তানিয়া মোর্শেদ: “ক্রীতদাস” শব্দটি শুনলে চোখে ভাসে আফ্রিকার কালো মানুষদের উপর নির্মম অত্যাচারের ছবি। আর অত্যাচারীর জায়গায় সাদা মানুষ। এর আগেও কিন্তু মানুষ মানুষকে ক্রীতদাস করেছে।
বাংলাদেশে গার্মেন্টস কর্মীদের মালিকপক্ষ কি ক্রীতদাসের মত ব্যবহার করে না? গরীব মানুষগুলোর রক্তঝরা শ্রম কি নামমাত্র মূল্যে কেনা হয় না? হাতে চাবুক নেই মালিক ও তাদের সহযোগীদের, আছে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি নামে বহুতল খাঁচা। সে খাঁচার ভেতর কি কি ঘটে তা আমরা জানতে না চাইলেও মাঝে মাঝে “অগ্নিকাণ্ড”, “ভবন ধসে পড়া” ইত্যাদি কারণে জানতে বাধ্য হই। তখন অল্প ক’দিনের জন্য আমাদের প্রাণ কাঁদে, আমরা খবর লিখি/ দেখি/ শুনি/ , টক শো’ তে কথা বলি/ শুনি/ দেখি, ফেইসবুকে লিখি এবং ভুলে যাই। তারপর আবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি!
আমরা কি মানুষ? যদি মানুষ হই তাহলে কেন প্রতিবাদ করি না (লোক দেখানো প্রতিবাদের কথা বলছি না)? কেন এখন পর্যন্ত তাজরীন গার্মেন্টসের মালিকের বিচার হয় না? কিসের ভয়ে, কার ভয়ে? আমার জানা প্রয়োজন। আমি আজও রাজাকারদের নাম জেনে রাখি (যাদের নাম জানা ছিল না/নেই)।
প্রতিবাদ যখন সমষ্টির হয়, তখন কিছু হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। প্রতিবাদ যখন ব্যক্তির হয়, তা হয়ত কিছুই করে না। হয়ত কারো কাছে তা ছেলেমানুষীও মনে হতে পারে। ব্যক্তিগতভাবে রাজাকার, জামাত, শিবির, পাকিস্তানীদের থেকে অনেক দূরে থাকি। একই ভাবে এইসব খুনী মালিকদের থেকেও দূরে থাকতে চাই।
কয়েক বৎসর আগে ছেলেকে বলেছিলাম (এক বন্ধুর ঠাট্টার জের হিসাবে), “কখনো পাকিস্তানী মেয়ে পছন্দ করো না।” সেই মেয়ের দাদা/ নানা ১৯৭১-এ কি করেছিল তা কে জানে? সে আমায় বলেছিল, “ওদেরকেও না …… যারা বাংলাদেশী হয়েও পাকিস্তানীদের সাহায্য করেছিল (রাজাকার শব্দটি তার মনে ছিল না) তাদের মেয়েও না।”
এখন বলেছি, “গার্মেণ্টসের মালিক/ মালিকদের মেয়েকে পছন্দ করো না।” কে এখনও “মানুষ” আছে, বা কে নেই, কে বলবে? ছেলের প্রশ্ন, “যারা কাজ করে তাদের ফ্যামেলির কাউকে করলে অসুবিধা নেই তো?” আমার সংক্ষিপ্ত উত্তর, “না।” ওর কথায় আশ্চর্য্য হওয়ার কিছু নেই। সে যে দেশে জন্মেছে, বেড়ে উঠছে, (আর যে মা-বাবার কাছে) তাতে এ ভাবে ভাবতে/ বলতেই পারে।
মানুষের পরিচয় তার পেশায় নয়, তার কাজে/ আচরণে, সব পেশার প্রয়োজন আছে এই পৃথিবীতে টিকে থাকতে হলে, মানুষ তথাকথিত শ্রীহীন/ মর্যাদাহীন পেশায় জীবিকার্জন করে তার কারণ সে সুযোগ পায়নি জীবনে, সুযোগ পেলে সে’ও তথাকথিত “কেউ” হতে পারতো, সব মানুষের অধিকার সমান, বাবা-মা কি করলো বা “কে” তাতে কিছু আসে যায় না, তুমি কে (কে মানে পেশা নয়, পেশা হচ্ছে কিভাবে জীবিকার্জন হয় তাই শুধু বলে, পুরো মানুষটিকে বুঝায় না) ………………………… এত এত কথার পর এ প্রশ্ন সে করতেই পারে! …………
আমার পাশে বসে ছেলে খবর দেখছিল, অগ্নিদগ্ধ দেহগুলো বডিব্যাগে ছিল তাই দেখা সম্ভব ছিল কষ্ট করে। মাঝে মাঝে দেখে নিচ্ছিল মা’র মুখে বেদনার ছাপ, মা’ও দেখছিল ছেলের কষ্ট আর রাগ! আমরা কি পারি না এই কষ্ট আর রাগাক্রান্ত মুখগুলোকে সমষ্টিতে পরিণত করতে?
এপ্রিল ২৩, ২০১৩: আর কত? গতকাল পিলারে ফাটল দেখবার পর কেন কেউ কিছু করলো না?? মানুষের জীবনের কোনো মূল্যই নেই? গার্মেন্টসে কাজ করা মানুষরা কি মানুষ না?
এপ্রিল ২৬, ২০১৩: ষড়যন্ত্রতত্বে বিশ্বাসী হলে কি এতটাই হতে হয়? বিএনপি’র সাপোর্টাররা বিশ্বাস করে যে, ভারতীয়রা বাংলাদেশের গার্মেন্টেস শিল্প ধ্বংসের জন্য ষড়যন্ত্র করছে। আবার আওয়ামী লীগের কেউ কেউ বুঝাতে চাইছেন যে বিএনপি ষড়যন্ত্র করে রানা প্লাজা ধসিয়েছে!! মনে হচ্ছে, বস্তা পচা হিন্দী সিরিয়াল দেখে বাংলাদেশের মানুষ ভীষণভাবে ষড়যন্ত্রতত্ত্বে বিশ্বাসী হয়ে পড়েছেন! সাদাকে সাদা, কালোকে কালো দেখা মানুষ কি হারিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ থেকে? না কি আমি বুঝতে পারছি না তারা কি বলছেন?
মে ৪, ২০১৩: গতকাল থেকে একটি ছবি মনের মধ্যে, মাথার মধ্যে ঘুরছে …………… সাভারের ধ্বংসস্তুপের মধ্যে……… অনেক লম্বা চুল, ঝুলছে, মাথার পেছন দিক তাই মুখ দেখা যাচ্ছে না। কিছুটা দূরে দু’টো পা (অন্য কারো) ….. প্যান্ট পরা। ছবিটি দূর থেকে তোলা হলেও বোঝা যাচ্ছে। ফেইসবুকে একজন পোস্ট করেছে। টিভিতেও এক ঝলক দেখিয়েছে। এরকম নাহলেও আরো অনেক দৃশ্য দেখেছি, গত কিছুদিনে। আমি ভাবছি উদ্ধারকর্মীদের কথা! এঁদের দীর্ঘ সময় কাউন্সিলিং করলেও ঠিক হবেন কি না কে জানে! আর বাংলাদেশে এই সব “সাধারণ” (আসলে অসাধারণ) মানুষের কথা কে মনে রাখে? যারা কাউন্সিলিং দেন তারা কি স্বেচ্ছাসেবা দিতে পারেন না এঁদের? এই অসাধারণ মানুষগুলো যাঁরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মানবিকতার চরম উদাহরণ দেখালেন তাঁদের পাশে কি দাঁড়ানো যায় না?
…………..সাভার ট্র্যাজেডির পর থেকে মন এমন হয়ে আছে, অনেক বার ভেবেছি ………… ভেবেই চলেছি, জীবিনের মানে আসলে কি?? সব যুগে পৃথিবীতে কিছু মানুষের চরম বিলাসী জীবনের জন্য শ্রমিকশ্রণী মানবেতর জীবন যাপন করে যাবে! আবার সময় সময় এই ভাবে মৃত্যু বরণ করবে! আসলে কথাটি হবে তাদের এই ভাবে হত্যা করা হবে! সব সভ্যতা দাঁড়িয়ে আছে এঁদের লাশের উপর। ইতিহাসে এঁদের স্থান নেই। ইতিহাস লেখা হয় রাজা-মহারাজাদের গুণ কীর্তনে! তাজ মহল, চীনের প্রাচীর, পিরামিড ………… এসবের ইতিহাস লেখা হয়, কিন্তু লেখা হয় না শ্রমিকের রক্তঝরা ইতিহাস! বাংলাদেশের “দরিদ্র্” দেশ থেকে “উন্নয়নশীল” দেশে পরিণত হওয়ার কথা সগর্বে বলা হয়, বলা হয় না কাদের রক্তঝরার বিনিময়ে এই উন্নতি! বলা হয় না মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপের দেশগুলোতে আধুনিক যুগের দাসত্বের কথা ……….. নাম দেয়া হয় “রেমিট্যান্স”!! গ্রামের অভাবী মেয়েগুলো “কাজের মেয়ে” থেকে “গার্মেন্টসের মেয়ে”-তে পরিণত হয়, কিন্তু বদলায় না “ভাগ্য”।
সারাদিন সারারাত চলে মেশিনের শব্দ চার দেয়ালের কয়েদখানায় ……….. বেড়ে চলে “মালিক পক্ষের” ব্যাংক ব্যালেন্স, বেড়ে চলে ইউরোপ/ আমেরিকার আরো বড় “মালিক পক্ষের” বিলাসিতা!! কিছু মানুষ বাংলাদেশে বাস করেই ভোগ করেন মধ্যপ্রাচ্য/ ইউরোপ/ আমেরিকার ধনী মানুষের বিলাসী জীবন! আর সেই গার্মেন্টসের মেয়েটি পায় মরিচ পোড়া/ আলু ভর্তার জায়গায় হয়ত কোনো সব্জি বা কালে ভদ্রে ডিম খাবার ভাগ্য! ভাবি এই “ভাগ্য” জিনিসটা কি? এবং কেন?
আমাদের স্মৃতিশক্তি গোল্ডফিশের মত। তাই দু’দিনের দু’ফোঁটা অশ্রু ত্যাগ, কিছু টাকা দান ………… তারপর ভুলে যাওয়া!! আর ভুলে যাই বলেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি!! অনেকেরই ব্যস্ত হয়ে যাওয়া কি ভাবে মধ্যবিত্ত থেকে সেই “মালিকপক্ষের” মত হওয়া যায়। না কেউ শ্রমিকশ্রেণীর কথা সত্যিকার অর্থে ভাবে না। ভাবলেও তা নেহায়েত এই সব ট্র্যাজেডির সময়!
অগাস্ট ৩১, ২০১৩: রানা প্লাজা এখন অধিকাংশের কাছে অতীত! অংকুরের হয়ে সামান্য কিছু করবার জন্য এক বন্ধু কাজ করছেন। আজ সাভার থেকে ঘুরে এসেছে। তার না বলা (সামান্যই বলা) কথা থেকে বুঝতে অসুবিধা হয়নি কি অবস্থা মানুষগুলোর! না কাউকে প্রশ্ন করবো না, এত এত কোটি কোটি টাকা কোথায় গেলো! এটুকু বলে যাই, আমাদের ছোট্ট স্বেচ্ছাসেবক প্রতিষ্ঠানে (অংকুর, যা প্রধানত বাংলাদেশের মানুষের জন্য কাজ করে) কেউ দশ ডলার দিলেও তা কোথায় কি ভাবে এবং পুরো দশ ডলারই সেখানে ব্যয় হচ্ছে তা জানাই। আমি বন্ধুকে প্রশ্ন করেছিলাম যে, এরা ঘুমায় কি ভাবে?
লেখক: যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী।