রোজিনার জামিন নিয়ে দোলাচল, সাংবাদিকরা ঐক্যবদ্ধ হবেন কি?

মোজাম্মেল হোসেন মঞ্জু:

১। সাংবাদিক কি সিঁধ কেটে সচিবালয়ে ঢোকে যে হাতেনাতে বমাল ধরে পুলিশের হাতে সোপর্দ করার মতো ব্যাপার?

২। সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়ের করা সরকারি নথি চুরির অভিযোগে মামলায় জামিন আবেদনের দুইদিন শুনানি করেও আদেশ দিতে পারলেন না ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম। গ্রেফতারকৃতকে ১৮ই মে প্রথমবার আদালতে হাজির করা হলে পুলিশ রিমান্ড চায়। বিজ্ঞ হাকিম তা নাকচ করেন। কিন্তু জামিন চাইলেও তা দিলেন না। একদিন বাদে ২০শে মে বৃহস্পতিবার জামিন আবেদনের অধিকতর শুনানির দিন ফেললেন। ভার্চুয়াল শুনানি করে বললেন, দ্রুতই আদেশ দেবেন। পরে জানালেন, রোববার। বৃহস্পতিবারে জামিন শুনানির এই এক বিপদ যে সেদিন আদেশ না দিলে সপ্তাহান্তের আরও দুই দিন জামিনপ্রার্থীকে জেলে থাকতে হবে।

৩। দণ্ডবিধি ও সরকারি গোপনীয়তা আইনের (Official Secrets Act, 1923) যে ধারাগুলিতে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে তার সবগুলিই জামিনযোগ্য। আসামি নারী। শিশুসন্তানের মা। অসুস্থ। তাঁর পালিয়ে যাওয়ার ও বিচারের সময় ইচ্ছাকৃতভাবে হাজির না হওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই। ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী জামিন পাওয়ার এই সব শর্ত পূরণ করেও তিনি জামিন পেলেন না। তবে জামিনের মালিক বিচারকই। তিনি জানিয়েছেন মামলার নথি পড়ে সিদ্ধান্ত দেবেন রোববার। অনিশ্চয়তাপূর্ণ অপেক্ষা।

৪। রোজিনা ১৭ই মে সোমবার পেশাগত কাজে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে সচিবের দপ্তরে গেলে সচিব মহোদয়ের একান্ত সচিবের কক্ষে তাঁকে যে কর্মকর্তা কর্মচারীরা অন্তত ৫ ঘন্টা আটকিয়ে রেখে শারীরিক মানসিক নির্যাতন করেছেন তাঁরা অন্যায় আটক (unlawful confinement) করে ফৌজদারি অপরাধ করেছেন (দণ্ডবিধি ধারা ৩৪০)। পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার পর থানায় আটক রেখে গভীর রাতে মামলা ও গ্রেফতার দেখানো হয়েছে।

৫। সাংবাদিক যদি বমাল ধরাই পড়েন, মানে বেয়াইনিভাবে ও ঔদ্ধত্য সহকারে হলেও তাঁর ব্যাগ বা শরীর তল্লাসি করে যদি ‘গুরুত্বপূর্ণ ও গোপনীয়’ সরকারি নথি পাওয়াই যায় তবে দ্রুত পুলিশে খবর না দিয়ে পাঁচ ঘন্টা আটকে রেখে সলাপরামর্শ করে মামলা দায়ের কেন? এতে চুরির মাল কে কাকে গছিয়ে দিয়েছে সে সন্দেহ হতেই পারে। দীর্ঘক্ষণ আটকে রেখে মামলা দিলে মামলা প্রশ্নবিদ্ধ হয়।

৬। সাংবাদিকরা তথ্য, বিশেষত স্পর্শকাতর তথ্য পায় সোর্সের (source, উৎস, সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে সাধারণত অপ্রকাশ্য তথ্যদাতা) কাছে। সাংবাদিক ও সোর্সের সম্পর্ক ভাল থাকে। একে অপরকে বিশ্বাস করে, রক্ষা করে। সাংবাদিক সোর্সের নাম কোথাও বলতে বাধ্য না। শুধু ব্যতিক্রম সম্পাদক, যাঁকে বলা যায়। এমন নজির আছে যে সাংবাদিক জেল খেটেছে কিন্তু সোর্সের নাম সরকারি কর্তৃপক্ষের কাছে প্রকাশ করেনি।

৭। সাংবাদিক কি তথ্যের জন্য নথি চুরি করতে পারে? সাংবাদিক যখন সোর্স গোপন রেখে তথ্য আনে তখন চুরিও করতে পারে (ধরা না পড়লেই তো চুরিবিদ্যা মহাবিদ্যা!)। এ-জাতীয় চুরি ক্ষেত্রবিশেষে সাংবাদিকরা করে। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার জন্য দালিলিক প্রমাণ বেশি প্রয়োজন। সাংবাদিকরা তাই ইংরেজি বাগধারার buy borrow or steal (ক্রয় করো ধার করো নয়তো চুরি করো) উৎসাহ নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ে। তবে অবশ্যই সোর্স বিপদে পড়বে এমন চুরি কখনোই করে না। কারণ তাতে তার সংবাদের উৎসই বন্ধ হয়ে যাবে। আর চুরি করে পাওয়া তথ্য প্রকাশ করলে যদি দেশের ক্ষতি হয় তবে কোনো সাংবাদিক ও সংবাদপত্র তা প্রকাশ করেছে এমন নজির খুঁজে পাওয়া যায় না। অবশ্য শত্রুদেশের গুপ্তচর যদি সাংবাদিক বেশে কাজ করে তাহলে ভিন্ন কথা। গুপ্তচর তো যে-কোনো বেশ ধারণ করতে পারে। এর সঙ্গে সাংবাদিকতার কোনো সম্পর্ক নেই।

৮। নিঃসন্দেহে রোজিনার ভালো সোর্স আছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে ও অন্য মন্ত্রণালয়েও। সাংবাদিকরা অনেক সময় সোর্সের কাছে চায় কোনো নথি, কাগজ, নিয়ে যাবে বলে। সোর্স ঝুঁকির মাত্রা বুঝে কখনো ফটোকপি দেন বা অধিকাংশ সময় বলেন, না, এটা দেওয়া যাবে না, এখানে বসে পড়ে যান বা নোট নিয়ে যান। রোজিনা সেদিন কোনো তথ্য যাচাই করতে সচিবের সঙ্গে দেখা করবেন বলেই তাঁর একান্ত সচিবের কক্ষে বসেছিলেন। এই কর্মকর্তারা বিটের সাংবাদিকদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেন বলেই আমাদের অভিজ্ঞতা। প্রায় প্রতিবারই তাঁরা সৌজন্যবশত চা খাওয়ান ও খাওয়াতে চান। রোজিনা মন্ত্রণালয়ে অপরিচিত নন। তাঁকে যদি ফাইলের ছবি তুলতে বা কাগজ নিতে দেখাও যায় তবুও তাকে বিরত করার বা একান্ত সচিব ও সচিবের দৃষ্টি আকর্ষণের সুযোগ ছিল অন্যদের। কিন্তু হঠাৎ চ্যালেঞ্জ করে চরম দুর্ব্যবহার করা হয়েছে। তাই সব মিলিয়ে দুর্নীতির খবর প্রকাশ পাওয়ায় তিনি কতিপয় আমলার আক্রোশের শিকার হয়েছেন বলেই মনে হয়। ঘটনাটি পূর্বপরিকল্পিতও হতে পারে।

৯। সচিবালয়ে অফিস সময়ের পরেও দীর্ঘ সময় একজন নারী সাংবাদিক আটক, দল বেঁধে সাংবাদিকরা এসেছে, হৈ চৈ হচ্ছে, সোশ্যাল মিডিয়ায় খবর ছড়িয়েছে কিন্তু কয়েক ঘন্টার মধ্যে স্বাস্থ্যমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, তথ্যমন্ত্রী কেউ-ই বিষয়টা মীমাংসা করতে এগিয়ে এলেন না, যা ওখানেই নিষ্পত্তি করা যেতো!

১০। রোজিনা শুধু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নয়, অন্য মন্ত্রণালয় ও অন্য প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠান সম্পর্কেও স্পর্শকাতর অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করেছেন। আটক, হেনস্থা, মামলা, গ্রেফতার, হাজতবাস, জামিন শুনানির দীর্ঘসূত্রতা পর্যন্ত যে নির্দয় আচরণ একজন নারী সাংবাদিকের প্রতি করা হলো তাতে শুধু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কতিপয় দুর্নীতিবাজ আমলার নয়, নেপথ্যে আরও অনেকের আক্রোশ থাকা বিষয়ে অনুমান করা চলে। এবং হয়তো রোজিনা কাজের ঘোরে অত্যুৎসাহী হয়ে সতর্ক থাকেননি এবং ফাঁদে পড়েছেন।

১১। যে-কোনো ঘটনা ও প্রতিক্রিয়ার সবটুকুই নেতিবাচক হয় না, কিছু কিছু ইতিবাচক দিকও থাকে। রোজিনাকে নিয়ে ঘটনার সেই সামান্য ইতিবাচক দিক হচ্ছে তাঁর প্রতি যে অন্যায় আচরণ করা হয়েছে এবং তা যে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার উপর ধারাবাহিক আক্রমণেরই একটা অংশ সে সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি এবং ব্যাপক প্রতিবাদ জ্ঞাপন। বিশেষ করে সাংবাদিকরা কয়েক দশক ধরে নিজেদের পেশাগত পরিচয়ের ঐক্য বিসর্জন দিয়ে রাজনৈতিক দলানুগত্যে চরমভাবে বিভক্ত হয়ে নিজেদের শক্তিসামর্থ্য ও মর্যাদা অনেকখানি খুইয়েছেন। বিশেষত তাদের ইউনিয়ন বিভক্ত ও নেতাদের বিরুদ্ধে সুবিধাবাদের অভিযোগ। রোজিনা ইস্যুতে সাংবাদিকরা, গণমাধ্যম সংশ্লিষ্ট সকল সংগঠন এক স্বরে প্রতিবাদ করছেন, আওয়াজ তুলেছেন। সাংবাদিকদের বাইরে সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন প্রতিবাদ জানাচ্ছে। জনগণের বিভিন্ন অংশকে সোশ্যাল মিডিয়ায় সোচ্চার দেখা যাচ্ছে। সমকালীন অভিজ্ঞতায় একথা এখনই বলা যাচ্ছে না যে, সাংবাদিকরা একই ইস্যুতে সমস্বরে প্রতিবাদকে স্থায়ী ঐক্যে রূপ দেবেন কি-না, বিশেষত রাজনৈতিক দলের দালালিতে বিভক্ত হয়ে পড়া ইউনিয়নকে পেশাগত একক ইউনিয়নে পুনরেকত্রিত করার পথে হাঁটবেন কি-না।

(লেখকের ফেসবুক টাইমলাইন থেকে নেয়া)

শেয়ার করুন: