যৌন নির্যাতনের শিকার কিশোরীর আত্মহত্যা, অপরাধীর জামিন একদিনেই

উইমেন চ্যাপ্টার ডেস্ক:

নেত্রকোনার ২০২০ সালে জেলা পর্যায়ের একটি আলোচিত ঘটনা হচ্ছে, বারহাট্টা উপজেলার ১৪ বছর বয়সী মারুফার হত্যা। এই মামলার অনেকগুলো জটিলতার স্তর আছে। এই মামলার বিবাদীপক্ষ একজন ক্ষমতাসীন ব্যক্তি। বারহাট্টা উপজেলার সিংধা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং জেলা আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক শাহ মাহবুব মোর্শেদ কাঞ্চন (কাঞ্চন চেয়ারম্যান বলে পরিচিত)। অভিযুক্ত এই চেয়ারম্যান ক্ষমতার জোর খাটিয়ে মাত্র একদিনের মধ্যে জামিন পেয়েছেন। তার এই জামিন পাওয়ার বিষয়ে বিরক্তি প্রকাশ করে উক্ত মামলার একজন সাক্ষী ফেসবুকে একটি পোস্ট লিখে, যার ফলে তার নামে ডিজিটাল সিকিউরিটি এক্টে মামলা করা হয়। ছয় মাস জেল খাটার পর ওই ব্যক্তি জামিন পেলে এই মামলার সাক্ষী হিসেবে নিজেকে প্রত্যাহার করে। আমরাই পারি পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ জোট প্রথম থেকেই এই মামলা সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে কাগজাদি সংগ্রহ করছিল এবং নিয়মিত ফলো আপে রেখেছিল। সেইখান থেকে উঠে এসেছে এই মামলার জটিলতার নানাদিক।

উইমেন চ্যাপ্টার এর পাঠকের জন্য সেই দিকগুলো তুলে দেওয়া হলো:

কী হয়েছিল মারুফার সাথে?

১৪ বছর বয়সী মারুফা বাবাকে হারায় ২০১৮ সালে। পরিবারের কর্মক্ষম ব্যক্তির মৃত্যুর পরে মারুফার মা আকলিমা বেগম সিদ্ধান্ত নেয় ঢাকায় এসে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করার। এর মধ্যে কাঞ্চন চেয়ারম্যান মারুফার সকল দায়দায়িত্ব নিতে চায়। তিনি আকলিমা বেগমকে প্রস্তাব দেন, “তোমার মেয়ে মারুফাকে আমাদের বাড়িতে দিয়ে দাও। আমি তাকে লালন পালন করে বিয়ে দিব”। মারুফার মা প্রথমে কোনভাবেই এই প্রস্তাবে রাজি ছিল না। এই ক্ষেত্রে উল্লেখ যে, দুই বছর পূর্বে মারুফার বাবাকে হত্যা করা হয়। আকলিমা বেগম থানায় তার বিরুদ্ধে মামলা করেছিল। কিন্তু কাঞ্চন চেয়ারম্যান জোরপূর্বক আকলিমাকে সে মামলায় আপোষ করিয়েছিল।

প্রথম অবস্থায় আকলিমা বেগম রাজি না থাকলেও, অর্থনৈতিক সংকটকে বিবেচনা করে এবং একই সাথে এলাকাবাসীদের প্রবল অনুরোধে তিনি মারুফাকে কাঞ্চন চেয়ারম্যানের বাড়িতে গৃহকর্মী হিসেবে নিযুক্ত করতে সিদ্ধান্ত নেন। এরপর তিনি ঢাকায় চলে আসেন কাজ করতে, আর মারুফা থেকে যান কাঞ্চন চেয়ারম্যানের বাড়িতে। আকলিমা বেগম তার মেয়ের সাথে আলাপচারিতায় টের পায় কাঞ্চন চেয়ারম্যান বিভিন্নভাবে মারুফাকে যৌন হয়রানি করে। মারুফার মা সিদ্ধান্ত নেন মেয়েকে ঢাকায় আনার। এমন সময়ে ৯ মে, ২০২০ তারিখে আকলিমার একটি ফোনকল আসে কাঞ্চন চেয়ারম্যানের স্ত্রীর কাছ থেকে যে “তোর মেয়ে আত্মহত্যা করেছে”। এই কথাটি বলার পরেই নারীটি ফোন রেখে দেয়। কোনভাবেই ফোনে তাকে পাওয়া যায় না। মারুফার মা অসহায় ও দিকভ্রান্ত হয়ে যখন নেত্রকোনায় পৌঁছায়, তখন কাঞ্চন চেয়ারম্যানের লোক লাশ তুলছিল গাড়িতে। মারুফার মাকে কোনভাবেই লাশ দেখতে দেওয়া হচ্ছিল না। মারুফার মা অবিচল থেকে স্থানীয় সহযোগিতায় মেয়ের লাশ দেখতে সক্ষম হন। তিনি মেয়ের লাশ প্রত্যক্ষ করে ঘাড়ে, গলায়, বুকে নির্যাতনের চিহ্ন পান, সঙ্গে দেখেন যোনিপথে লাল রক্ত।
লাশ দেখার পরে আকলিমা বেগম কাঞ্চন চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে মামলা করার সিদ্ধান্ত নেন। প্রথমত কাঞ্চন চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে এই মামলা কিছুতেই নিতে চাচ্ছিল না পুলিশ। বরং জোর দেখিয়ে এইটাকে আত্মহত্যা উল্লেখ করতে বাধ্য করেছিল আকলিমাকে। পরবর্তীতে ১১ মে, ২০২০ কাঞ্চন চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে দন্ডবিধির ৩০৪ ধারায় অপমৃত্যুর মামলা এবং ৩৪ নং ধারায় অপরাধে সহযোগিতা করার মামলা দায়ের করা হয় (মোহনগঞ্জ থানার সাধারণ ডায়েরি নং: ৩৪৬)। ১২ মে, ২০২০ ডিবি পুলিশ কাঞ্চন চেয়ারম্যানকে গ্রেফতার করলে মাত্র একদিনের মধ্যে অর্থাৎ ১৩ তারিখে নিম্নআদালত থেকে জামিন নিয়ে আসে কাঞ্চন চেয়ারম্যান। এরপর কাঞ্চন চেয়ারম্যানের বাহিনী মারুফার কুলখানির জন্য আকলিমা বেগমকে ১৪ হাজার টাকা দেবার কথা বলে মামলা তুলে ফেলার জন্য চাপ দেয় এবং আকলিমা বেগম তা প্রত্যাখ্যান করে।

প্রতিক্রিয়া:

এই ঘটনায় নেত্রকোনায় স্থায়ী এনজিও এবং মানবাধিকারকর্মীরা প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করে। মারুফার মাকে সামনে রেখে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। নিয়মিতভাবে পুলিশ সুপার এবং ডিসির কাছে মামলার ময়নাতদন্ত রিপোর্টের জন্য একাধিকবার চিঠি প্রেরণ করা হয়।

অবশেষে ময়নাতদন্ত রিপোর্ট

প্রায় ছয় মাস পর নভেম্বর ৮ তারিখে ময়নাতদন্তের রিপোর্ট আসে। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট এইটিকে আত্মহত্যা বলে উল্লেখ করে। তবে এই রিপোর্টে উল্লেখিত ডিএনএ এনালাইসিস অংশে মারুফার পায়ুপথের সোয়াব তথা রেকটাল সোয়াবে সেমিনাল ফ্লুয়েড (শুক্রাণুর তরল পদার্থ) পাওয়া গিয়েছে। পাশাপাশি ভিকটিমের গায়ে নির্যাতনের দাগের বিষয় উল্লেখ রয়েছে। যোনিপথের লাল রঙের ফ্লুইডকে মাসিকের রক্ত বলা হয়েছে এই রিপোর্টে। তবে ভ্যাজাইনাতে কোন স্পার্ম পাওয়া যায়নি। আবার সুরতহাল রিপোর্টে পায়ুপথকে একজন কিশোরীর বয়স অনুয়ায়ী স্বাভাবিকের চাইতে অতিরিক্ত ‘লুজ’ বলে উল্লেখ করা হয়। পূর্ণাঙ্গ টেস্ট রিপোর্ট আমরা পাইনি। ময়নাতদন্তে বলা হয়েছে মারুফার ভ্যাজাইনাল সোয়াব এবং রেকটাল সোয়াব সংরক্ষিত করা হয়েছে ডিএনএ টেস্টের জন্য। রেকটাল সোয়াবে প্রাপ্ত সেমিনাল ফ্লুইডটি নিয়েও ডিএনএ পরীক্ষণের ফলাফল আমাদের এখনো জানা নেই।

জটিলতার দিক

ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে মারুফার মামলাটি “আত্মহত্যা” হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে এবং ভিকটিমকে ধর্ষণ করা হয়েছে কিনা তা নির্ধারণের যথেষ্ট প্রমাণাদি উঠে আসেনি। কিন্তু এখনও যেহেতু পূর্ণাংগ ডিএনএ প্রতিবেদন আমরা পাইনি, তাই এই ঘটনাটি “ধর্ষণ” না তাও আমরা কিন্তু বলতে পারছিনা।
এই মামলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি তা হচ্ছে রেকটাল সোয়াব তথা পায়ুপথে শুক্রাণুর তরল অংশ পাওয়া এবং সুরতাহাল রিপোর্টে পায়ুপথকে “অস্বাভাবিক লুজ” বলে উল্লেখ করা। এই থেকে একটি সম্ভাবনা স্পষ্টত যে কাঞ্চন চেয়ারম্যান কিশোরী নারীটিকে পায়ুপথে ধর্ষণ করেছে। এবং এর ফলেই কিশোরীটি আত্মহত্যা করেছে।

তাছাড়া আমাদের প্রাপ্ত উভয় প্রতিবেদনে মারুফার গায়ে যথেষ্ট নির্যাতনের দাগ এর প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। এ থেকে অনুমেয় যে তাকে নির্যাতন করা হয়েছে।
এই মামলার জন্য আমাদের কিছু কনটেক্সট বিবেচনা জরুরি। যেমন এই প্রশ্নটা আসা দরকার, যদি আত্মহত্যাও হয়ে থাকে একজন ১৪ বছর বয়সী দরিদ্র কিশোরী আসলে কেন আত্মহত্যা করবে? তার জন্য এমন কী ঘটনা তৈরি হয়েছিল যার ফলে সে বেঁচে থাকার প্রতিই তার আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে?

মারুফার মা একাধিকবার বলেছেন, তার সাথে মেয়ের ফোনে আলাপচারিতাই বারবারই উঠে এসেছিল কাঞ্চন চেয়ারম্যান কর্তৃক কিশোরীর উপর হয়রানি এবং নির্যাতন বিষয়টি। যদি এই ঘটনা আত্মহত্যাই হয়ে থাকে, তাতেও খুব স্পষ্ট যে কাঞ্চন চেয়ারম্যানের যৌন হয়রানি এবং নির্যাতন সইতে না পেরেই মারুফা এই স্বইচ্ছায় মৃত্যূকে শ্রেয় মনে করেছে।
এক্ষেত্রে কাঞ্চন চেয়ারম্যানের পূর্বের চারিত্রিক প্রমাণাদিও উল্লেখ্য। বিভিন্ন মাধ্যমে জানা গেছে, কাঞ্চন চেয়ারম্যান এর আগেও নারী নির্যাতনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, যা কিনা প্রমাণের অভাবে কোন বিচারের আওতায় আনা হয়নি। তিনি তার প্রভাব খাটিয়ে বিভিন্ন রকম দুর্নীতির সঙ্গেও লিপ্ত। এর মধ্যে গাছ চুরির মামলায় একবার তাকে চেয়ারম্যান থেকে অবহিত দেওয়া হয়। পুনরায় তিনি আবার এই পদে অধিষ্ঠিত হন।

মারুফা কি ন্যায়বিচার পাবে?

যেহেতু অভিযুক্ত এলাকার একজন ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশীল নেতা, তাই প্রথম থেকে ভিকটিমের পরিবারের উপর এই মামলাটি আপোষ করা এবং তুলে নেবার একটি চাপ রয়েছে। পাশাপাশি ডিজিটাল সিকিউরিটি এক্টে কারাবন্দী এবং পরবর্তীতে জামিন হবার জন্য, এই মামলার একজন উল্লেখযোগ্য সাক্ষি সরে গিয়েছে। খুব সম্প্রতি আমরা স্থানীয় তথ্যসুত্র থেকে জেনেছি, এই মামলার ফাইনাল রিপোর্ট প্রদান করা হয়েছে যেখানে অভিযুক্তকে অব্যাহতি দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। শুধু তাই নয়, কাঞ্চন চেয়ারম্যানের সাথে সেখানকার আইন, পুলিশ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের উঠবসের বিভিন্ন সংবাদ আমরা জ্ঞাত হই। এলাকার এবং প্রশাসনের উপর কাঞ্চন চেয়ারম্যানের এই একচেটিয়া প্রভাব এই মামলায় ভিকটিমের ন্যায়বিচার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
হাইকোর্ট নির্দেশনা অনুযায়ী, ধর্ষণের মামলা ১৮০ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তি করার কথা থাকলেও এই মামলা দীর্ঘসূত্রিতায় আটকে গিয়েছে ইতোমধ্যে। মামলার বাদী তথা ভিকটিমের মা অর্থনৈতিক জটিলতা এবং ,ক্ষমতাসীন বিবাদীর লোকজন এবং স্থানীয় মানুষজনের চাপে আছেন।
আমাদের পূর্ব অভিজ্ঞতা দেখায় যে, এইসকল মামলার ক্ষেত্রে ক্ষমতার সঙ্গে না পেরে উঠে এবং দীর্ঘসূত্রিতার কবলে পড়ে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাদীপক্ষ আপোষের পথেই হাঁটে।

মারুফা মরে গেছে। কিন্তু আমরা এখনও জানি না, মারুফা তার উপর হওয়া এই যৌন নির্যাতনের ন্যায়বিচার পাবে কিনা। নাকি ক্ষমতার প্রদর্শন এর ফলাফলে আপোষই এই মামলার চূড়ান্ত পরিণতি? স্থানীয় তথ্যমতে, কাঞ্চন চেয়ারম্যান পুনরায় উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন! আমরা একজন অভিযুক্ত “নির্যাতক”কে এরকম গুরুত্বপূর্ণ পদে দেখতে চাই কিনা, এইটিও এই সময়ে দাঁড়িয়ে একটি বড় প্রশ্ন!

মারুফার এই মামলাটি আমাদের দেখায়, ক্ষমতার কাছে একজন প্রান্তিক নারীর উপর সংঘটিত যৌন সহিংসতা বিষয়টি কীভাবে গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। নির্যাতনের স্পষ্ট চিহ্নাদি থাকার পরও ভিকটিম এবং তার পরিবারকে পদে পদে লড়াই করে যেতে হয়। তবুও এই লড়াই শেষে অনিশ্চয়তা থেকে যায় যে সত্যিই নারীটি ন্যায়বিচার পাবে কিনা!

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.