রেমিটেন্স যোদ্ধার স্বপ্ন!

আইরিন হক:

গত ২৫ মার্চ দোহা এয়ারপোর্ট হয়ে ঢাকায় গিয়েছিলাম। যেহেতু বাংলাদেশের অনেক শ্রমিক আরববিশ্বে কাজ করে সেজন্য ধরেই নিয়েছিলাম দোহা-ঢাকা উড়োজাহাজটিতে অনেক বাংলাদেশি শ্রমিক থাকবে, এবং হলোও তাই। এই মহামারীর সময়ও ফুল ফ্লাইট!

প্রতিটি যাত্রীর চেহারায় যেন অধীর প্রতিক্ষার ছাপ কখন দেশের মাটির গন্ধ পাবে, এক আশ্চর্য অনুভূতিতে ভরা অবয়ব সবার। নিজ দেশে প্রিয় মানুষদের কাছে যাচ্ছে, সুতরাং সবারই হাতে ওভারসাইজ ক্যারিঅন ব্যাগ। উড়োজাহাজের ট্যাক্সি টাইম পার হয়ে যায় যাত্রীদের ঠেসে-ঠুসে ক্যারিঅন লাগেজ ওভারহেড বিনে ঢুকানো শেষ হয় না, শেষে কেবিন ক্রুদের সাহায্যে এবং তদারকিতে ক্যারিঅনগুলোর গতি হয়।

আমার পাশের সিটে বসেছিল একজন বাংলাদেশি শ্রমিক, পাতলা ছিপছিপে মানুষ, বয়স হয়তোবা তিরিশের কিছু বেশি হবে। ভালো লাগছিল এই ভেবে যে ওর সাথে কথা বলে কিছুটা সময় পার করা যাবে, জানা যাবে আরব দেশে ওর কাজের অভিজ্ঞতার কথা।

লোকটিকে জিজ্ঞেস করলাম দোহাতে কী করে। বললো কন্সট্রাকশনের কাজ করে, কিন্তু কাজটা পারমানেন্ট কাজ নয়। ওখানে বাংগালি কিছু ঠিকাদার আছে, তারাই বিভিন্ন কন্সট্রাকশন প্রজেক্ট যোগাড় করে এসব শ্রমিক দিয়ে কাজ করিয়ে নেয়। জিজ্ঞেস করলাম পারিশ্রমিক কি ঠিক আছে? ও বললো, দিনে ওর রোজগার ২২০ রিয়াল, এই মহামারির জন্য কিছুটা বেশি আগের চেয়ে, আগে ১৮০ থেকে ২০০ রিয়াল পেতো। জিজ্ঞেস করলাম, রিয়াল বাংলাদেশের টাকায় রুপান্তর করলে কি ঠিক পারিশ্রমিক বলে মনে হয়? বললো, ঠিকাদাররা যদি না ঠকিয়ে ঠিকমত টাকাটা দেয়, তাহলে ওর আয় খারাপ হয় না।

ওদের বাসস্থানের কথা জানতে চাইলে জানালো, খরচ বাঁচানোর জন্য ৭-৮ জন মিলে খাবার এবং বাড়ি ভাড়া শেয়ার করে। দুই কামরার একটি এপার্টমেন্টে থাকে, প্রতিরুমে দুটো বাংক বেড, যাতে চার জন থাকে। সবাই পালা করে রান্না এবং ঘর পরিষ্কার করে। কাজ যদি থাকে, তবে সপ্তাহে সাত দিনই দিনে ১০ থেকে ১২ ঘন্টা কাজ করে, আর প্রতি মাসে মা এবং স্ত্রীকে ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা পাঠায়। সুতরাং মোটামুটি ভালোই আয় হয় সব খরচ বাদ দিয়ে, একজন্য অবশ্য প্রচণ্ড পরিশ্রম করতে হয়।

আমি জিজ্ঞেস করলাম আরবে এরকম কাজ কীভাবে পাওয়া যায়? ও বললো, বাংলাদেশে কিছু ম্যানপাওয়ার এজেন্ট আছে তারা এক বৎসরের ওয়ার্ক ভিসা করে দেয় চার হাজার রিয়ালের বিনিময়ে এবং প্রতি বৎসর তা রিনিউ করতে হয়। আমি ওকে বললাম, যতদূর জানি সরকারও এর চেয়ে অনেক কম পয়সায় ওয়ার্ক ভিসার ব্যবস্থা করে। তখন ও জানায়, সরকারিভাবে ভিসা নেয়া প্রায় অসম্ভব, কারণ সরকারি কর্মকর্তারা তাদের নিজস্ব লোকদের ভিসা করে দেয়ায় বেশি ব্যস্ত, পরিচিত না হলে সম্ভব না।

ওর কাছে জানতে চাইলাম দোহাতে কাজের পরিবেশ কেমন, বললো, খারাপ না, তবে প্রচণ্ড গরমে বাইরে কাজ করতে হয়, কখনো কখনো ওয়েল্ডিং মেশিনের কাজ করার সময় গা পুড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়, বোতল ভরে ভরে পানি খেয়েও যেন কোন লাভ হয় না। জিজ্ঞেস করলাম, আপনি যে বললেন ঠিকাদার যদি ঠিকমত টাকা দেয়, মানে কী? বললেন, ঠিকাদাররা বেশ কয়েকবারই ওকে সারা সপ্তাহ কাজ করিয়ে সপ্তাহ শেষে আজ দিব কাল দিব করে টাকাটা আর দেয়নি। জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কোন একশন নেননি? বললেন, কাকে বলবো? বার বার তাগাদা দিয়ে একসময় আর খোঁজ নেই না, খালি ভাবি এ কষ্টের টাকা মানুষ কীভাবে মেরে খায়! সবসময়ই কিছু না কিছু কাজ পাই বলে আর ঝামেলার মধ্যে যাই না, সবশেষে যা পাই তাই দিয়েই ভবিষ্যতে কিছু করতে চাই।

এবার আমি জিজ্ঞেস করলাম ওর ভবিষ্যত পরিকল্পনা কী! বললেন, আরও কিছুদিন কাজ করে টাকা জমিয়ে দেশে মানে ওর গ্রামে ফিরে যাবে, ব্যবসা করবে, ভবিষ্যত প্রজন্মকে স্কুল কলেজে পড়াবে যেন ওর মতো এতো হাড় ভাঙ্গা কাজ করতে না হয়! জানালেন, ওর ছোট ভাইটিও সিংগাপুরে মাইগ্রেন্ট ওয়ার্কার হয়ে কাজ করছে। ও আশা করে দু’ভাই মিলে ভালো কিছু একটা করবে দেশে ফিরে।

বাংলাদেশের ১০ মিলিয়নেরও বেশি মাইগ্রেন্ট ওয়ার্কার বিভিন্ন দেশে গিয়ে কাজ করছে ফলে বাংলাদেশের জিডিপির ১৬ শতাংশ এই বিদেশের রেমিটেন্স থেকে আসে। গত অর্থ বৎসরে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডাটা অনুযায়ী প্রায় ২০ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার বাংলাদেশের অর্থনীতির ফরেন রিজার্ভে যোগ হয়েছে, যদিও মহামারীর জন্য আশা অনুযায়ীর কিছুটা কম, তারপরও তারও আগের অর্থবৎসরের তুলনায় বেশি।

যুগে যুগে যেসব দেশে সুযোগ সীমিত- ভাগ্য অন্বেষণের জন্য সেসব দেশের মানুষ অন্য দেশে মাইগ্রেট করে বা অন্যদেশের মাইগ্রেন্ট ওয়ার্কার হয়ে কাজ করে। একটি দেশের অর্থনীতিতে বিশেষ করে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের অর্থনীতিতে এসব শ্রমিকদের কন্ট্রিবিউশন খুবই মূল্যবান। আমি জানি না ঐ শ্রমিকটি জানেন কিনা যে ওনি আমাদের দেশের কত মূল্যবান একজন মানবসম্পদ! দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক অবস্হা ভালো হলে হয়তো কোন সময় এরকম মানব সম্পদরা বুঝতে পারবে ওদের মূল্য, ফলে ওরা সচেতন হয়ে আদায় করে নিবে ওদের অধিকার, প্রতারণার শিকার আর হবে না, আর সফল হবে ওর স্বপ্ন, যা ও এই কঠিন পরিশ্রম দিয়ে আদায় করতে চায়।

শেয়ার করুন: