নারী হয়ে বেশি উড়লে পুরুষতন্ত্র এভাবেই তার ডানা ছেঁটে দেয়

নাহিদা নিশি:

পারসোনাল ইজ পলিটিক্যাল বলে একটা কথা আছে। কিন্তু আমরা কি সত্যিই জানি, কোনটা পারসোনাল আর কোনটা পলিটিক্যাল? আমরা লোকের ব্যক্তিগত জীবনে অনিমন্ত্রিত হয়েও ঢুকে পড়ি। বিশেষ করে নারীর জীবন। কোন মেয়ে কয়টা বিয়ে করলো, কতোবার ডিভোর্স করলো, কার সাথে শুলো, কীভাবে চুল কাটলো, কীরকম ড্রেস পরলো, কতো দামি গাড়িতে ঘুরে বেড়ালো, এইসবই আমাদের চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। নারীর জীবন নিয়ে রসালো রসালো গল্প সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় বড় বড় অক্ষরে ছাপানো হয়। যখনই কোনো নারী বিতর্কের মুখোমুখি হয়, তখন ইউটিউব, ফেসবুকে টেকা দায় হয়ে যায়। যেসব ঘটেনি, সেসব নিয়েও লোকে মনগড়া গল্প বানিয়ে বসে, কারণ সেসবই পাবলিক খায়, ভিউয়ার বাড়ে।

কলকাতার জনপ্রিয় অভিনেতা প্রসেনজিৎ তার জীবনে তিনটা বিয়ে করলেও কখনও কাউকে এটা নিয়ে কমেন্ট করতে শুনি না, কখনও তিনটা বিয়ের কারণে পাবলিক তাকে নোংরা গালি দেয় না। দেয়া উচিতও না। অথচ শ্রাবন্তীকে দেখেন, তার বিয়ে টিকছে না বলে পাবলিক তাকে একরকম বয়কটই করেছে। ইন্টারনেটে “শ্রাবন্তী” লিখে সার্চ দিন, দেখবেন শুধু যৌন সুড়সুড়িমূলক শিরোনামের ছড়াছড়ি! স্যোশাল মিডিয়ায় তাকে নিয়ে গালাগালির বন্যা!

আমাদের দেশের বিখ্যাত নায়ক শাকিব খানকে দেখেন, অপু এবং তাদের সন্তানের সাথে তিনি যেটা করেছেন, একই কাজ যদি কোনো নায়িকা তার স্বামীর সাথে করতো, বছরের পর বছর যদি কোনো নারী তার সন্তানের কথা গোপন রাখতো, তাহলে নির্ঘাত বাকি জীবনটা তাকে বারোভাতারী কিংবা মাল্টিপ্লাগ শুনে শুনে কাটাতে হতো। অথচ শাকিবের জনপ্রিয়তা একচুলও কমেনি, পাবলিক তাকে ক্ষমা করে দিয়েছে, জনপ্রিয়তা বেড়েছে তার।

“প্রভা”, “মিথিলা” কিংবা “মাহি” নামগুলো লিখে দেখুন, যতোসব নোংরা নিউজ চলে আসবে। কোনো পুরুষ সেলিব্রিটির সাথে এমনটা হয় না। তার মানে এই না যে, পুরুষেরা একের অধিক নারীর সাথে যৌনতায় যায় না। যায়, বরং বেশিই যায়। কিন্তু পুরুষ তো! পুরুষের সমস্ত দোষ সমাজ অম্লান বদনে ক্ষমা করে দেয়। কারণ পুরুষরা যা পারে, নারীরা তা পারে না কি!

পুরুষতান্ত্রিক এই দেশে বেশ কিছুদিন ধরে নায়িকা পরীমণির ব্যক্তিগত জীবনই হয়ে উঠেছে মিডিয়া এবং জনসাধারণের আলোচনার একমাত্র বিষয়। রাজনীতি, দুর্নীতি, মহামারী, খুন-ধর্ষণ সমস্ত খবরকে ছাপিয়ে গেছে পরীমণি। পরীমণী যখন বোট ক্লাবের বিরুদ্ধে, নাসিরের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ আনলো, স্যোশাল মিডিয়ায় টেকা তখন দায় হয়ে পড়েছিলো। মব ট্রায়ালের শিকার হয়েছিলো সে। তখন একটা কমেন্ট খুব ভাইরাল হয়ে গেলো, “বারো মাস পানিতে থাকা ব্যাঙ বলছে তাকে নাকি জোর করে ভিজিয়ে দেয়া হয়েছে”! শিক্ষিত, অশিক্ষিত, নারী, পুরুষ বেশিরভাগই এই কমেন্টকে সমর্থন করলো। বারো মাস কারো সাথে শুয়ে থাকলে কি কারো তাকে রেপ করার অধিকার জন্মে যায়? অনেকের সাথে যৌন সম্পর্কে গিয়ে থাকলে কি তার বিচার পাওয়ার অধিকার হারায়? সংবিধানের কোথাও এমন আইন আছে কিনা আমার জানা নাই। ‘ম্যারিটাল রেপ’ নামক জিনিসটার কথা ভেবে কষ্ট লাগছিলো। কী হবে এই আইনটার? বারো মাস স্বামীর সাথে শোয়া নারী কি স্বামীর বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ আনতে পারবে?

শেষপর্যন্ত পরীমণির বাড়িতে শ’খানেক র‌্যাব সদস্য অভিযান চালিয়ে পরীমণিকে গ্রেফতার করে নিয়ে গেছে। দাঁড়ান, হেসে নেই! আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাজ দেখে মনে হয়েছে বিশাল বড় কোনো জঙ্গি আস্তানায় তারা অভিযান চালিয়েছে, কিংবা বিশাল বড় দুর্নীতিবাজের বিরুদ্ধে এ্যাকশনে গিয়েছে। পরীমণির বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত একটা গ্রাউন্ডেই রাষ্ট্র ব্যবস্থা নিতে পারে, মাদকদ্রব্য রাখার অপরাধে। বাকি অভিযোগগুলো রাষ্ট্র করতে পারে না, কারণ রাষ্ট্রের অর্থ সম্পদ আত্মসাৎ করে সে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়নি, কারণ তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির কোনো অভিযোগ নেই। কারণ ছোটখাটো পোশাক পরার অপরাধে কাউকে গ্রেফতার করা যায় না, কারণ কারো সাথে শোয়াটা কোনো অপরাধে মধ্যে পড়ে না। আর যদি অপরাধ হয়েও থাকে, তার ওপর যদি দেহব্যবসার অভিযোগ থেকে থাকে, তাহলে অপরপক্ষে কারা ছিলো, সেটাও রাষ্ট্রকে খুঁজে বের করতে হবে। একা একা আর যাই হোক, ব্যবসা তো সম্ভব না। নারীর ব্যক্তিগত জীবনে ঢুকে পড়ে তাকে এক হাত দেখে নেয়া আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাজ না, এর মধ্যে রাষ্ট্রের কোনো বাহাদুরি নেই।

স্যোশাল মিডিয়ার কমেন্টবক্স দেখেও বোঝা যাচ্ছে, আমজনতা তার অপরাধ নিয়ে যতোটা চিন্তিত, তারচেয়ে অনেক বেশি চিন্তিত তার কাপড়-চোপর, বিলাসবহুল জীবনযাপন, দামী বাড়ি- গাড়ি, এসব নিয়ে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নারী-পুরুষ কেউই আসলে নারীর অর্থ-সম্পদকে সহ্য করতে পারে না। একধরনের ঈর্ষা থেকে তারা নারীর বিলাসবহুল জীবনযাপনের বিরোধীতা করে। বিরোধীতা করে নারীর শারীরিক ও মানসিক স্বাধীনতার।

পরীমণি রাষ্ট্রের কাছ থেকে সঠিক বিচার পাবে কিনা জানি না, তবে পাবলিকের বিচারে সে অলরেডি ফাঁসিতে ঝুলে গেছে। পাবলিকের বিচারে তার সবচেয়ে বড় অপরাধ হলো, সে দুশ্চরিত্র, সে ছোট কাপড় পরে, রাত-বিরাতে বাইরে থাকে, অনেকের সাথে শোয়, নারী হয়েও মদ খায়, দামি গাড়িতে চড়ে, ইত্যাদি ইত্যাদি। সর্বোপরি নারী হয়েও সে অনেক বেশি উড়তে শুরু করেছিলো। আর নারী হয়ে বেশি উড়লে পুরুষতন্ত্র এভাবেই তার ডানা ছেঁটে দেয়। তাকে পিতৃতান্ত্রিক উপায়ে সাইজ করে দেয়। কারণ “ব্যক্তিগত জীবন” কিংবা “চয়েস” বলে কোনো শব্দ নারীর ডিকশোনারিতে থাকতে নেই।

শেয়ার করুন: