শাহানা লুবনা:
চিন্তা, চেতনা, মনন, মানসিকতায় নারীরা এখনও মানুষ হতে পারেনি। নারীতেই রয়ে গেল। এ সমাজকে পুরুষতান্ত্রিক করে গড়ে তোলার পেছনে পুরুষের থেকে নারীর ভূমিকাই ছিল বেশি এবং এখনও আছে। একবিংশ শতাব্দীতে এসেও এ থেকে বের হতে পারেনি।
মুখে যতই নারীর সমঅধিকারের জন্য কিংবা নারীকে মানুষ ভাববার জন্য চিৎকার চেঁচামেচি করা হোক না কেন, অন্তরে কিন্তু নিজেরাই নারী হয়ে আছে। আগে মানুষ তারপর নারী। এই বোধটুকুই নিজেদের মধ্যে জাগ্রত করতে পারে নাই। নিজেরাই যদি নিজেদের মানুষ ভাবতে না পারে, না শিখে, তবে অন্যের কাছে সেgd দাবি করাটা কতটা যৌক্তিক, কতটা ফলপ্রসূ??
যোগ্য, অযোগ্যের মাপকাঠিতে এখনও এসমাজের নারীরা একজন নারীকেই দাঁড় করায়–পুরুষকে নয়। একজন নারী যখন নিজের ব্যক্তিত্ব, রুচিশীলতা, শিক্ষা কিংবা আত্মমর্যাদাবোধের কারণে তার স্বামীকে পরিত্যাগ করে, তখন এ সমাজের নারীরাই দাড়িপাল্লা নিয়ে তৈরি হয়ে যায়। নিমিষেই মেপে ফেলে নারীটির যোগ্যতা। তাদের দৃষ্টিতে নারী যদি যোগ্য হয় সেক্ষেত্রে মন্তব্য – হায় হায় মহিলাটি এতো সুন্দরী, এতো গুণবতী, তারপরও লোকটি এমন করলো !! বিষয়টি এমন যেন নারীর যোগ্যতা কেবল তার রুপ, গুণ এবং সেই নারীকে এই সমাজের নারীরাই যোগ্যতার আসনে বসার যোগ্যতাটুকু দিয়েছে। এটাকেই তারা মনে করে নারীটির প্রতি তাদের পজিটিভ ধারণা, তার প্রতি সম্মানবোধ। প্রকৃত অর্থে যেখানে বোধের জ্ঞানটুকুই তাদের নেই। তারা জানে না কোনটা সম্মানবোধ, কোনটা কৃপাবোধ। যদি তাই জানতো তবে যোগ্যতার মাপকাঠি হতো ভিন্ন। সেক্ষেত্রে নারীর আত্মমর্যাদা, দৃঢ়তা, মানসিক শক্তি এবং তার ব্যক্তিত্বই হতো প্রকৃত যোগ্যতা।
নারীর প্রতি করুণাবোধ বা কৃপাবোধ নারীকে দুর্বল করে রেখেছে। আর এর ফলেই সৃষ্টি হয়েছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা। ” নিজেদের অধিকারের ব্যাপারে সামান্য সচেতন হলে নারীরা নিশ্চয়ই বুঝতো যে, জগতে যত নির্যাতন আছে মেয়েদের বিরূদ্ধে সবচেয়ে বড় নির্যাতন হল, তাদেরকে সুন্দরী হওয়ার জন্য লেলিয়ে দেওয়া।” এই নির্যাতনটুকু নারীরাই কিন্তু নারীর বিরুদ্ধে করছে।
পৃথিবীতে বোধকরি এটিই একটি দেশ যেখানে নারীর রূপ তার অন্যতম একটি যোগ্যতা। এধরনের মানসিকতা পুরুষকে রেখে দিয়েছে সেফ জোনে। দাড়িপাল্লায় পুরুষকে না উঠিয়ে উঠানো হয় নারীকে। যদি পুরুষের যোগ্যতা ,অযোগ্যতার দিকে আঙ্গুল উঠতো, তবে দাড়িপাল্লার উপর তাকেই দাঁড় করানো হতো। কিন্তু নারীরা সচেতন কিংবা অসেচতনভাবে তাকেই নিরাপদ স্থানে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। একজন ব্যক্তিত্বহীন, লম্পট, নেশাখোর, ব্যাভিচারি পুরুষকেও তার যোগ্যতার প্রমাণ রাখতে হয় না। এসবের ফায়দা লুটছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ। গড়ে তুলেছে তাদের শক্ত ভীত।।
সমাজে যোগ্য-অযোগ্যের মাপকাঠি নারী পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। সেটি কেবল কর্মক্ষেত্রে নয় –সামাজিক, পারিবারিক, সর্বক্ষেত্রে। এবং সেটি গ্রহণ বা বর্জন করা উভয়েরই সমান অধিকার।
যতদিন পর্যন্ত নারী কেবল গ্রহণ করবে, যতদিন পর্যন্ত সে বর্জন করা না শিখবে, ততদিন পর্যন্ত এই সমাজ পুরুষতান্ত্রিকই থাকবে। সমঅধিকার তখনই প্রতিষ্ঠিত হয় যখন নারী পুরুষ উভয়ই গ্রহণ বর্জনের ক্ষমতা সমানভাবে মানসিকতায় ধারণ করে। বর্জনের অধিকার পুরুষের হাতে দিয়ে কখনও সমঅধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় না।
যা সুন্দর, যা মঙ্গল, যা কল্যাণকর তা গ্রহণের অধিকার যেমন সকলের রয়েছে, তেমনই যা অসুন্দর, যা অমঙ্গল. যা অকল্যাণকর তা বর্জনের মানসিকতাও সকলের থাকতে হবে। যতদিন পর্যন্ত নারী-পুরুষ উভয়ই এ থেকে বের হতে না পারবে, যতদিন পর্যন্ত নিজেদের মানুষ ভাবতে না পারবে ততদিন পর্যন্ত এ সমাজ কলুষিতই থাকবে।