একজন বাঁধন ও বাঙালির হিপোক্রেসি

তানিয়া তৃপ্তি:

দুই দিন ধরে এক বাঙালি নারীর ছবি আর গুণগান ফেসবুক জুড়ে ভেসে বেড়াতে দেখছি। অবশ্যই তিনি এসবের যোগ্য। তার কৃতিত্বে গর্বিত আমি নিজেও। কিন্তু প্রগতিশীল চিন্তাধারাময় এতো এতো ভালো ভালো পোস্ট দেখে মনে অনেক কথার জন্ম নিচ্ছে। তাই লিখতে আসলাম।

বাঁধনের ব্যক্তিগত জীবনের সবচেয়ে যে কথাটি পজেটিভভাবে বারবার সবার লেখায় বা কথায় আসছে তা হচ্ছে তার ডিভোর্স। আমি খুবই পুলকিত আর অবাক হচ্ছি যে বাঙালি সমাজ এতোটা প্রগতিশীল হয়ে উঠেছে যে ডিভোর্সকেও পজেটিভলি দেখছে। বাঁধন যখন অনেক বয়সের ব্যবধানের একজন লোককে বিয়ে করেছিলো তখন প্রকৃত কারণ বিশ্লেষণ ছাড়াই তার সমালোচনায় মুখরিত হয়েছিলো কারা বা যখন ডিভোর্স হয়েছিলো তখন তার গুষ্টি উদ্ধার করেছিলো কারা সেসব আমরা ভুলে যায়। সব ভুলে তার সাফল্যে যে অনেকেই খুশি হচ্ছে এটাও কম না। যদিও কয়েকদিন পর বাঁধন আর একটা বিয়ে করলে বা তার কোন প্রেমিকের সন্ধান পাওয়া গেলে তার সকল কৃতিত্বই এক নিমিষেই এই প্রগতিশীল সমাজের সমালোচনার বন্যায় ভেসে যাবে কয়েক মুহুর্তে। হয়তো শোনা যাবে বাঁধন পরিচালক বা কোন প্রভাবশালী ব্যক্তির সাথে শুয়ে শুয়ে কান চলচিত্র উৎসব পর্যন্ত গেছে। এখানে তার মেধা, কাজ বা কোন ডেডিকেশন লাগেনি, শরীর ছাড়া।

বাঁধন সেলিব্রিটি হলেও তার ডিভোর্সি জীবন সহজতর ছিলো বলে আমি মনে করি না। কারণ তাকে এই বাঙালি সমাজেই চলতে হয়েছে। এমনকি বাঁধনের সন্তানটি মেয়ে না হয়ে ছেলে হলে একজন নারীকে গার্ডিয়ানশিপ দেয়ার দুঃসাহস আমাদের সর্বোচ্চ আদালত করতো কিনা সে ব্যাপারেও আমি সন্দিহান। কান চলচিত্র উৎসবের মতো জায়গায় বাংলাদেশেকে রিপ্রেজেন্ট করে সম্মানিত করা, তাও আবার ঐতিহ্যবাহী জামদানী শাড়িতে; বাঙালিরা এটা দেখে পুলকিত নাকি বাঁধনের খোলা পিঠ দেখে বেশি পুলকিত, সে ব্যাপারেও আমি সন্দিহান। কারণ শরীরের বাইরে নারীর অন্য কিছু আছে এই বোধ বাঙালি সমাজে আছে বলে মনে হয় না।

বাঁধন সমাচার বা সোশ্যাল মিডিয়ার জগতের বাইরে আসি এবার একটু। আপনার আমার চারপাশেই অনেক ডিভোর্সি মেয়ে আছে। এই প্রগতিশীল সমাজ তাদের সাথে কেমন আচরণ করে তা শুধু সেসব মেয়েরা জানে। তার সামন্য কিছু চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করছি।

একজন মেয়ে নিজের পছন্দে বা পরিবারের ইচ্ছেই বিয়ের পর যখন বুঝে যে এই বৈবাহিক জীবনে সে ভালো নেই তখন সে এই সমাজের ভয়েই ডিভোর্স নিতে পারে না। অনেক সময় জীবনের রিস্ক নিয়েও শারীরিক, মানসিক সকল নির্যাতন সহ্য করে সংসার করে শুধু সমাজের ভয়ে। মেয়েদের পরিবারও তাদের পাশে থাকে না, সয়ে যেতে বলে শুধু সমাজ কি বলবে সেই ভয়ে। মেয়ে সেই সম্পর্কে থেকে মৃত্যু পর্যন্ত চলে যায় তখন কয়েকদিন কেঁদেকেটে মা, বাবাও ভুলে যান সেই মেয়েদের কথা।

মানসম্মান থাকবে না, লোকে কী বলবে সেটাই ডিভোর্স না নেয়ার অন্যতম প্রধান কারণ বলে প্রতীয়মান হয় অধিকাংশ ক্ষেত্রে। তাই বাধ্য হয়েই তার সকল স্বপ্ন সম্ভাবনা মাটি চাপা দিয়ে সংসারে সং সেজে থাকে। তারা সম্ভাবনাময় হলেও বাঁধনের মতো সাফল্যের মুখ দেখে না। তখন এই ফেসবুকের প্রগতিশীলরা কোথায় থাকেন? একবারও কি প্রতিনিয়ত নির্যাতিত হতে থাকা মেয়েটিকে গিয়ে বলেন যে, তুমি এই নরক থাকে বের হয়ে এসো, নিজের সম্ভাবনাগুলোকে বিকশিত করো, আমরা পাশে আছি? আর্থিক সহায়তা, বাসস্থান বা যেকোনো প্রয়োজনীয় সহায়তা না দেন, শুধু মানসিক সাপোর্ট বা সাহস কি কখনও দিয়েছেন কোন নির্যাতিত নারীকে?

ধরেন সব ভয় জয় করে কেউ পাশে না থাকলেও মেয়েটি সাহস করে একাই ডিভোর্স নিলো। তারপরের জীবনে আপনাদের ভূমিকা আরও বিভীষিকাময়। মেয়েটি আপনাদের সাপের মতো বিষাক্ত জিহবার ভয়ে জানাতে ভয় পায় যে সে ডিভোর্সি। কিন্তু জানাতে তো হয় বা আপনারা অতি আগ্রহী হয়ে জেনে নেন। তখন তার কাছের বন্ধু-বান্ধবী, সহকর্মী বা আত্মীয় স্বজন সবার আচরণই পাল্টে যায়। মেয়েটাকে যদি সরাসরি কিছু নাও বলেন, সামাজিক জীবেরা আচরণ দিয়ে তাকে এমন ফিল দেয়া হয় যে সে অস্পৃশ্য নিকৃষ্ট কীট। আশপাশের পুরুষগুলোর রূপ তখন অন্যরকম। ডিভোর্সি মেয়ে তারমানেই সে শোয়ার জন্য পাগল, পুরুষেরা একবার নক করলেই শুয়ে পড়বে। সেই চান্স মিস করতে চান না আশপাশের কোন পুরুষ। ডিভোর্সি মেয়ের ডিপ্রাইভেশনের দুঃখে তাদের দুঃখ দেখলে বুঝবেন তারা কত মানবিক।

আর নারীরা থাকেন আতঙ্কিত যে ডিভোর্সি মেয়েটি কখন তার স্বামী/ভাই/ছেলেকে বশ করে ফেলেন। বান্ধবী, সহকর্মী বা পুরুষ সহকর্মীর বউ এমনকি ডিভোর্সি মেয়ের আত্মীয় নারীরাও ভয় পান তাকে। কেউ কেউ কথা বলাও বন্ধ করে দেন, পাছে তার চরিত্র নষ্ট হয়ে যায়। কারণ দুঃশচরিত্র নারীরাই কেবল এই সমাজে ডিভোর্স নেয়। পুরুষেরা ডিভোর্সি নারীর শারিরীক দুঃখে দুঃখিত হলেও নিজের বউ বোন বা পরিবারের কোন মেয়েকে ডিভোর্সি কোন মেয়ের সাথে মেলামেশা পছন্দ করেন না। তাতে তাদের পরিবারেরই মানসম্মান চলে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

এমন হাজার হাজার ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটতে থাকে একজন ডিভোর্সি মেয়ের সাথে। এতোকিছু সহ্য করেও তার স্বস্তি মেলে না, রেহাই পায় না সমাজের হাত থেকে। সামাজিক অনুষ্ঠান, আত্মীয়, বন্ধু সব ত্যাগ করেও সে নিজের মতো থাকলেও তার নিস্তার নেই। সে কেন আবার বিয়ে করছে না, নিশ্চয়ই তার একাধিক শোয়ার লোক আছে, সে কেন ফেসবুকে এতো ছবি দেয়, নিশ্চয়ই ছেলে ধরার জন্য, সে কেন তার পুরুষ কলিগ বা বন্ধুর সাথে কথা বলে, নিশ্চয়ই কিছু আছে, সে কেন ঘুরতে যায়, নিশ্চয়ই ঘুরতে গিয়ে ড্যাশ ড্যাশ করে আসে, ইত্যাদি কত যে চিন্তা তাকে নিয়ে আপনাদের। মোটামুটি একজন ডিভোর্সি মেয়ের জীবনে অবাধ যৌনাচার ছাড়া কিছুই দেখেন না আপনারা। তার দুঃখ, কষ্ট বা সংগ্রাম কিছুই থাকে না আপনাদের চোখে; শুধু থাকে পুরুষ বধ করা আর অবাধ ‘নিষিদ্ধ’ সুখ।

আপনাদের সকল চিন্তার অবসান ঘটাতে মেয়েটি যদি ভাবে আবার বিয়ে করবে তাহলে কী হয়, তাও আপনারা জানেন। যেহেতু সে ডিভোর্সি তাই যে যত যোগ্যই হোক তাকে বিয়ে করার জন্য ভ্যানওয়ালা রিক্সাওয়ালা (কাউকে হেয় করার জন্য বলছি না, কেবল সমাজের শ্রেণিভেদটা বোঝাতেই এটা উল্লেখ করলাম) টাইপ কেউ এলেও সেটাও না করা যাবে না। ডিভোর্সি মেয়েকে কেউ বিয়ে করতে চাচ্ছে, এটাই মেয়েটির বড় ভাগ্য। সে বুড়া হোক, চার বাচ্চার বাপ হোক বা মাতাল হোক। ডিভোর্সি মেয়েটি যদি চায় কোন অবিবাহিত ছেলেকে বিয়ে করবে, তখন তো পুরো সমাজ ব্যবস্থাই ভেঙে পড়ে যেন। আর যদি মেয়েটির কোন বাচ্চা থাকে তাহলে তো কথাই নেই। তাকে যেই বিয়ে করুক বা যে কারণেই করুক ব্যক্তিটির মহত্ত্বে পুরো সমাজ মুগ্ধ আর মেয়েটির সমালোচনায় সর্বদাই সচল। ডিভোর্সি, বাচ্চা আছে, তাও কেমনে পুরুষটির মাথা খাইলো! কোন পরিবারই একজন ডিভোর্সি বা ডিভোর্সি বাচ্চার মাকে তাদের ঘরের বউ করতে নারাজ। তাদের ছেলেটির আগে বিয়ে, বাচ্চা, একাধিক নারী আসক্তি যাই থাকুক না কেন। ডিভোর্সি মেয়ে বউ হলে কোন পরিবারেরই সমাজে মুখ দেখানোর উপায় থাকবে না তা মেয়েটি যতই শিক্ষিতা, যোগ্য বা সুন্দরী হোক।

এই ঢাকা শহরে এখনও একটা ডিভোর্সি মেয়ের সত্য প্রকাশ করে নিজের টাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে থাকা প্রায় অসম্ভব। এখানে কারও অফিসিয়াল পারফরমেন্স তার ডিভোর্সি জীবন দিয়ে বিচার করা হয়। সামাজিকভাবে তাকে একঘরে করে দেয়া হয় একপ্রকার। মফস্বল বা গ্রামে এর রূপ আরও ভয়ংকর। তাকে তার মতো করে বাঁচতে না দেয়ার জন্য বা নতুন করে জীবন শুরু করতে না দেয়ার জন্য সর্বদায় সোচ্চার এই বাঙালি সমাজ। কেউ পাশে এসে একটা মুখের কথাও খরচ করবে না মেয়েটিকে উৎসাহ দিতে, সাহায্য তো বহুদূর। তাহলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আজ দুদিন ধরে এত এত পোস্ট করা এই প্রগতিশীলরা কোথায় থাকেন? তারা কি শুধু ফেসবুকেই থাকেন!!!

এতোকিছুর পরও বাঁধনের মত নারীরা আছে আমাদের আশেপাশে ছড়িয়ে, যাদের নিয়ে ফেসবুকে মাতামাতি হয় না। যারা এই সমাজের সকল প্রতিকূলতার সাথে যুদ্ধ করে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। অভিবাদন আর শ্রদ্ধা তাদের সকলকে।

বাঁধনকে অভিবাদন জানাতে, উৎসাহ দিতে সারাদেশ আছে। আপনি বা আপনারা ফেসবুকে লম্বা লম্বা ভাষণ না দিয়ে বাস্তব জগতে আপনার আশপাশ থেকে শুরু করুন প্রগতিশীলতা। আপনার পাশের আত্মীয়, প্রতিবেশী, বন্ধু, সহপাঠী, সহকর্মী বা যেই এমন আছে তাকে উৎসাহ না দেন ঠিক আছে, কিন্তু তাকে অসম্মান করা, সমালোচনা করা ইত্যাদি বন্ধ করুন। তাদেরকে তাদের মতো করে বাঁচতে দিন 🙏।

#Stop_Divorce_Shaming

শেয়ার করুন: