে উঠেছিলো! অথচ আজ যখন নরসিংদীতে একজন মেয়ের জামা নিয়ে টানাহেঁচড়া হলো, তার প্রতিবাদ না করে তারা চুপ! এখন তাদের মাথায় নারীর চয়েজ বা অধিকার নিয়ে কথাগুলো আসছে না! বরং তারা সমর্থন জানাচ্ছে যারা মেয়েটির জামা টেনেছে তাদের প্রতি, তাদের মতে এমন পোশাক পরলে এমনটাই হবে! তাদের মতে হিজাব পরা ব্যক্তিস্বাধীনতা, তবে টিশার্ট পরা অন্যায়, তখন স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে টিশার্ট টেনে খুলে দেয়াই যায়।

মানবতা অনেক আগেই লোপ পেয়েছে এদেশের মানুষের। ধর্মের নাম নিয়ে নিজেদের বুঝ দিয়ে রাখে যে তারা কোনো অন্যায় করছে না, একটা মিথ্যা আবরণে নিজেদের মগজটা জড়িয়ে রাখে তারা! যে কারণে তাদের মন মতো না হলেই তারা হিংস্রতার দিকে পা বাড়ায়। কেন বোরখা/হিজাব/ওড়না পরেনি তা নিয়ে দোষারোপ করে, তারাই মেয়েদের জামা টানা শুরু করে!

আমরা সভ্য সমাজে থাকি, ফলে আমরা জামা কাপড় ছাড়া চাইলেই ঘুরতে পারিনা। তা সকলের জন্য প্রযোজ্য, কোনো নির্দিষ্ট জেন্ডারের জন্য না কেবল। এখানে সভ্য বলতে কী বোঝায়, তাও একটা ব্যাপার। আদিমকালে মানুষ বুঝতে শেখার পর প্রাণীর ছাল-চামড়া দিয়ে, পাতা দিয়ে নিজেকে আবৃত করে রাখতো। তার থেকে অনেকটা সময় পাড়ি দিয়েছে মানুষ, ফ্যাশন সচেতন হয়েছে, কালের বিবর্তনে পোশাকে পরিবর্তন এসেছে! তাছাড়া মানুষের পশম নেই অন্য প্রাণীর মত, যা দিয়ে নিজেকে ঠান্ডা-গরম থেকে রক্ষা করবে তারা, ফলে পোশাক বা আবরণ দরকার হয়। মানুষের এই সভ্যতা তাকে পশুর থেকে আলাদা করে। আচার-আচরণ, ভাবতে পারা সবকিছুই এই সভ্যতার অংশ! আপাদমস্তক নিজেকে কালো কাপড়ে ঢেকে রেখে কিংবা “পুরুষ সেজে” অমানুষের মত আচরণ করলে সভ্য হ‌ওয়া যায়না! সভ্যতা আমাদের মস্তিষ্কে থাকে, আমাদের আচরণে থাকে; পোশাক কেবল ফ্যাশন মাত্র, সময়ের সাথে বদলায়, আমরা পছন্দ মত বেছে নেই। পোশাকের কথা উঠলেই ধর্মীয় পোশাকের নাম নিয়ে যারা তেড়ে আসে, নিজেরা ধর্মের কতটুকু মানে তারা? সহমর্মিতা, সহানুভূতি, সংযম কোনোকিছুই তো মানেনা তারা, এগুলোও তো তাদের ধর্মের অংশ! সবকিছু বাদ দিয়ে কেবল মেয়েদের পোশাক নিয়ে মাথা ঘামায়, এবং নিজেদের বর্বরতার পরিচয় দেয়।

নরসিংদীর ঘটনায় অনেকগুলো পুরুষ হাতের সাথে একজন নারীর হাত‌ও এগিয়ে গিয়েছিল মেয়েটির জামা টানতে। তা থেকে স্পষ্ট হয় এদেশের নারীদের অধিকারে বাধা দিতে অনেক পুরুষতান্ত্রিক নারী সবসময়‌ই হাত বাড়িয়ে আছে। তার একবারও মনে হয়নি এই মেয়েটির জায়গায় সেও থাকতে পারে, কারণ হ্যারাসমেন্ট পোশাক দেখে হয় না! শুধু এই নারী না, ঢাকার রাস্তায়‌ও অসংখ্য নারী এমন কাজ করে থাকে। ওড়না পরিনি কেনো, কেনো প্যান্ট-শার্ট পরেছি, কত অসভ্য মেয়ে আমরা, হাজার রকম অভিযোগ নিয়ে নিজ দায়িত্বে তারা শাসিয়ে যায় মেয়েদের। এগুলোও ভারবাল অ্যাবিউজ! এরা এখন সদলবলে যেন নেমেছে মোরাল পোলিসিং এর দায়িত্ব নিয়ে। অথচ তাদের দায়িত্ব দেয়া হয়নি আমার পোশাক ঠিক করে দেয়ার, বরং তাদের দায়িত্ব নিজেদের মন-মানসিকতা আরও উন্নত করা। পুরুষতন্ত্রের দাসত্ব না করে সভ্য মানুষের মত নিজেদের মস্তিষ্কের ব্যবহার করা।

একজন মানুষ কী পোশাক পরবে, সেটা কেবল ও কেবলমাত্র তার সিদ্ধান্ত, তার অধিকার। অন্য কারোর অধিকার নেই তা টেনে হিঁচড়ে খুলে দেবার, গায়ে হাত দেবার। কেউ যদি জামা কাপড় ছাড়াও ঘুরে, তাও কারোর অধিকার নেই তার গায়ে হাত দেবার! অন্যের পোশাক ঠিক না করে নিজের নোংরা চিন্তা ও আচরণ ঠিক করুন। মানবিক দূরত্ব বজায় রাখতে শিখুন সবাই! সবাই তার পছন্দ মত জামা পরবে, স্বাধীনভাবে-নির্ভয়ে চলবে এমন পরিবেশ গড়ে তুলুন।

শেয়ার করুন: