শাহরিয়া দিনা:
মেয়েরা হচ্ছে লতার মতো। একটা অবলম্বন দরকার বাঁচতে। যে যত নিরাপদ গভীর বনে শক্তিশালী গাছের কাছাকাছি জন্মায়, জড়াতে পারে, সে তত নিরাপদ থাকে। শৈশবে বাবা, যৌবনে স্বামী, বৃদ্ধ বয়সে ছেলে এই সার্কেলেই চলে জীবন।
এরা বড় হয় কার্টুন মীনার মায়ের অমর বাণী, ‘ছেলেরা একটু বেশী-ই পাইয়া থাকে’ শুনে-বুঝে। বিয়ে হয় স্বপ্নভরা চোখ নিয়ে। স্বপ্নে থাকে বিল গেটসের মতো ধনী আর শাহরুখ খানের মতো রোমান্টিক হবে স্বামী। প্রাচুর্য আর সম্মানে; সাথে প্রেম-ভালোবাসা-আদরে, আগলে রাখবেন তাকে তাই পরম যত্নে সাজায় সংসার।
মোটামুটি এক/দুইটা সন্তান হবার পরই বাস্তবতার যাঁতাকলে পরে বলতে শোনা যায়, শুধু বাচ্চাদের মুখের দিকে তাকিয়েই করছি সংসার। আলু-পেঁয়াজের সংসারে সবই হয়ে যায় অভ্যাস। দায়িত্ব আর মায়ার অভ্যাসে বসবাসের অনেকটা সময় পেরিয়ে নিজেকে আবিষ্কার করে অবসরপ্রাপ্ত হিসেবে। মেঘে মেঘে বেলা বাড়ে, থেমে থাকে না বয়সের ঘড়ি। ছেলে-মেয়ে বড় হয়। তাদের আলাদা সংসার হয়। সে সংসারে কখনও অতিথি অথবা কখনও অনাহুত অতিথি’র মতো কাটে জীবন।

এই চক্র তবু ভালো। কিছু মেয়ে পড়ে যায় চক্রের বাইরে। অনেকটা নিয়তির নিয়মে এদের গাছ হতে হয়। পায়ের নিচে শক্ত শেকড় না থাকলে মাথার উপর উপড়ে পরার খড়গ নিয়ে টিকে থাকার এক ভয়াবহ লড়াই। ঝড়-ঝঞ্ঝায় স্থির থাকো, আশ্রয় হও। সয়ে যাও, নিরবে সহো। নিজের খাবার নিজেই যোগাড় করো। পাতা ছিঁড়লো, কাণ্ড নড়লো, ডাল কেটে নিয়ে গেল, কিছু করার নেই।
যে পথিক বিশ্রাম নেয় গাছের তলায় সে-ই আবার ডাল ভেঙ্গে ফেলে, গাছের ফলটা ভালো না, ফুলটায় গন্ধ নেই সমালোচনায় তার দ্বিধা নেই। যে পাখিটা নিজে থেকে এসে বাসা বানায় তার গায়ে, সে-ও একদিন ছেড়ে যায় আপন মনে।
জগদীশ চন্দ্র বসু যদিও জানিয়েছিলেন, গাছেরও জীবন থাকে, কিন্তু গাছের জীবন নিয়ে কে ভাবে? আঘাতে কি গাছেরও রক্তক্ষরণ হয়? সে-ও কি কাঁদে চিৎকার করে? তার-ও কি দুঃখের কথা কাউকে বলতে ইচ্ছে করে? অথবা সে-ও তুমুল বৃষ্টির দিনে প্রগাঢ় প্রণয়ে প্রিয়জনের আলিঙ্গনের উষ্ণতা খোঁজে?
গাছদের মুখে ভাষা নেই, নেই আলাদা পৃথিবী। মানুষের পৃথিবীতে, মানুষের প্রশ্বাসে মিশে থাকে তবুও মানুষের জীবন থেকে যোজন যোজন দূরে থাকে। যার শেকড়-ই ছুঁতে পারেনা শিখরকে সে মানুষের মনকে ছুঁয়ে দেবে কেমন করে?
গাছ অথবা লতার মাথায় উপর থাকে একই আকাশ। মানুষের যে জীবন সেটা গাছ অথবা লতার মতন যেমনই হোক মাথার উপর একটা ছাদ থাকাটা অবশ্যম্ভবী। বাপের বাড়ি, স্বামীর বাড়ি, ছেলের বাড়ি-ই নারীদের বাড়ি। নারী সাজায় বাড়ি, গুছিয়ে রাখে ঘর, সামলায় সংসার তবুও কখনো কখনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার আকস্মিকতায় জানা হয়ে যায় এখানে তার কিছুই নেই। সাজানো-গোছানো অভ্যাসের সাথে মিশে থাকা স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিনত হয়। বিশ্বাসের উপর ভর করে যে স্বপ্ন সেই স্বপ্নভঙ্গের কষ্টটাও অবিশ্বাস্য রকমের যন্ত্রণার।
একটা নিজের বাড়ি’র আকাঙ্খা থাকে নারী-পুরুষ সবারই থাকে একান্ত চাওয়াতে। একটা বাড়ি- একটা আশ্রয়, একটা মাথা গুঁজবার ঠাঁই। পুরুষের মতো কাগজে-কলমে নারীদেরও নিজস্ব একটা ঠিকানা চাই। স্থায়ী ঠিকানা/অস্থায়ী ঠিকানা লেখার ঘরটা সরকারি-বেসরকারি যেকোনো ফরম ফিলাপে থাকলেও সবাই স্বাচ্ছন্দ্যে সেটা লিখতে পারে না, বিপাকে পড়তে হয়।
সময়ের পরিক্রমায় পৃথিবীর বয়স বেড়েছে, সভ্যতা এগিয়েছে, পরিবর্তন এসেছে মানুষের জীবনধারায়। শুধু একটা জিনিসই অপরিবর্তিত রয়ে গেছে, সেটা হচ্ছে জীবনের নিশ্চয়তা। চিরাচরিত অনিশ্চিত জীবনে নিরাপত্তার অভাব আগেও ছিল, এখনো আছে, তবে ধরন পাল্টেছে।আগে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা বন্য জন্তুর আক্রমণের ভয় ছিল এখন ভয় অন্য অনেক কিছুর। পরিবর্তিত এই সময়ে এসে মেয়েদের ভাবতে হচ্ছে নিজস্ব পরিচয়ের কথা, সন্ধান করতে হচ্ছে নিজের ঠিকানার।
এখন যারা নবীন স্বপ্ন দেখছে আগামীর, তাদের স্বপ্নে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার সাথে সাথে ভালোবাসার স্বপ্ন আসে নিশ্চয়ই! সেই স্বপ্নের পাশাপাশি একটা ভালো বাসার স্বপ্নও লালিত হোক এবং বাস্তবে রুপ দেবার সামর্থ্যের পথে এগিয়ে থাকুক আগামীর নারী। নয়তো –
“বাবার বাড়ি এই গেরাম শ্বশুর বাড়ি ওই
তবে তোমার বাড়ি কইগো নারী
তোমার বাড়ি কই?
শিশুকাল আর কৈশোর কাটে বাবার আশ্রয়ে
যৌবন কাটে স্বামীর কাছে শ্বশুরালয়ে
আবার বৃদ্ধ বয়সে আশ্রয় নাই আর ছেলের কাছে বই।
তবে তোমার বাড়ি কইগো নারী
তোমার বাড়ি কই?
জনম ভরে ভাত রাঁধিলে পরের হাড়িতে
আপন ভেবে বাস করিলে পরের বাড়িতে
যেমন পরের ঘরে বেঁধে বাসা বাস করে চড়ই।
তবে তোমার বাড়ি কইগো নারী
তোমার বাড়ি কই?”
এমন সব কবিতা-গানে মতো দিনশেষে বুকের ভেতর একদলা দীর্ঘশ্বাসই রইবে সম্বল।