নিজ জীবনের স্বাধীনতার স্থপতি নারী নিজেই

রোকসানা আক্তার ঝর্ণা:

আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীরা কি শুধু শ্বশুর বাড়ি আর স্বামীর হাতেই নির্যাতিত হয়? বৈষম্যের শিকার হয়? বাবার বাড়িতে কি হয় না? মেয়েরা নাকি পরের ধন! বিয়ের পরে ‘পর’ হয়ে যায়। মেয়েরা কি পর হয়?

আমাদের দেশে এখনও অধিকাংশ পরিবারেই যখন কোন দম্পতির প্রথম পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করে, তখন মিষ্টি বিলিয়ে দেয়ার উচ্ছাস দেখেই পরিবারের খুশির মাত্রা যে কত বেশি তা আন্দাজ করা যায়। এমনকি আত্মীয়-অনাত্মীয়রাও পুত্র জন্ম নেয়ার আনন্দের মিষ্টি খেতে খেতে আলহামদুলিল্লাহ বলে শুকরিয়া আদায় করেন। অথচ যখন সেই পুত্রের জায়গায় কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করে, তখন মিষ্টি বিলানোর উচ্ছাসটা আর ওই রকম চোখে পড়ে না। সবাই এটাই বলে সান্ত্বনা দেয় যে পরেরবার ছেলে হবে, কিন্তু দ্বিতীয়বার যখন আবার কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করে, তখন মনের অমাবস্যা পরিবারের মানুষদের চেহারায় এসে ফুটে উঠে। এমনকি যখন কোন দম্পতির দুই-তিনজন কন্যা সন্তান থাকে, তখন আত্মীয় স্বজন পুত্র সন্তান না থাকায় ওই দম্পতিকে করুণার চোখে দেখে।

আমাদের পিতৃতান্ত্রিক সমাজে যুগ যুগ ধরে এটাই মনে করা হয় যে, পুত্র সন্তান হলো বংশের বাতি এবং শেষ বয়সে সেই পুত্রই পিতা মাতাকে দেখাশোনা করবে। এখনকার বাস্তবতায় যদিও উল্টাটাই হয়। দেখা গেছে কন্যা যদি পড়াশুনা করে স্বাবলম্বী হয়, তবে পুত্রের চাইতে সেই বাবা মায়ের দেখাশোনা বেশি করে, কিন্তু আমাদের পিছিয়ে পড়া পুরুষতান্ত্রিক সমাজ সেটা মানতে রাজি নয়।তাই এখনও প্রথম কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করলে বেশিরভাগ মানুষেরই ভিতরে ভিতরে একটা আশাহত বেদনা কাজ করে।

অধিকাংশ নারীই সেই ছোটবেলা থেকেই নিজ পরিবার পরিজনের দ্বারাই নির্যাতিত এবং বৈষম্যের শিকার হতে শুরু করেন শুধু নারী হয়ে জন্ম নেয়ার কারণেই। আর সেটা রান্না ঘর থেকে বা খাবার টেবিল থেকেই প্রথম শুরু হয়, তারপর ঘরের কাজে, পোশাকে আশাকে, লেখাপড়ার সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে, এমনকি আচার আচরণেও। একটা ছোট বাচ্চা মেয়ে দেখতে দেখতে বড় হতে থাকে পরিবারে তার আর তার ভাইয়ের অবস্থানের বৈষম্য। বাড়িতে পরিবারের অভিভাবকদের যত শাসন শৃঙ্খলার বেড়ি মেয়েদের ক্ষেত্রে যত কঠিন, ছেলেদের বেলায় ততটাই উদার। বাড়ির কোন মেয়ে সন্ধ্যার পর বাড়ির বাইরে যেতে পারবে না, এমনকি কোন বান্ধবীর বাসায় যেতেও অনুমতি মেলে না। কিন্তু ছেলে রাত দশটায় ফিরলেও ক্ষতি নেই। অনেক সময় অভিভাবক জিজ্ঞাসা করারও প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন না যে সে এতোক্ষণ কোথায়, কাদের সাথে ছিল, অথচ মেয়ে যখন কোন জরুরি কাজে বাইরে যায়, তখন মা-বাবা, এমনকি বড় ভাই ঘরে থাকলে তারও অনুমতি নিয়ে তারপর ঘরের বাইরে যেতে হয়। যদি কোন কারণে ফেরার নির্দ্দিষ্ট সময়ের পরে ঘরে ফিরে, তবে বকুনি থেকে শুরু করে অনেক সময় চপেটাঘাতও সহ্য করতে হয়।

আবার বাড়ির ভিতরে মেয়েদের সব ধরনের ঘরের কাজ এবং রান্নাবান্না শিখতে হয় এবং করতে হয়, অথচ ছেলেদের এক কাপ চা নিজে বানিয়ে খাওয়া, নিজের বিছানা ঠিক করা, কাপড় ধোয়া কিছুই করতে হয় না। অনেক সময় ভাইয়ের এই কাজগুলো বোনেরা ভালবেসে করে, কিন্তু অনেক অভিভাবকই সেটা সেই ছেলের প্রায় সমবয়সী বোনটাকে দিয়ে বাধ্যতামূলক করিয়ে নেন। মেয়ে করতে না চাইলে কারণ হিসেবে বলা হয় এটা ছেলেদের কাজ না, এটা মেয়েদের কাজ। এমনকি ঘরে টেলিভিশনের রিমোট কন্ট্রোলটাও অনেক সময় পরিবারে ছেলের দখলে থাকে। বোনের পছন্দের চাইতে তার পছন্দ অনুযায়ী চ্যানেল দেখার অগ্রাধিকার থাকে বেশি, কারণ সে পুরুষ। ঘরে ভালো রুম, ভালো বিছানা, ভালো খাবার, বড় মাছের টুকরোগুলো পরিবারের পুরুষদের জন্য তুলে রাখা হয়, আর যে নারীরা সারাদিন খেটেখুটে খাবার তৈরি করলো তাদের জন্য পাতিলে যা পরে থাকবে, তাই খাবে। এই চিত্রটা শহরে গ্রামে যেখানেই খুঁজবেন অধিকাংশ পরিবারেই এই চিত্র পেয়ে যাবেন। কোন পছন্দের জিনিস চাইতে গেলে মেয়েকে অনেক সময় অভিভাবকের কাছে কান্নাকাটিও করতে হয়, কিন্তু তারই প্রায় সমবয়সী ভাইটা হয়তো চাহিবামাত্ৰ পেয়ে যায়। নারীদের সেই ছোটবেলা থেকেই নিজ পরিবারে এসব বৈষম্য ,অনাদর আর অনাচার দেখতে দেখতে এক সময় গা সওয়া হয়ে যায়। ভাবে এটাই তার নারী হয়ে জন্ম নেয়ার নিয়তি।

অভিভাবকেরা নারীদের শৈশব থেকেই মেয়ে হিসাবেই বড় করেন , যে শুধু সংসারে দিয়ে যাবে পুরুষের চাহিদা অনুযায়ী। কিন্তু মেয়েটি একজন আত্মমর্যাদা, আত্মসম্মান বোধসম্পন্ন এবং অধিকার সচেতন মানুষ হিসাবে যাপিত জীবনের কঠিন পথগুলো কীভাবে মনোবল অটুট রেখে মাথা উঁচু করে অতিক্রম করে চলতে হবে সেই পাঠ তাকে দেয়া হয় না, ফলে যখন একজন নারী পিতৃগৃহ থেকে বের হয়ে অন্য আরেকটা অচেনা পরিবেশে, অচেনা মানুষদের সাথে যখন পারিবারিক বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যৌথ জীবনযাপন করতে শুরু করে, তখন সেই জীবনটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাবার বাড়ির জীবনের চাইতেও কঠিন এবং অমানবিক হয়। তখন যৌথ জীবনের এই কঠিন পরিস্থিতি বুঝতে আর ম্যানেজ করে চলতে গিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ে। বাবার বাড়িতে গিয়ে কোন সমস্যার বা নির্যাতনের প্রতিকার বা সাপোর্ট চাইতে গেলে উল্টা নিজ পরিবারের আপন মানুষের কাছ থেকে শুনতে হয় যে শ্বশুর বাড়িতে এক আধটু এমন হয়ই, মেয়েদের একটু সমঝে বুঝে চলতে হয় , তারপর সমাজ কী বলবে ইত্যাদি ইত্যাদি। ফলে নারী আরও বেশি অনিশ্চয়তা, নিরাপত্তাহীনতায় , দ্বন্দ্বে ,অসহায়ত্বে আর মনোবেদনায় কষ্টে দিনপাত করতে থাকে। কেউ কেউ এর ফলে মানসিক বা শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে। কিন্তু তারপরও তার রেহাই মেলে না। কেউ কেউ কোথাও কোন আশ্রয় না পেয়ে এবং এই কঠিন অবস্থা আর সহ্য না করতে পেরে আত্মহত্যাও করে।

একসময় যে বাবার বাড়ির ধুলো মাটি হওয়া পানি এবং গাছের ছায়ায় নারী বড় হয়ে উঠে, বিয়ের পর সে বাড়ি সেই পরিবেশটাই অচেনা হয়ে যায়। এমনকি মা-বাবার রেখে যাওয়া সম্পত্তির সঠিক পাওনাটুকু থেকেও বঞ্চিত হয়, তাও ধর্মের নিয়ম বহাল রাখার অজুহাতে নিজ আপন মানুষদের দ্বারাই। যে ছেলে সন্তানরা হয়তো মা-বাবা বেঁচে থাকতে তাদের কষ্টের কারণ হয়েছে, তারাই তখন শরীয়তের বিধান দিয়ে বোনদের বঞ্চিত করে। সেটা শিক্ষিত কী অশিক্ষিত মেটার করে না। নারী মানেই সুযোগ পেলে তাকে বঞ্চিত করতে হবে, বৈষম্যের শিকার হতেই হবে।

তাই আমাদের সমাজে নারীরা ছোটবেলা থেকেই আপোসকামী হতে বাধ্য হয়। তবে জীবনের এই বৈপরিত্য এবং উজান ঠেলে ঠেলে বড় হয়ে উঠা নারীদের কারও কারও মধ্যে একসময় এক স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য গড়ে উঠে, সে স্বাবলম্বী হয়, নিজের অধিকার বুঝতে শেখে । সে মাথা উঁচু করে চলতে শেখে এবং সমাজের নিয়ম ভেঙে ,আপোসকামিতা ঝেরে বের হয়ে আসে এবং নিজ যাপিত জীবনের বাকি পরিক্রমায় লিঙ্গ বৈষম্যহীন মানসিকতার একজন ‘মানুষ’ হিসাবে পথ চলার রূপকার সে নিজেই হয়ে উঠে।

তাই নিজ জীবনের স্বাধীনতার স্থপতি নারী আসলে নিজেই। স্যালুট সেইসব নারীদের, কারণ এই যুদ্ধ বড় কঠিন। যুদ্ধটা নিজের সাথে, নিজের আবেগের সাথে , আপন মানুষদের সাথে , সমাজের রীতিনীতির সাথে, সংসারের চাপিয়ে দেয়া সব শিকল নামের বন্ধনের সাথে। নারী তুমি দশভুজা! জয়তু নারী!

শেয়ার করুন: