এ্যানি হামিদ:
আমাদের একটা জাজমেন্টাল মন আছে, ওটাতেই আমার ভীষণ আপত্তি। কেননা আমাদের অগোচরেই ওই মনটা নানা বিপত্তি ছড়ায়। ‘সম্মতিক্রমে যৌন সম্পর্ক’! ব্যস্! এই দু’টো শব্দ মাথায় ঢুকে গেছে বলে আমরা ঘটনাটির আর উল্টো পিঠটা দেখতে পাচ্ছি না। দেখবার খুব একটা প্রয়োজনও নেই হয়তো। আমাদের অনেকের মনের মধ্যে অনেক জিজ্ঞাসা তৈরি হয়েছে, তবে প্রশ্নক্ষরণ বিষয়টি রক্তক্ষরণের ব্যাপারটিকে ছাপিয়ে যেতে পারলে বোধহয় কিছু উত্তর মিলতো।
আচ্ছা, যৌন সম্পর্কটি যদি সম্মতিক্রমেও হয় তাহলেও কি বিষয়টি মেনে নেয়ার মতো? প্রিয় মানুষটির ব্যথায় কুঁকড়ে যাওয়ার মুহূর্ততে অপর দিকের কারো কি কাঙ্খিত আনন্দ প্রাপ্তি সম্ভব? কিংবা তা না হোক ধর্ষণ, মানসিক সম্পর্কেও কি আমরা সেটা মেনে নিতে পারি?!
ঘটনাটি ধর্ষণ হলে তা অপরাধের আমলে আর সম্মতিক্রমে হলে বুঝি তার বাইরে চলে যাবে? ব্যাপারটি কিন্তু মোটেও তা নয়। যৌনাচারকে বিকৃত বলবার যে ব্যাখ্যা আমরা তৈরি করেছি সে ব্যাখ্যার আগে বয়:সন্ধিকালের শরীরী পরিবর্তন আর তা প্রকাশের যথার্থ স্পেস কি আমরা তৈরি করতে পেরেছি? পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সমাজ বা রাষ্ট্র এ কথা মানে তো যৌনতা নিয়ে কথা বলা অসংলগ্ন বিষয় নয়! আর বিকৃত যৌনাচারের ঘটনা নতুন নয়, খোঁজ নিয়ে দেখুন বাংলাদেশে পর্ণ আসক্তির কতভাগ নারী অসম্মতিতে বিকৃত যৌনাচারের মধ্য দিয়ে যায়। বলাৎকার যাকে আমরা ধর্ষণ বলি তাও কিন্তু একই উদাহরণের পথ ধরে। যে তৃতীয় লিঙ্গকে আমরা দূর দূর তাড়িয়ে দিই তারাও কিন্তু একই পথের পথিক।
আগামীতে ঘটনাটির মূল তথ্য সামনে যাই আসুক না কেন সোশ্যাল মিডিয়ার বিভিন্ন কমেন্টে মেয়ে বা নারীর প্রতি যে দৃষ্টিভঙ্গি তার কিন্তু খুব একটা পরিবর্তন হয়নি।
অপরাধ প্রতিটি স্তরে। আমরা যারা বলছি মেয়েটি একা কেন বাসায় গেলো, আমরা যারা সেক্স নিয়ে কথা বললে অ্যাডভান্সড মনে করি, আমরা যারা সেক্স ব্যাপারটিকে আড়াল করতে গিয়ে আরও কৌতুহল তৈরি করি, আমরা যারা ইন্টারনেটের অবাধ পর্ণোগ্রাফিকে বন্ধ করতে পারিনি, আমরা যারা এখনো আমাদের সন্তান বা ছোট ভাই বোনদের নিরাপদ সম্পর্ক বা যৌনতা নিয়ে ধারণা দিতে আড়ষ্ট বোধ করি; আমরা যারা বয়সের দোষ বলে মন্তব্য করছি অপরাধ কিন্তু আমাদের সকলের।
ভেবে দেখুন তো, আমরা এখন যে জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছি সেখানে, আপনার বাড়ির ছোট্ট শিশুকে নিয়ে টিভি পর্দার সামনে বসতে পারবেন তো? পারবেন তো উত্তর দিতে যদি সে জিজ্ঞেস করে পর্নোগ্রাফি বা বিকৃত যৌনাচার কী? কেন আমাদের শিশুরা অনিরাপদ? আপনি কি প্রস্তুত হাইমেন ছিঁড়ে যাওয়ার ব্যাখ্যা দেয়ার জন্য?ইউটিউব বা গুগল সার্চের সর্বাধিক ব্যবহৃত শব্দকে আপনি লুকাবেন কী দিয়ে?!
পুঁথিগত শিক্ষার সাথে সেক্স এডুকেশন বরাবরই জরুরি। এ প্রসঙ্গ আগেও উঠেছে, এখন আবারও। শুনুন। একটা গোটা আনুশকা বা দিহানময় সমাজ আপনার দিকে তাকিয়ে; এখনো সময় ফুরায়নি, নিজের সন্তান, বন্ধু বা আত্মীয়র সাথে আলোচনার পরিসর বৃদ্ধি করুন, বয়স ভেদে যেটুকু তথ্য দিয়ে তাকে সমৃদ্ধ করা যায় তার দায়িত্ব আপনিই নিন। যেসব জায়গায় প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব সব জায়গায় সরব হয়ে উঠুন।
নিশ্চই জানি, প্রকৃতি যা দেয় তার দ্বিগুণ ফিরিয়ে নেয়। সেক্স এডুকেশন আধুনিকতা বা ধর্মীয় পরিপন্থী নয়, এটি আমাদের মৌলিক জ্ঞান এমনকি অপ্রকাশ্যে `যৌনতা’ মৌলিক চাহিদারও একটি।
__ এ্যানি হামিদ, সমাজকর্মী