ফারদিন ফেরদৌস:
বাঙালি গালাগাল করতে করতে টায়ার্ড হয়ে গিয়ে নায়িকা পরীমনির বিশাল ফ্যান হয়ে গেছে।
ফেসবুকে পরীমনির অনুসারী এখন এক কোটি সাইত্রিশ লাখ। গত ৪ আগস্ট অ্যারেস্ট পূর্ববর্তী তার নিজের পেজের লাইভ ভিডিওটি ইতোমধ্যে দেখা হয়েছে চার কোটি বারের বেশি। দেড় লাখ শেয়ার এবং প্রায় দুই কোটি রিঅ্যাকশন এসেছে। ডিজিটাল বিজনেস অ্যানালিটিকরা বিস্মিত। বাকরুদ্ধ। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে এর আগে এমনটা তারা দেখেন নাই কখনও।
আমি পারভার্টেড নেটিজেনদের রিঅ্যাকশনের ভাষা অ্যানালিসিস করবো না। এটা তো সত্য যে এরা পরীমনি নামের একটা মানবীয় অস্তিত্বকে টাচ করতে চেয়েছে। তাদের ভাষায় এতোটা জঘন্য খারাপ একটা মেয়েকে এইসব ডেসপারেট জ্বীন নেটিজেনরা ইগনোর করতে পারে নাই। কেন পারে নাই? কী জাদু পরীতে?
নিশ্চয়ই ম্যাজিক আছে।
গেল ডিসেম্বরে এশিয়ার ১০০ ডিজিটাল তারকার তালিকা প্রকাশ করে আমেরিকার প্রখ্যাত বিজনেস ম্যাগাজিন ফোর্বস। সেখানে বাঘা বাঘা তারকার সঙ্গে ছিলেন বাংলাদেশের অভিনেত্রী পরীমনি। ওই তালিকায় ছিল অমিতাভ বচ্চন, অক্ষয় কুমার, শাহরুখ খান, মাধুরী দীক্ষিতসহ বেশ কয়েকজন বলিউড তারকার নাম। ডিজিটাল মাধ্যমে প্রতিনিয়ত ঝড় তোলা এশিয়া–প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের এ রকম ১০০ জন কণ্ঠশিল্পী, ব্যান্ডশিল্পী, চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন শিল্পীকে এ তালিকায় রাখা হয়েছে।
প্রকাশিত ওই তালিকায় পরীমনি সম্পর্কে লেখা হয়েছিল, ফেসবুকে প্রায় এক কোটি অনুসারী রয়েছে পরীমনির। তাঁর প্রকৃত নাম শামসুন্নাহার স্মৃতি।
এই সময় পরীমনির পপুলারিটির ধারেকাছে অন্য কোনো বাঙালি শিল্পী আছে? নাই। তাই ঈর্ষাপরায়ণ বাঙালি শিল্পী ও বুদ্ধিজীবী সমাজ পরীমনি ইস্যুতে মুখে কুলুপ এঁটেছেন। প্রথম আলো, ডেইলি স্টার, আজকের পত্রিকা এবং মাছরাঙা টেলিভিশনের মতো হাতেগোণা দু চারটা গণমাধ্যম ছাড়া বাকিরা নষ্টস্রোতে গা ভাসিয়েছে।
নানা দুর্ঘটনা ও দুর্বিপাকে পড়ে শামসুন্নাহার স্মৃতি যখন আবাল্যেই পিতৃমাতৃহীন এতিম হয়ে পড়েন সেসময় নানা শামসুল হক তাকে পরম মমতায় আগলে রাখেন। নিয়তির কী লিখন এইসময় এসেও সেই বর্ষিয়ান নানাই পিতৃব্যের দায়দায়িত্ব নিয়ে বিপাকে পড়া স্মৃতির মুক্তির আশায় নিয়ে নির্ঘুম প্রহর গুনছেন।
আদালতে পরীমনির শতবর্ষী ওই নানাকে রিপোর্টার প্রশ্ন করছেন…
: আপনার নাতির ঘরে যে এতো এতো মাদক-টাদক পাওয়া গেছে, আপনি তো সে বাসায় থাকতেন, কিছু বলেন?
: না, আমি এসব কিছু দেখিনি, খালি বোতল-টোতল কিছু ছিল হয়তো, নানা উত্তর দিলেন।
এবার রিপোর্টার শুধালেন…
: আপনি কি আপনার নাতির মুক্তি চান?
: হ, আমি আমার নাতির মুক্তি চাই।
আচ্ছা আপনারা বলেন, পরীমনি ইস্যুতে তার অশীতিপর নানাকে বিব্রত না করলে কি জাঁদরেল সাংবাদিকতা মাঠে মারা যেত?
এমন বাস্তবতায় মাত্র তিনজন মানুষকে ব্যতিক্রম দেখলাম। ভাষাসৈনিক, কলামিস্ট ও সাংবাদিক আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী, জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র নির্মাতা কাজী হায়াৎ ও আবু সাইয়ীদ।
চিত্রনায়িকা পরীমনির বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে একটি আবেদন জানিয়েছেন বর্ষীয়ান লেখক আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী। এছাড়াও তিনি বেশ কয়েকটা লেখা লিখেছেন।
গেল সোমবার আবেদনটি তিনি গণমাধ্যমে পাঠান। আবেদনে লন্ডন প্রবাসী প্রবীণ এই সাংবাদিক লিখেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে এটি তার একার আবেদন নয়। দেশে প্রশাসন, একটি বিত্তশালী গোষ্ঠী এবং মিডিয়াগোষ্ঠী মিলে ২৮ বছরের এক তরুণীকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করার যে ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে সে সম্পর্কে সচেতন নাগরিক সমাজের আবেদন।
তিনি লিখেন, ‘পরীমনিকে গ্রেপ্তারের জন্য দু’চার জন র্যাব কিংবা পুলিশ সদস্য গেলেই হতো, সেখানে যে আয়োজন করা হয়েছিল তাতে মনে হয়েছিল কোনো ভয়ংকর ডাকাতকে গ্রেপ্তারের জন্য এই যুদ্ধযাত্রা। গ্রেপ্তারের পর থেকেই পরীমণির বিরুদ্ধে একটার পর একটা স্ক্যান্ডাল ছড়ানো হচ্ছে। এটা বোঝাই যায় কোনো একটি মহল থেকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে এগুলো করা হচ্ছে। অর্থাৎ বিচারের আগেই বিচার।
বুদ্ধিজীবীদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘দেশের সচেতন বুদ্ধিজীবী শ্রেণির কাছে আবেদন জানাই, তারা পরীমনির ওপর এই হেনস্থার প্রতিবাদ করুন। দয়া করে চুপ থাকবেন না। পরীমনির ওপর অত্যাচারের নিন্দা জানিয়ে মিডিয়ার কাছে অনুরোধ করে বলেন, তারা যেন অত্যাচারিতের পক্ষে দাঁড়ান, অত্যাচারী গোষ্ঠীর পক্ষে না যান।’
নির্মাতা কাজী হায়াৎ প্রশ্ন করেন, স্মৃতিকে যাঁরা পরীমনি বানিয়েছেন, তাঁরা আজ কোথায়?
গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, পরীমনির সৌন্দর্যই পরীমনির শত্রু। এ কারণেই বেশির ভাগ মানুষ তাঁর সান্নিধ্যে গেছেন, যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। কাছে যাওয়া এসব মানুষই তাঁকে বিপথে ঠেলে দিয়েছেন। সবার কাছে প্রশ্ন রাখতে চাই, পিরোজপুরের স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী স্মৃতি ওরফে পরীমনি ঢাকায় আসার আগে কখনও কি হুইস্কি, বিয়ার, শিভাস রিগ্যাল, রেড লেবেল, ভদকা—এসবের নাম শুনেছিলেন? কারা এসব নামের সঙ্গে তাঁকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন? শুধু সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয়ে যাঁরা তাঁর কাছে গিয়েছেন, তাঁরা তাঁকে সুন্দর পথের সন্ধান দেননি।
সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয়ে যারা তাঁর কাছে ভিড়েছেন, তারাই পরীমনিকে বিপথে নিয়ে গেছেন। তারা পরীমনির সৌন্দর্যকে শিল্পসৃষ্টির কাজে লাগাননি। আজকের এই পরিণতির সেটাই হলো প্রধান কারণ।
পরীমনি ছিলেন অভিভাবকহীন। এই সুযোগও অনেকে নিয়েছেন। অনেকে হয়তো বলবেন, শুধু কি অন্যরাই বিপথে নেওয়ার জন্য দায়ী? তাঁরও কি বিচার-বিবেচনা থাকা উচিত ছিল না? আমি বলবো, জোর গলায় বলবো, যে বয়সে পরীমনি চলচ্চিত্রে এসেছেন, সে বয়সে বিচার-বিবেচনা সবার থাকে না। বয়সটাই আসলে এমন। যারা তাঁর পাশে ছিলেন, তাদের দায়িত্ব ছিল সঠিকভাবে তাঁকে পরামর্শ দেওয়া |
গ্রামের সহজ-সরল সেই স্মৃতিকে কারা এ রকম পরীমনি বানিয়েছেন? যারা করেছেন, তারা আজ কোথায়? তাদের নাম তো কোথাও শোনা যাচ্ছে না। তাদের তো হাত বেঁধে নিয়ে যাচ্ছে না পুলিশ!
অপরদিকে তড়িঘড়ি করে পরীমনির সদস্যপদ স্থগিতে শিল্পী সমিতির ভূমিকা রহস্যজনক বলে মন্তব্য করেছেন নির্মাতা আবু সাইয়ীদ।
পরীমনির সদস্যপদ স্থগিতের বিষয়ে গুণী এই পরিচালক তাঁর ফেসবুকে একটি পোস্ট দেন। সেখানে তিনি লিখেন, ‘পরীমনি বিষয়ে চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা ন্যাক্কারজনক।’
এই ব্যাপারে প্রথম আলোকে আবু সাইয়ীদ বলেন, ‘কোনো সংগঠনের কেউ যদি সদস্য হয়, তার বিরুদ্ধে যদি কোনো অভিযোগ আসে—সেটা সত্যতা খুঁজে বের করার চেষ্টা করা উচিত। পরীমনিকে কেবল তো সন্দেহজনকভাবে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পরীমনি হয়তো একটা সংগঠনেরই সদস্য, এই সময়টায় কোনো কিছু প্রমাণের আগে সদস্যপদ প্রত্যাহারের বিষয়টি ন্যাক্কারজনক মনে করেছি। মোটেও ঠিক হয়নি। সমিতির উচিত ছিল এই সময়টায় তার পাশে থাকা। তাঁর সঙ্গে দেখা করে কথা বলার দরকার ছিল। তার কোনো সহযোগিতা দরকার কী না তাও জানার চেষ্টা করা উচিত ছিল।
তিনি আরও বলেন, ‘আমার আসলে এখানে শুধু পরীমনিকে ফ্যাক্টর মনে হচ্ছে না। এর সঙ্গে আরও অনেক কিছু হয়তো জড়িত। পরীমনির ব্যাপারে শিল্পী সমিতির এমন সিদ্ধান্ত রহস্যজনক। বিষয়টা তো এমন না যে পরীমনির সদস্যপদ স্থগিত না করলে অরাজকতা তৈরি হবে। কেন এতো দ্রুত সিদ্ধান্ত নিল, শিল্পী সমিতির ভূমিকা সত্যিই রহস্যজনক।’
মোটের ওপর এই হলো পরীমনিকাণ্ডের ইতিবৃত্ত।
অপরাধ প্রমাণের আগেই পরীমনিকে অপরাধী সাব্যস্ত করে দিয়েছে আমাদের পুরুষতান্ত্রিক মগজ। অপরাধটা কী? বাসায় মাদক রাখা ও তা গ্রহণ করা।
১১ আগস্টের প্রথম আলোর কভার পেজে সানাউল্লাহ সাকিবের একটা নিউজ ছিল। শাহজাহান বাবলু বলে এক লুটেরা বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক থেকে ২০০ কোটি টাকা লোপাট করে নিয়ে দুবাইতে বিলাসী জীবনযাপন করছেন | ইউএই ও সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশে ব্যবসা ফেঁদে বসেছেন। তার কাছ থেকে অর্থ আদায় বা দেশে এনে আইনের আওতায় আনার ব্যাপারে কোনোপক্ষেরই ন্যূনতম আগ্রহ নেই। কে বড় অপরাধী? বাবলু নাকি পরীমনি?
বাবলুকে ধরা হবে না, বাবলু পুরুষ বলে? বাবলুকে ধরা হয় না, ব্যাংকের কিছু পুরুষ হর্তাকর্তা তার সহায়ক বলে?
অবস্থাদৃষ্টে অনুধাবন করাই যায় নারী অপরাধী হলে তাঁর চরিত্রের ওপর কলঙ্ক আরোপ করে মজা লুটবার দুরভিসন্ধিই হলো বাঙালির এখনকার প্রকৃত মানস। পুরুষ খুনি, ধর্ষক , লুটেরা বা দুশ্চরিত্রবান হলেও তারা তাদের প্রতিক্রিয়াশীল পুরুষ সতীর্থের কাছে পুরাই সাধু বা ধোয়া তুলসি পাতা।
১৯৮৪ সাল থেকে বাংলাদেশ সিডও সনদ স্বাক্ষরকারী দেশ। সিডও সনদ হচ্ছে একজন পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্তর্জাতিক দলিল বা চুক্তি।
নারীর প্রতি বিদ্যমান সকল প্রকার বৈষম্যমূলক কর্মকাণ্ড, রীতিনীতি, প্রথা ও চর্চা নিষিদ্ধকরণ এবং নারীর প্রতি বৈষম্য প্রদানকারী ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণের দায়িত্ব রাষ্ট্রের। এটাই সিডও সনদের মূলকথা।
তবে একশ্রেণির প্রতিক্রিয়াশীলদের বাধার মুখে ওই সনদের ৩০টি ধারার মধ্যে প্রধানতম দুটি ধারা এখনও বাংলাদেশ মেনে নিতে পারেনি।
ধারা –২: বৈষম্য বিলোপ করে নারী-পুরুষের মধ্যে সমতা স্থাপনের নীতিমালা গ্রহণ।
ধারা –১৬: বিয়েসহ সকল ব্যক্তিগত ও পারিবারিক বিষয়ে নারী-পুরুষের সমধিকার প্রতিষ্ঠা।
আলোচনা শেষে এই কথাটিই ক্লিয়ার হলো যে, এই দেশে নারীরা অপরাধ করলে তার জন্য কঠোর কঠিন বিচার। অপরাধ প্রমাণের আগেই নারীকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে দিতে হবে, আর পুরুষের অন্যায়কে মাপা হবে সহজ, সরল ও অবুঝ ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে।
পুরুষ নারীর ওপর চুটিয়ে লৈঙ্গিক রাজনীতি করবে, কৌশল খাটাবে। পপুলার নারীকে মধ্যমনি করে জটিলতর ইস্যুসমূহ ঢাকা দেবে। নারীর মন, মগজ ও রক্ত চুষে নেবে। তারপর নারীকে রিমান্ডে নিয়ে বলে দেয়া হবে, ‘তোরাই সকল নষ্টের মূল।’
এখন সেই মূলোৎপাটনই চলছে।
আর আমরাও চোখের সামলে ঝুলিয়ে রাখা মুলোয় বেশ মজে আছি, দুনিয়া তলায় যাক বা তলিয়ে যাক।
লেখক: সাংবাদিক, মাছরাঙা টেলিভিশন