রওশন আরা নীপা: গত কয়দিন আগে মাদারীপুর এর সভ্য এবং ভদ্রজনেরা পতিতাপল্লী উচ্ছেদ করেছেন তাদের এলাকাকে পাপ কাজ থেকে উদ্ধার করতে এবং সমাজকে কলুষমুক্ত রাখতে!
বেশ কবছর আগে নারায়ণগঞ্জের টানবাজার থেকেও এভাবেই উচ্ছেদ করা হয়েছিল যৌনকর্মীদের এবং তারপরের ঘটনা আমরা সবাই জানি! এই সব যৌনকর্মীরা ছড়িয়ে পড়েছিল রাস্তা –ঘাটে, আবাসিক এলাকা থেকে শুরু করে হোটেল বস্তিতে। একটা এলাকাকে পাপমুক্ত করতে গিয়ে গোটা দেশ এ ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল।
আমি কোনভাবেই এই পেশার পক্ষে নই, কিন্তু সমাজের সুধীজনদেরকে একটু ভেবে দেখতে অনুরোধ করি, একজন মেয়ে কতটুকু বিপদে পড়লে বা কোন অবস্থায় নিজেকে এই পেশার সাথে যুক্ত করে? বা আদৌ তারা নিজেরা স্বেচ্ছায় এই পেশায় যুক্ত হয় কিনা?
আমরা যতদিন পর্যন্ত এই সব হতভাগা মেয়েদের বিকল্প কোন ব্যবস্থা করতে না পারবো, রাষ্ট্র এবং সমাজ না করবে, ততদিন পর্যন্ত কোনভাবেই এই পেশাকে নির্মূল করা সম্ভব কি? যদি তা না হয় তাহলে ২/১ টি পল্লী উচ্ছেদ করে এই সব মেয়েদের ভাসমান করে পুরো সমাজটাই কি পতিতাপল্লী হয়ে উঠবে না?
যৌন ব্যবসা মুলত পৃথিবীর আদিমতম পেশার একটি। সেই আদিকাল থেকেই মেয়েরা এই পেশার সাথে জড়িত। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের বাধ্য করা হয়েছে । আদিমকালে বর্বর সমাজে যোদ্ধার ভেট হিসাবে থাকতো নারী, বিজিত সৈনিক তার বিজয়ের স্মারক হিসাবে পরাজিত পক্ষের নারীকে অবলীলায় ভোগ করতো । এছাড়াও রাজা, বা ক্ষমতাবান রা তাদের ক্ষমতা আর প্রভাবের চিহ্ন স্বরূপ নারী সম্ভোগের প্রতিযোগিতায় নামতো । এইসব ক্ষেত্রে নারী কখনও একটু আধটু ইনাম পেলেও বেশীর ভাগ সময়ই তা কোন বিনিময় মূল্য হিসাবে গণ্য হতো না। এমনকি অনেক সময় পুরুষের বিকৃত যৌনাচারের জঘন্য এবং ভয়াবহ শিকারও হতে হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে।
যেসব সুধীজন এই অসাধারণ, সমাজকল্যাণমূলক ভালো কাজটি করে বাহবা কুড়িয়েছেন, তাদের কাছে আমার সবিনয়ে কিছু প্রশ্ন— ১. এখানে যে মেয়েরা এই ব্যবসার সাথে জড়িত তাদের কতজন স্বেচ্ছায় এবং শখ করে এই কাজ করছে? নাকি আপনার-আমার মত ভদ্রবেশী শয়তানদের লোভ-লালসার শিকার হয়ে বাধ্য হয়েছে এই পথে আসতে? ২. এখানে যে মেয়েরা যৌন ব্যবসার সাথে জড়িত তারা কি আপনাদের কে এখানে আসতে বাধ্য করে? নাকি আপনারা স্ব-ইচ্ছায় এই জায়গায় আসেন?
৩. আপনারা এই সব মেয়েদেরকে সমাজ, সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন করে নাম দিয়েছেন পতিতা, আর আপনারা যারা এই জায়গায় বিকৃত লালসা পূরণ করতে যান তবে তারা কি পতিত? আপনাদের মহৎ উদ্যোগে তাদেরকে কি চিহ্নিত করে কোন শাস্তি দিচ্ছেন বা দেবেন?
পতিতাবৃত্তি বাংলাদেশের আইনে অবৈধ কোন পেশা নয় । সরকারি আইন মেনে রীতিমত রেজিস্ট্রেশন করে এই পেশায় আসতে হয় এবং পতিতা পল্লীর সকল মেয়েই রেজিস্ট্রিকৃত পেশাদার এবং তাদের ভোটাধিকার রয়েছে। তাহলে কেন এবং কার স্বার্থে এই উচ্ছেদ?
আমরা সবসময়েই লক্ষ্য করি নির্বাচনকে ঘিরে বিভিন্ন এলাকায় নব্য সমাজকর্মী বা ভালো মানুষের আবির্ভাব ঘটে, যারা নিজেদের ‘ভালোত্ব’ জাহির করতে গিয়ে এইসব তথাকথিত ‘ভালো’ কাজগুলো করে নিজেদেরকে জনপ্রিয় করবার চেষ্টা করেন। এ বিষয়টি আমরা এর আগে নারায়ণগঞ্জের টানবাজারের সময়ও দেখেছি। যতদূর জানি হাইকোর্ট এর একটি নিষেধাজ্ঞা ছিল এই পল্লী উচ্ছেদের বিরুদ্ধে, তারপরও দিনেদুপুরে সবার সামনে এই বস্তি উচ্ছেদ হয়েছে – তাহলে আইন আর প্রশাসন কি এতই দুর্বল? নাকি আইন সবার জন্য সমান না?
বাংলাদেশের সংবিধানে স্পষ্টত উল্লেখ আছে-“ধর্ম-বর্ণ, পেশা বা অন্য কোন কারণে কারও স্বাধীনতা ক্ষুন্ন করা যাবে না বা কারও বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক আচরণ করা দণ্ডনীয় অপরাধ”। কিন্তু এক্ষেত্রে আমরা এর কোনটারই প্রয়োগের কথা এখন পর্যন্ত শুনি নাই। একসময়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন নৌবন্দরে পতিতাপল্লী ছিল, এখনও টাঙ্গাইল, দৌলতদিয়া এবং খুলনায় বড় পতিতালয় অবস্থিত। এখানে মূলত যেসব মেয়ে এই পেশায় এসেছে তাদের বেশীর ভাগই প্রতারণা এবং পাচারের শিকার হয়ে এসেছে। তবে অনেকে আবার মায়ের উত্তরাধিকার এর সূত্র ধরেও এ পেশায় এসেছে বা আসছে।
২০০৫ সালে ‘চিলড্রেন ইন দ্য হিডেন ওয়ার্ল্ড’ ফিল্মটির কাজ করতে গিয়ে আমার কিছু বাস্তব অভিজ্ঞতা হয়েছিল । মূলত এখানে যেসব মেয়ে আছে, তারা কেউই স্বাধীন নয়, এরা বাড়ীওয়ালী, দালাল এবং সমাজপতিদের হাতে জিম্মি। অবাক করা বিষয় হচ্ছে, এদের আয়ের একটা বড় অংশ বাড়িওয়ালী, দালাল আর সমাজপতিদের পকেটে যায়। এর বাইরে যা থাকে তা খুবই সামান্য এবং তা দিয়ে কোনমতে খেয়ে-বর্তে থাকে। আরও মজার বিষয় হচ্ছে, এরকম অনেক বাবা-মা আছেন যে, তারা তাঁর মেয়ের পেশাকে জেনেও তার কাছ থেকে আর্থিক সাহায্য নিচ্ছেন, কিন্তু তাকে মেয়ের মর্যাদা দিচ্ছেন না। কারণ অর্থের কোন রঙ নেই।
আমরা প্রতিনিয়ত নানা অন্যায় অসততা করছি, চুরি করছি, ঘুষ খাচ্ছি, দুর্নীতিতে আকন্ঠ নিমজ্জিত আছি, সমাজের উঁচু তলায় উঠবার জন্য নিজের স্ত্রী বা কন্যাসম মেয়েকে অন্যের ভোগের শিকার করছি, কিন্তু আমরা পতিত হই না । আমাদের পার্টির জৌলুস বাড়ানোর জন্য সোসাইটি গার্ল আমাদের স্ট্যাটাস বাড়ায়, আর ঐসব আধপেটা খাওয়া, ততোধিক দরিদ্র, অপুষ্ট, নোংরা মেয়েগুলো পেটের দায়ে অথবা বাধ্য হয়ে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় তার আপন দেহ বিক্রি করে, তাতে আমাদের সমাজ নোংরা হয়ে যায়, যার খদ্দের আবার আমরাই!
পরিশেষে একটা গল্প বলি, যদিও এটা সত্য ঘটনা- রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরে রুশ সরকার এক কাজ করেছিলেন—সেখানকার পতিতাপল্লীতে যারা যারা যেতেন, তাদের সবার নাম ছবি সহ বাসার ঠিকানা লেখা বাধ্যতামূলক ছিল এবং নির্দিষ্ট সময় পরপর সেইসব নামের তালিকা ঠিকানা ও ছবি প্রকাশ করা হতো জনসমক্ষে। এর কিছুদিন পরে দেখা গেল যে, ঐ সব পল্লীতে আর খদ্দের পাওয়া যাচ্ছে না। এক সময় খদ্দেরের অভাবে পল্লীর মেয়েরা এই পেশা ছেড়ে দিতে বাধ্য হলো—এবং রাষ্ট্রীয় ব্যবস্তায় তাদের বিকল্প কর্মসংস্থান এর সুযোগ দেওয়া হলো। আমরা তথাকথিত সুধীজনেরা সবসময়ই অন্যের দিকে আঙুল তুলে বেড়াই, কখনই কোন ক্ষেত্রে নিজেদের দিকে তাকিয়ে দেখিনা। এবং সবচে বড় বিষয় হলো ব্যাধির উৎস নিয়ে আমাদের কোন মাথা-ব্যথা নেই এবং ব্যাধিমুক্ত হওয়ারও কোন ইচ্ছা নেই। তাই একটি নির্দিষ্ট জায়গার ব্যাধি ছড়িয়ে পড়ে সবজায়গায়, সবখানে।
লেখক পরিচিতি: সমাজকর্মী ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব
ইমেইল : [email protected]