প্রেম, বহুগামিতা ও পরকীয়া সমাচার

নাদিয়া ইসলাম:

গত কয়েকদিনের ফেইসবুকের লাফালাফির প্রধান বিষয় ছিলো পরকীয়া। এক পক্ষ পরকীয়ারে সাপোর্ট করেন, অন্য পক্ষ করেন না।

আসলে পরকীয়া কী?

পরকীয়া হইলো বিবাহিত মানুষজনের স্বামী বা স্ত্রীরে গোপন কইরা বা প্রকাশ্যে স্বামী বা স্ত্রী ব্যতিত অন্য কোনো মানুষ বা মানুষদের সাথে বিবাহবহির্ভূত এবং/অথবা বিবাহত্তোর কোনো প্রেম বা যৌন সম্পর্ক বা ভালোবাসার সম্পর্ক স্থাপন, যা সমাজ, ধর্ম এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের চোখে অনৈতিক এবং/অথবা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। পরকীয়ারে পৃথিবীর প্রায় সকল সমাজেই নেতিবাচক আচরণ ও সামাজিক ব্যাধি হিসাবে ধরা হয়।

অথচ বৈষ্ণব শাস্ত্র মতে পরকীয়া হইলো পরমেশ্বরের সঙ্গে প্রেম। সুফিবাদেও তাই। গৌরচন্দ্রিকায় আছে, “স্থূল সুখ অপেক্ষা সূক্ষ্ম সুখের দিকে অগ্রসর হওয়া হবে মানব জীবনের ব্রত। ভোগ-বিলাস, বাসনা-কামনার মাঝে যে সুখ তা অবশ্যই স্থূল। মানুষ ওসবের আজ্ঞাধীন হবে না। কিন্তু ওসব কেনোক্রমে বর্জনীয় হতে পারে না।” কিন্তু আজকের সাম্রাজ্যবাদী দিনে এইসব মানে কে?

মানুষের মনস্তত্ব খুব জটিল একটা জিনিস, প্রেম বা ভালোবাসা তার থিকাও জটিল। কিন্তু প্রেম, ভালোবাসা ও মনস্তত্বের মত জটিল জিনিসরে সমাজ, ধর্ম এবং রাষ্ট্র ‘বিয়া’ নামক এক প্রতিষ্ঠান মারফত অতি সহজ কইরা তুলছে। যেন এক পক্ষরে অন্য পক্ষ বিয়া করলেই উনাদের মধ্যে ওহী নাযিল হওয়া স্টাইলে প্রেম হইয়া যাইতে বাধ্য। আগের দিনে ঐভাবে প্রেম হইতো সন্দেহ নাই। জামাই বউ একজন অন্যজনরে চিনেন না, বাপ মা ধইরা বিয়া দিয়া দিলেন, আর উনারা ফুলশয্যার রাতে একজন অন্যজনের দিকে লজ্জা লজ্জা চোখ নিয়া তাকাইয়া বা একদিন উনারে কাইত হইয়া ঘুমাইতে দেইখা বা ভাত খাওয়ার পরে পান চিবানোর স্টাইল দেইখা একে অপরের প্রেমে পইড়া গেলেন।

কিন্তু যদি বিয়ার পরে আপনার অন্যপক্ষের সাথে প্রেম না হয়, তাইলে আপনি কী করবেন? যদি ফুলশয্যার রাতে আপনার স্বামী আপনারে ধর্ষণ করেন, বা আপনার স্ত্রী যেই ভঙ্গিতে শাড়ি পরেন, তা আপনার পছন্দ না হয়, তাইলে আপনি কী করবেন? বিয়ার পরে আপনার স্ত্রীরে ভালো না লাইগা ভাইয়ের বউরে ভালো লাইগা গেলো, আর আপনি লিখা ফেললেন, “তোমারেই করেছি জীবনের ধ্রুবতারা!”- তখন কী হবে? ধরেন অনেক বছর ‘নৈতিকভাবে সুস্থ’ বিবাহিত সম্পর্কের পরে একদিন আপনার এমন একজনের সাথে পরিচয় হইলো, যারে দেইখা আপনার মনে হইলো, ইনারেই আপনি সারাজীবন ‘খুঁজতেছেন’, তখন কী হবে? যদি তিরিশ বছর স্বামী বা স্ত্রীর সাথে ঘর করার পরে এখন আর স্বামী বা স্ত্রীর আচরণ আপনার ভালো লাগে না, সংসারের ঘ্যানঘ্যানানিতে আপনি অতিষ্ট, ক্লান্ত- এখন আপনার একজনের সাথে পরিচয় হইলো, যার সাথে আপনি বাজারের ফর্দের বাইরে, বাচ্চার অসুখের বাইরে কোয়ান্টাম মেকানিক্স কিংবা আকিরা কুরুসাওয়া নিয়া গল্প করতে করতে গাইয়া ফেললেন, “যোইগি তঁই বিণু খনহিঁ ন জীবমী, তো মুহ চুম্বী কমলরস পীবমী।”- তখন কী হবে?

রাষ্ট্রীয় আইনে প্রেমরে সংজ্ঞায়িত করা সম্ভব না। তাই রাষ্ট্র ‘প্রেম’রে বিয়ার পরে শুধু স্বামী এবং স্ত্রীর মধ্যে নির্ধারিত বা নির্দিষ্ট বা বৈধ কইরা দিয়া বাকি সব সম্পর্করে অবৈধ বানায়ে দিছে। অর্থাৎ, বিয়ার পরে আপনি অন্য কারো প্রেমে পড়লে তা রাষ্ট্রীয় আইনে অপরাধ হয়। রাষ্ট্র তার নিজস্ব হিসাবনিকাশ কইরা রায় দিয়া দিছে, বিয়ার পরে প্রেম সমাজের জন্য ক্ষতিকর। কারণ, বিয়ার সাথে বংশপরিক্রমা, সম্পত্তির উত্তরাধিকার, সন্তানের ভবিষ্যত ইত্যাদি বিষয় জড়িত। রাষ্ট্রের কাছে স্বামী স্ত্রীর মনস্তত্বের চাইতে সন্তানের মনস্তত্ব গুরুত্বপূর্ণ; রাষ্ট্র তার সমাজ কাঠামো এ্যামনেই ঠিক কইরা দিছে যে পরিবারহীন বা সিঙ্গেল মায়ের সন্তানরা মানসিক বৈকল্য ধারণ করেন এবং তার ফলশ্রুতিতে মানসিক হীনমন্যতা, অপরাধপ্রবণতা বাইড়া যায় বইলা গবেষণায় প্রমাণ হইছে। সেইকারণে আপনার বিবাহবহির্ভূত প্রেমরে অবদমন করাইয়া, নিজের ভালো লাগারে গুরুত্ব না দিতে শিখাইয়া রাষ্ট্র আপনারে শিখাইছে সন্তানের ভালো লাগারে গুরুত্ব দিতে। কারণ আপনার সন্তান রাষ্ট্রের ভবিষ্যত তাবেদার, পুঁজিবাদী সমাজের নতুন ওয়ার্কিং ফোর্স। আপনিও ভবিষ্যত তাবেদার তৈরির পথে রাষ্ট্রের স্বার্থে নিজের সুখরে বিসর্জন দিয়া রাষ্ট্রের আজীবন তাবেদারী করতেছেন এই ভাইবা যে ‘বিয়ে একটি পবিত্র বন্ধন’।

বিয়া প্রাতিষ্ঠানিক সমাজের জন্য জরুরী- সন্দেহ নাই। কিন্তু মানুষের মন তো সমাজ বা রাষ্ট্র দিয়া চলে না। রাষ্ট্র প্রেমরে অস্বীকার করলেও প্রেম তো সেই স্বীকার অস্বীকারের ধার না ধাইরা সমানে ‘আমি রজনীগন্ধা ফুলের মত গন্ধ বিলিয়ে যাই’ স্টাইলে মানুষের মনে ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে নিজেরে বিলাইয়া বেড়াইতেছে। আপনি সেই প্রেমরে অবদমন করতে পারেন, সন্দেহ নাই- আপনি “আমি সারাজীবন আমার স্বামী/স্ত্রীর প্রতি বিশ্বস্ত থাকবো” এই মর্মে প্রতিজ্ঞা কইরা নিজের প্রেমরে গোপনে ঢোক গিলা খায়ে ফেলতে পারেন, সন্দেহ নাই; কিন্তু সবাই তো আপনার মত নৈতিকতার ধজ্বাধারী না, সবাই তো নিজের মনের উপর রাষ্ট্রের খবরদারী সহ্য করেন না, সবাই তো নিজের উপর নিজের অত্যাচার করার ক্ষমতা রাখেন না। তাই পরকীয়া সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আপনি তারে ঘৃণা করতে পারেন, আপনার স্বামী/স্ত্রীর পরকীয়ায় আপনার সুখের সংসার ভাইঙ্গা যাইতে পারে, আপনার স্বামী/স্ত্রীর ‘অনৈতিকতায়’ আপনার সন্তানের ভবিষ্যত অনিশ্চিত হইয়া যাইতে পারে, কিন্তু আপনি অন্য মানুষের মনের উপর জোর করতে পারেন না। আপনি জোর কইরা অন্য একজনরে দিয়া আপনারে সারাজীবন ভালোবাসাইতে পারেন না। আপনি জোর কইরা নিজেও অন্য একজনরে সারাজীবন একই স্টাইলে একই পরিমাণ ভালোবাসতে পারেন না।

অনেকেই কইবেন, “ভালো না লাগলে ছাইড়া চইলা যাও, মিথ্যার দরকার কী?”; খেয়াল কইরা দেখেন, ডিভোর্স দেওয়ার কি সহজ কোনো রাস্তা আছে কীনা। খেয়াল কইরা দেখেন, ডিভোর্স দেওয়ার আগে কেইস ফাইল করার সময় ডিভোর্সের কারণ হিসাবে আপনারে কী কী লিখতে হয়। আপনি স্বামী/স্ত্রীর মারফত নির্যাতিত হইলে, আপনার স্বামী/স্ত্রী ব্যাভিচার করলে, আপনার স্বামী/স্ত্রীর সাথে বনিবনা না হইলেই শুধু ডিভোর্সের এ্যাপ্লাই করতে পারবেন। অর্থাৎ আপনি আপনার স্ত্রীরে ভালোবাসার পরেও আরেক মেয়ের প্রেমে পড়লে রাষ্ট্র আপনারে ডিভোর্স দিতে দিবে না। কারণ আগেই বলছি, রাষ্ট্র নিজের পুঁজিবাদী স্বার্থেই আপনার মাধ্যমে বিয়া টিকাইয়া রাখতে চায়।

আগেই বলছি, মানুষের মনস্তত্ব অত্যন্ত জটিল বিষয়। আমি একজনরে চিনি, ধরা যাক উনার নাম তানিয়া। তো তানিয়া একজন বিবাহিত মেয়ে। উনার স্বামী অত্যন্ত ভালোমানুষ, কিন্তু তানিয়ার সাথে উনার মনের মিল নাই। কাজের সূত্রে তানিয়ার একজনের সাথে পরিচয় হইছে, ধরা যাক উনার নাম শামীম। এই শামীম ভদ্রলোকও বিবাহিত। তানিয়া এবং শামীমের যৌন সম্পর্ক নাই, উনারা শুধু একে অন্যের সাথে গল্প করতেই ভালোবাসেন। কারণ উনাদের স্বামী/স্ত্রী উনাদের গল্প শুনতে আগ্রহী না। আমি তানিয়ারে বললাম “আপনার স্বামীরে ডিভোর্স দিয়া আপনি শামীমরে বিয়া করতেছেন না ক্যানো?” তানিয়া কইলেন, উনি উনার স্বামীরেও ভালোবাসেন, শামীমরেও ভালোবাসেন। দুইজনরে দুই কারণে। অপরপক্ষে শামীমেরও উনার স্ত্রীরে ডিভোর্স দেওয়া সম্ভব না, কারণ সেই ডিভোর্সের সাথে টাকা পয়সা সম্পত্তি সন্তানের কাস্টডি ইত্যাদি বিষয় জড়িত। সুতরাং তানিয়া-শামীমের পরকীয়া চলতেছে। এই পরকীয়ারে আমি খারাপ চোখে দেখি? না। এই পরকীয়ারে আমি অপরাধ বলি? না। আমি তানিয়ারে খারাপ মেয়ে, ব্যাভিচারিনী, নষ্টা বলি? না। আমি শামীমরে অনৈতিক, যৌন কুড়কুড়ানিওয়ালা নোংরা পুরুষ বলি? না।

এই দুনিয়াতে যৌন কুড়কুড়ানিওয়ালা পুরুষ এবং নারীর অস্তিত্ব আছে অবশ্যই। উনারা নিজেদের অবদমিত যৌনতারে পরকীয়ার নাম দিয়া ব্ল্যাকমেইল, ধর্ষণ, নিপীড়ন ইত্যাদি প্র্যাকটিস করেন, অফিসের অধস্তনরে চাকরি টিকাইয়া রাখার ভয় দেখাইয়া, কিছু অসতর্ক মূহুর্তের ছবি বাজারে ছাইড়া দেওয়ার ভয় দেখাইয়া পরকীয়াতে বাধ্য করেন, সন্দেহ নাই। কিন্তু আমার আলোচনা শুধুমাত্র বিবাহবহির্ভূত প্রেম নিয়া, পরকীয়া চর্চার মাধ্যমে ফৌজদারি অপরাধ আমার আলোচনার বিষয় না।

বহুগামিতা মানুষের মনস্তত্বের অংশ। পুরুষের ক্ষেত্রে এই বহুগামিতা নৈব নৈব চঃ হইলেও, প্রচুর প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মে পুরুষের বহুবিবাহ এ্যাক্সেপ্ট করা হইলেও দুনিয়াতে দ্রৌপদী একজনই ছিলেন, কোনো ধর্মেই মেয়েদের বহুগামিতারে ভালো চোখে দেখা হয় নাই। বহুগামিতা পুরুষের একলার মনস্তত্ব না। মেয়েরাও সমানতালে পুরুষের মতই বহুগামী; কিন্তু ধর্মের নামে মেয়েদের এই বহুগামিতারে দমন করা হইছে মেয়েদের সন্তানজন্মদানের ক্ষমতারে কেন্দ্র কইরা। মেয়েদের শিখানো হইছে নিজের যৌনতারে অপ্রকাশিত রাখতে, উনাদের বুঝানো হইছে নিজেদের সৌন্দর্য্য শুধু স্বামীর উপভোগের বিষয়, উনাদের পড়ানো হইছে যৌনতা খারাপ, যৌনতা নিয়া কথা কওয়া যায় না, উনাদের বাধ্য করা হইছে যৌন সম্পর্কে অসন্তুষ্ট থাকলেও তা নিয়া উচ্চবাচ্য না করতে। বেশিরভাগ আধুনিক মেয়েও তাই যৌন জীবনে অসুখী হওয়ার পরেও বহুগামিতারে নোংরা চোখে দেখেন।

না, পরকীয়া করার সাথে নারী স্বাধীনতা ফাধিনতা এই জাতীয় কোনো কিছুর সম্পর্ক নাই। “পুরুষ পরকীয়া করতেছেন, তাই আমিও করবো!” বইলা লাফানোরও কিছু নাই। আপনি মিথ্যারে ঘৃণা করলেও মিথ্যা বা হিপোক্রিসি যেমন সমাজ চালানোর গুরুত্বপূর্ণ অংশ, সমাজে সকল লোক সত্যবাদী যুধিষ্টির হইয়া গেলে যেমন সমাজ চলবে না, তেমনি পরকীয়াও সমাজ চালানোর গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কিন্তু এই অংশ সমাজ পরিচালনা করার সাদা-কালো এলাকাতে থাকে না, থাকে সাদা-কালোর মধ্যবর্তী গ্রে এরিয়াতে। আর এই গ্রে এরিয়ার দৈর্ঘ্য অপরিসীম।

হ্যাঁ, সমাজে পরকীয়ারে আইনসম্মত করা যাবে না, কারণ সমাজের নিজের অস্তিত্বের প্রশ্নে পরকীয়ার সামাজিক স্বীকৃতি ক্যান্সারস্বরূপ। অর্থাৎ পরকীয়ারে আইনসম্মত করতে হইলে সমাজ ভাইঙ্গা গুঁড়াগুঁড়াগুঁড়াগুঁড়া হইয়া যাবে। তাই পরকীয়া সমাজে থাকবে, মিথ্যা কথা সমাজে থাকবে, হিপোক্রিসি সমাজে থাকবে; আপনার ঘৃণা সহকারেই থাকবে। গোপনে থাকবে, কিন্তু থাকবে।

তাই আপারা, আপনারা যারা পরকীয়ারে ‘স্বকীয়া’ বানানোর হাস্যকর নারী আন্দোলনে নামছেন, তারা এইবেলা অফ যান। পরকীয়ার সাথে নারী স্বাধীনতা জড়িত না, পরকীয়ার সাথে মানুষের জটিল মনস্তত্ব, প্রেমের মত জটিলতর হিসাব এবং নারী-পুরুষের স্বাভাবিক সহজ বহুগামিতা জড়িত। মানুষরে ‘নৈতিক’ শিক্ষা দিয়া, ধর্মের দোররার ভয় দেখাইয়া আপনি প্রেম আটকাইয়া রাখতে পারবেন না। একই বেগুন ভর্তা ডাইল দিয়া আপনি প্রতিদিন আপনার স্বামী/স্ত্রীরে সাদা ধ্যাদধ্যারা ভাত খাওয়াইতে পারবেন না। আপনার স্বামী/স্ত্রীর মাঝেমধ্যে নারিকেল দিয়া শোল মাছের ঝোল, চিংড়ির মালাইকারি, কাঁচা তেঁতুল দিয়া চাপিলার অম্বল, চিতল মাছের কোপ্তা, বোয়াল মাছের ডিমের টক ঝোল, কুমড়াপাতায় টাকি মাছের চপ, ফরিদপুরের লাউডগা দিয়া ইলিশ এইসব খাইতে মন চাইতেই পারে। এবং তাই আপনার, আপনার ডাক্তারের এবং রাষ্ট্রের স্বৈরশাসনে আপনার স্বামী/স্ত্রী সেই খাওয়াদাওয়া প্রকাশ্য করবেন না এইটাই স্বাভাবিক।

আধুনিক ভারতীয় উপমহাদেশে যৌনতা এক অতিনোংরা অতিগোপনীয় অতিলজ্জাকর কাজ। শ্রী রজনিশ যৌনতার কামরে কলারূপে দেখাইছিলেন, তিনি বলছিলেন, “যৌনতা হওয়া উচিত খেলাচ্ছল এবং প্রার্থনাময়” কিন্তু আধুনিক পুঁজিবাদী সমাজে যৌনতারে বিয়া নামক প্রতিষ্ঠান মারফত এত ম্যাড়ম্যাড়া ভাতের মাড় বানাইয়া ফেলা হইছে যে, মানুষ স্বাভাবিকভাবেই অতিগোপনে পরকীয়ার মত উত্তেজনাপূর্ণ শারিরীক এবং মানসিক সম্পর্কে জড়ায়ে যাইতে দ্বিধা করেন না। নাসরিন জাহান, উনার ‘নারীর প্রেম ও তার বিচিত্র অনুভব’ বইতে কইছিলেন, “নারীরা ঝঞ্ঝাটহীন নির্মল প্রেমকে পূজা করে, কিন্তু আকাঙ্ক্ষা করে রোমাঞ্চপূর্ণ নিষিদ্ধ প্রেম।” এই কথা আমি পুরুষের জন্যও সত্য ধরি। মেয়েরা পুরুষের তুলনায় ইন্দ্রিয়নির্ভর, স্পর্শনির্ভর প্রাণী, মেয়েদের যৌনতা অনেক বেশি শারিরীক এবং মানসিকভাবে একত্রিত, সেই তুলনায় পুরুষের মন এবং শরীর আলাদাভাবে কাজ করতে পারে বইলা উনারা মনরে যুক্ত না কইরা অনেকক্ষেত্রেই শুধুমাত্র শরীর দিয়া কারো সাথে সম্পর্কযুক্ত হইতে পারেন। কিন্তু এরপরেও শুধুমাত্র যৌনতা দিয়া পরকীয়ারে সংজ্ঞায়িত করা যায় না, শুধুমাত্র পুরুষতন্ত্র শুধুমাত্র নারীবাদ দিয়া পরকীয়ার মনস্তত্বরে বোঝা সম্ভব না। তাই আপনারা যারা পরকীয়ারে নারীস্বাধীনতার শুরু বইলা চিহ্নিত করার চেষ্টা করতেছেন, তারা আগে নারীবাদ সম্পর্কে পড়ালেখা করেন, মানুষের মনস্তত্ব সম্পর্কে পড়ালেখা করেন, এরপর এইসব নিয়া কথা বলা শুরু কইরেন। তার আগে না।

আমি বিয়া নামক প্রতিষ্ঠানে বিশ্বাস করি না। আমি প্রেমে বিশ্বাস করি। এবং বিশ্বাস করি, বিয়া নামক খবরদারি প্রতিষ্ঠান যতদিন পৃথিবীতে আছে, ততদিন প্রেমরে, যৌনতারে এইভাবেই নিষিদ্ধ কইরা রাখা হবে, ততদিনই পৃথিবীতে এইভাবে গোপনে গোপনে পরকীয়া থাকবে। সমাজ যতদিন থাকবে, ততদিন পরকীয়া প্রকাশ্য হইতে পারবে না, আর সমাজই যদি না থাকে, তাইলে ‘পরকীয়া’ ‘স্বকীয়া’ এইসব টার্মও থাকবে না হিহি। সুতরাং “পরকীয়া প্রকাশ্যে হোক” বইলা ফেইসবুকে গলা ফাটাইয়া চিল্লাইলে আপনার বুদ্ধিহীন স্ববিরোধী কথা বার্তা শুইনা মানুষের একটু আমোদ হবে, পরকীয়াহীন জীবনে একটু উত্তেজনার আমদানি হবে সন্দেহ নাই, কিন্তু পরকীয়া নিজ নিজ জায়গায় গোপনই থাইকা যাবে। কারণ গোপনীয়তাই তার ধর্ম।

তাই আপনি যদি বিয়া ঘৃণা না করেন, পরকীয়ারেও ঘৃণা করতে পারবেন না। আপনি পানিরে, নদীরে, সমুদ্ররে ঘৃণা না কইরা যদি মাছরে ঘৃণা করেন, বলেন, “মাছ ক্যানো বাঁচে?” তাইলে যেমন বুদ্ধিহীন দেখাবে, তেমনি বিয়ারে নমঃ নমঃ কইরা “পরকীয়া ক্যানো আছে?” বললেও ঠিক একইপ্রকার বুদ্ধিহীনই দেখাবে আপনারে।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.