দীপনা চাকমা দীপু:
জিন্স, টি শার্ট পরার কারণে নরসিংদীর রেলস্টেশন এক তরুণীকে প্রকাশ্যে শ্লীলতাহানির ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিন্দা আর প্রতিবাদের ঝড় বয়ে যাচ্ছে। এই নিন্দনীয় এবং অপরাধমূলক ঘটনার বিরুদ্ধে আমি সুবিচার চাই। চাই অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। তবে ঘটনাগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লেই কেবল নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড় ওঠে।
অথচ এরকম ঘটনা প্রতিদিনই দেশের কোন না কোন জায়গায় হরহামেশাই ঘটছে যা নজরে আসে না। মুসলিম বাঙ্গালী সমাজে ধর্মীয় বিধিনিষেধের কারণে অধিকাংশ এই নোংরা, অপ্রীতিকর, অন্যায় ও অপরাধমূলক ঘটনাগুলো ঘটায় মূলত ধর্মীয় মৌলবাদীরা।
কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামে কোন আদিবাসী পাহাড়ি সম্প্রদায়ের কোন ধর্মেই উল্লেখ নেই আদিবাসী পাহাড়ি নারীরা কী ধরনের পোশাক পরিধান করবে বা করবে না। প্রত্যেক আদিবাসী পাহাড়ি সম্প্রদায়ের নারীদের নিজস্ব সংস্কৃতির পোশাক রয়েছে, যে পোশাক কোমর তাঁতের মাধ্যমে নারীরাই তৈরি করেন (মারমা সম্প্রদায় বাদে)।
আমার আজকের লেখা নরসিংদীর রেলস্টেশনে ঘটিত নারী শ্লীলতাহানি ঘটনা নিয়ে নয়। এই ঘটনা নিয়ে লেখার লেখকের অভাব নেই।আমি লিখছি আদিবাসী পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীদের বর্তমান কিছু চিত্র নিয়ে।
পূর্বপুরুষদের আমল থেকেই আদিবাসী পাহাড়ি নারীরা নিজেদের পরিধেয় পোশাক নিজেরাই কোমর তাঁতে বুনতেন। বেইন(কোমর তাঁত) বুনতে না জানলে তখন নারীদের বিয়ে দিতে সমস্যা হত।কারণ,নারীদের নিজের পোশাক নিজেকেই তৈরি করে পরতে হতো বলে। তখন রেডিমেড পিনোন-হাদি পাওয়া যেত না।
তবে আদিবাসী পুরুষরা কিন্তু নিজস্ব পোশাক সংস্কৃতি তেন্যে হানি (নেংটি) ধারণ থেকে ছুঁড়ে ফেলে খুব সহজেই ধুতি থেকে লুঙ্গি, লুঙ্গি থেকে ফুল প্যান্ট, হাফ প্যান্ট, টাই স্যুট পরিধান করে আসছে যুগ যুগ ধরে। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হবে তাই আদিবাসী পুরুষরা কেন নেংটি না পড়ে লুঙ্গি পরছে,প্যান্ট পরছে এ নিয়ে আমাদের নারীদের কোন মাথাব্যথা নেই।
কিন্তু আদিবাসী পাহাড়ি নারীরা কি পোশাক পরবে বা পরবে না তা ধর্মীয় বিধিনিষেধে উল্লেখ না থাকলেও আমাদের এক শ্রেণির কথিত সংস্কৃতি এবং জাত রক্ষাকারীদের চরম চুলকানি রয়েছে। যেমন চাকমা জাতির নারীদের নিজস্ব পোশাক পিনোন – হাদি। বর্তমানে অনেক আদিবাসী ফ্যাশন ডিজাইনার পিনোন-হাদি পোশাককে নিজেদের মেধা খরচ করে ত্রিপিস, লং স্কার্ট, টপস্ সহ নানা ডিজাইনের মাধ্যমে নতুনত্ব রূপে হাজির করছে।
পিনোন হাদিকে একটা নির্দিষ্ট স্থানে আটকে না রেখে সেটাকে যত ভিন্নভাবে উপস্থাপন করা যায় একদল তরুণ তরুণী নিরলসভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছে। আর এতেই ঐ শ্রেণির মধ্যে এলার্জি দেখা দেয় এবং চুলকানি শুরু হয়। তারা যুক্তি দেখায় যে পিনোন-হাদি নারীরা আগে থেকে যেভাবেই পরিধান করে আসছে সেভাবেই থাকুক। পিনোন-হাদি নিয়ে যেন নাড়াচাড়া করা না হয়, বিকৃত করা না হয়। পিনোন-হাদিকে অন্যভাবে কাজে লাগানোকে তাঁদের ভাষায় বিকৃত করা।
পিনোন-হাদি শুধু নারীর পরিধেয় পোশাকে সীমাবদ্ধ নেই। অহরহ আদিবাসী রেস্টুরেন্টে ডাইনিং টেবিল ক্লথ থেকে শুরু করে জানালার পর্দাতেও ব্যবহার হচ্ছে। এ কারণে এক শ্রেণির সংস্কৃতি এবং জাত রক্ষাকারীদের মুখে শোনা যায় জাত গেলো, জাত গেলো বলে। হায় হায় করে কপাল ঠুকছে সংস্কৃতি ধ্বংস হয়ে গেলো এই দুঃখে।
বছরে দুই একটা দিন বিজু উৎসবে গলায় হাদি ঝুলিয়ে এবং ধুতি পড়ে বাকি সময় প্যান্ট শার্ট লুঙ্গি পরে কাটিয়ে দেওয়া একটা শ্রেণি
চাকমা নারীদের এক প্রকার ফতোয়া দেয় শাড়ি পরা উচিত নয়, কারণ শাড়ি আদিবাসীদের পোশাক নয়। শাড়ি বাঙ্গালীদের পোশাক।
আমাদের পূর্বপুরুষেরা বসবাস করতেন মাচাং ঘরে। জীবিকা নির্বাহ হিসেবে তারা জুম চাষ করতেন। তখনকার সময় মাটিতে উর্বরতা ছিল বিধায় একটা জুমের ক্ষেতকে পুরো একটা বাজার বলে ধরে নেয়া হতো। একটা সংসার চালাতে যা যা প্রয়োজন সবকিছুই উৎপাদন হতো জুমে। কালের পরিক্রমায় মাটির উর্বরতা কমে আসলে জুমের উৎপাদনও কমে আসে।
পূর্বপুরুষরা একসময় নেংটি পরা বাদ দিয়ে ধুতি পরতে শুরু করেন। এভাবে ধাপে ধাপে পরিবর্তিত হতে হতে শিক্ষা দীক্ষায়, পেশায়, পোশাকে, বাসস্থানসহ সবদিক দিয়েই আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। এখনও অব্দি যেমন জুম চাষী রয়েছে, রয়েছে মাচাং ঘর তেমনি দেশে বিদেশে বড় বড় পদে আসীন রয়েছেন আদিবাসী জনগোষ্ঠীরা। হয়েছেন কোটিপতি, গড়েছেন সুউচ্চ দালান।
এসব পরিবর্তন নিয়ে সবাই গর্ব করে। আনন্দিত হয়। কিন্তু নারী সমাজকে নিয়ে তাঁদের দুশ্চিন্তার অন্ত নেই। পড়ালেখা বা কর্মের তাগিদে সমতলে অবস্থান করা ছাত্রী/কর্মজীবী তরুণী নারীরা কোন বাঙ্গালী পুরুষের সাথে মেলামেশা করলে বিশেষ করে ফেসবুকে কোন ছবি বা ভিডিও পোস্ট করা মানেই জাতভাইদের ফেসবুক গরম রাখার একটা ইস্যু এনে দেওয়া। কোন ধরণের যাচাই-বাছাই না করে ছবি দেখার সাথে সাথেই তাঁদের সেই কমন গালিগালাজ, নোংরা আক্রমণ শুরু হয়। অন্তরঙ্গভাবে ছবি হলে সেটা আলাদা বিষয় কিন্তু ঐ শ্রেণির কাছে বাঙ্গালির ছেলের সাথে আদিবাসী মেয়ের ছবি হলেই হলো। কেন সে বাঙ্গালির সাথে মেলামেশা করতে যাবে হেন তেন যুক্তি দাঁড় করায়। বাংলাদেশে বসবাস করে, সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙ্গালীকে কি পাশ কাটিয়ে চলা যায়?
পোশাক থেকে বিয়ে সবকিছুই নারীদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয় জাত এবং সংস্কৃতি রক্ষার কবচ হিসেবে। ঐ জাত রক্ষাকারী,সংস্কৃতি রক্ষাকারী হৈচৈ করা শ্রেণির ৯৮% কিন্তু পাহাড়ে ভূমি বেদখল,আঞ্চলিক সংঘাত বিষয় নিয়ে মুখে কুলুপ আঁটে। কারণ,তারা এটা জানে এবং বুঝে যে এসব বিষয়ে কথা বলতে যাওয়া মানে সরকার, সেনাবাহিনী এবং আঞ্চলিক দলের কোপানলে পড়ে জীবনকে অনিরাপদ করে তোলা। তাই তাঁদের কাছে একটাই নিরাপদ ইস্যু হচ্ছে আদিবাসী নারীদের নিয়ে ইচ্ছামতো বিধান দেয়া। কারণ, আদিবাসী নারী ইস্যুতে ৯৯% আদিবাসী পুরুষ একমত। তাই নারীদের নিয়ে যৌক্তিক অযৌক্তিক যেমনই হোক আলোচনা-সমালোচনা করা যায়, কথার তীর নিক্ষেপ করা যায়, বেশ্যা,মাগী, খাংকি উপাধি দেয়া যায়। এতে তাদের মান সম্মান যেমন যায় না তেমনি জীবনও অনিরাপদ হয় না। এটাকে দূর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার হিসেবে বলা যায়।
কোন পাহাড়ি নারী যদি বাঙ্গালির সাথে প্রেম বা শারীরিক সম্পর্কের অভিযোগে অভিযুক্ত হয় তাহলে তাকে বাগে পাওয়া গেলে ভিডিও সহকারে চটির আদালত বসিয়ে রগরগে প্রশ্ন করে রসালো উত্তর শুনে কথিত বিচারকেরা অর্গাজম লাভ করে। পাশাপাশি প্রচনন্ডভাবে গায়েও হাত তোলা হয়।তারপর বিশ্বজয়ের ভাব নিয়ে ফেসবুকে আত্মতৃপ্তি সহকারে ছাড়া হয়। বাকিরা শেয়ার, কমেন্ট করে পরিপূর্ণ করে দেয়। তারপর কটা দিন ধরে এত মিনিটের, অত মিনিটের ভিডিও পাওয়া গেছে বলে বিজ্ঞাপনের পোস্ট করে অবশেষে ক্ষান্ত দিয়ে আর একটা নারীর ইস্যুর অপেক্ষায় থাকে।
আর একটা বহুল আলোচিত বিষয় হলো আদিবাসী পুরুষের সংকটের কারণে আদিবাসী নারীরা যাতে বাঙ্গালী বিয়ে করতে না পারে তার জন্য অনেকেই একাধিক বিবাহ প্রথা চালু করার কথা বলে। যদিও অনেকেই স্রেফ মজা করে বলে, আবার অনেকেই সিরিয়াসলি বলে। এই ইস্যুটিকে আমার কাছে নারীদের জন্য চরম অপমানজনক মনে হয়। চরম ঘৃণ্য পুরুষতান্ত্রিকতা বলে আমি এটাকে অভিহিত করি।
আমি ভেবে পাই না এই অত্যাধুনিক যুগেও আদিবাসীদের মধ্যে কেন এত বেশি মৌলবাদের জন্ম হলো! মুসলিম বাঙ্গালিরা নারীদের দমিয়ে রাখে ধর্মীয় অজুহাত দিয়ে, আর আদিবাসীরা দমিয়ে রাখে জাতীয় অস্তিত্ব এবং সংস্কৃতি রক্ষার অজুহাতে।
জাতীয় অস্তিত্ব এবং সংস্কৃতি রক্ষা করা এককভাবে নারীদের পক্ষে সম্ভব নয়। মায়ানমারে যেমন পুরুষরা লুঙ্গি পড়ে তেমনি সংস্কৃতি রক্ষা করতে চাইলে আমাদের আদিবাসী পুরুষদেরও আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির পোশাক পড়া উচিত।এটা আমার ব্যক্তি অভিমত।
তবে আমি যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলায় বিশ্বাসী। কোন কিছুই স্থিতি নয়। ক্রম পরিবর্তন ঘটে। তাই নারীরা পিনোন-হাদি যেমন পরিধান করবে সাথে তাদের ইচ্ছে হলে বাঙ্গালী পোশাক,পাশ্চাত্যের পোশাকও পরতে পারবে। যে জায়গায় যেটা মানানসই হয়। সেটা নির্ধারণ করে দেওয়ার অধিকার কারও নেই। আর নারীরা একজন বিয়ে করবে নাকি, একাধিক সতীনের সাথে ঘর করবে সেটা তাঁদের ব্যক্তিগত অধিকার। জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষার অজুহাত দেখিয়ে পুরুষদের একাধিক বিবাহ প্রথা চালু করার কথা যারা বলে তাদের মনমানসিকতা,চিন্তাভাবনা অত্যন্ত নিম্ন এবং কুৎসিততম।
দীপনা চাকমা দীপু
অনলাইন এক্টিভিস্ট এবং উন্নয়নকর্মী