এ লিভিং ডেড ইজ রাইটিং- ২

চন্দ্রাবতী:

এই কিছুদিন আগে একজন ডাক্তার যিনি নারী ছিলেন, তাকে ম্যাজিস্ট্রেট পুলিশ মিলে রাস্তায় তার গাড়ি আটকে হয়রানি করলো। সেই ডাক্তারও নানানভাবে নিজের দাপট দেখিয়ে কিছু হীন কথা শুনিয়ে দিলেন।

এই যে “দেখে নেবো তোকে” এই মানসিকতাটি এই উপনিবেশিক মনোভাবটিই সব জায়গায় কাজ করে। রাজনৈতিক নেতা, যে একসময় গলির গুণ্ডা ছিলো, এখন ক্ষমতাসীন রাজনীতি করে কিছু একটা হয়েছে, সে পুলিশ, ম্যাজিস্ট্রেট, এলাকার অন্যান্য শিক্ষিত , বা আদি বনেদি লোকজনের সামনে একটা হ্যাডম দেখায়, কোন ঝামেলা হলে যেকোনভাবে বুঝিয়ে দিতে চায়, “দেখে নেবো তোকে”।

সাংবাদিক, পুলিশ, ডাক্তার, সচিব, মন্ত্রী, উকিল, এমনকি নাপিতেরও ক্ষেত্রবিশেষে পাওয়ার আছে। সমস্যা হচ্ছে, সবাই চায় যার যার পাওয়ার দেখিয়ে আরেকজনকে দেখে নিতে।

সাংবাদিক যখন বলে, আমি সাংবাদিক, আমাকে কি আপনি এমন করতে পারেন? তখন পুলিশ সচিব বলে, তুই সাংবাদিক, তুই কি প্রশাসনের চেয়ে বড়, ‘দাঁড়া দেখে নিচ্ছি তোকে’। আপামর জনসাধারণ যখন দাবি জানায়, মুক্তি চাই মুক্তি চাই, আদালতে ওই বিচারকের চেয়ারে বসা বিচারক বলে, তুই কি আমার ক্ষমতা জানিস? ‘দাঁড়া দেখে নিচ্ছি তোকে’।

তোকে দেখে নেবো, তোকে জেলের ভাত খাওয়াবো, তোর এমন অবস্থা করবো যে তুই আর আমার সাথে লাগতে আসতে পারবি না। আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ, বিচার বিভাগ এই তিনটি বিভাগের সাথে থাকা সংশ্লিষ্ট লোকজনের বেশিরভাগের মানসিকতাই হচ্ছে , তারা রাজদরবারে কাজ করে, আর বাকি সকলেই হচ্ছে প্রজা। আমাদের এই বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকার যেকোনো সমস্যা, বিএনপি, হেফাজত, মুক্তিযুদ্ধ, এই সকল সূত্র দিয়ে গুণ দিয়ে জনগণের সামনে এনে হাজির করে। ফলে যারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকজন, তারা বিরোধিতা করতে পারে না/চায় না। যেকোনো সমালোচনা করলেই যিনিই সমালোচনা করবে, তার গলাটাই চেপে ধরে, তাকে প্রতিপক্ষ বানায়, রাষ্ট্রদ্রোহী বলে, মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী বানিয়ে দেয়।

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই, জেলে থাকাকালীন এই বছরই মারা গেলো দুজন, লেখক মুশতাক, এবং একজন হেফাজত নেতা ইকবাল হোসেন। এই যে রাষ্ট্রের চিত্র এটা প্রমাণ করে কারাগারে, জেল হাজতে বন্দী ব্যক্তির নিরাপত্তা নেই, বিশেষ করে সেই ব্যক্তিদের, যাদের সরকার বিভিন্ন রাজনৈতিক কারণে বন্দী করেছিলো। এই আচরণ ফ্যাসিস্ট আচরণ।

সরকারি সকল খাতে, বিশেষ করে স্বাস্থ্য খাতে হরিলুট চলছে। পদ্মাসেতু, মেট্রোরেল, উড়াল সেতু, এই সকল দেখতে উন্নয়ন, সেটা ঠিক। কিন্তু অন্য জায়গায়, দুর্নীতি করে জনগণের হকের টাকা মেরে যারা নিজেদের ব্যক্তিগত উন্নয়নের উড়াল সেতু গড়ছে, তাদের থামাতে হবে।
কিন্তু সেটা সম্ভব হচ্ছে না, কারণ তাদের বিরুদ্ধে যেই কিছু বলছে, তারা তাদের দেখে নিতে চাচ্ছে।

আমাদের এই দেশে, সাধারণ মানুষ বলেন, প্রশাসন বলেন, তাদের মাথায় যে কনসেপ্ট সেটা রাজতন্ত্রের কনসেপ্ট। এই রাজতন্ত্রের কনসেপ্ট এ প্রধানমন্ত্রী রাজা, আর বাকি যারা আছে তারা সবাই প্রজা। প্রধানমন্ত্রী যদি বলে যে, ব্রিং মি হিজ/হার হেড, তাহলে সেটাই হবে। এবং আশেপাশে রাজাকে খুশি করতে এই মাথা কাটার কাজটাও উৎসাহের সাথে অনেকে করা শুরু করে দিবে।

রোজিনা ইসলামকে যে ক্লার্ক গলায় চাপ দিয়ে ধরেছিলো, তার ভাবভঙ্গি খেয়াল করলেই বোঝা যায় যে রোজিনাকে এমনভাবে হেনস্থা করার জন্য সে মনে মনে তার ঊর্ধ্বতনের কাছে পুরষ্কার আশা করে। মানে সেই প্রাচীন আমলে রাজা বাদশা, জমিদার তাদের ভৃত্যদের পুরষ্কা্র‌ নজরানা দিতেন খুশি হয়ে, সেইরকম।
এই ক্লার্ক এজন্য এতো হম্বিতম্বি করেনি যে সেটা তার পেশাগত দায়িত্ব ছিলো, সে এজন্য হম্বিতম্বি করেছে কারণ সে ভেবেছে, এরকম করলে হয়তো তার ঊর্ধ্বতন তাকে পুরষ্কার দিবে। এখানে ঊর্ধ্বতনকে সে মনে করে তার মালিক বা প্রভু, আর নিজেকে সে মনে করে তার গোলাম বা ভৃত্য।

কে মালিক হবে, কে ভৃত্য হবে এবং কে ক্ষমতা দেখিয়ে কত বড় গলায় ‘দেখে নেবো তোকে’ বলতে পারবে এই হচ্ছে মূল মানসিকতা।

লেখক: চন্দ্রাবতী
বাংলাদেশের একজন ভীত সন্ত্রস্ত নাগরিক।

আগের লেখাটির লিংক:

https://womenchapter.com/views/37775

 

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.