মেয়েটা একলা থাকে

শাশ্বতী বিপ্লব: “মেয়েটা একলা থাকে, মেয়েটা ঘর করে না

মেয়েটা কেমন যেন, সমাজের ধার ধারে না।

মেয়েটার দুঃখ কি নেই?

মেয়েটার নেইকি ভয়?

জগতের চুনকালি কি

মেয়েটার জন্য নয়!!!

মেয়েটার শিরদাঁড়াটা আমাদের নয় চেনা;

মেয়েটা একলা থাকে, কারো সে নয় কেনা….”

Shaswati 5
শাশ্বতী বিপ্লব

মেয়েটা একা থাকবে বলেই একা থাকে। তার এই একা থাকার পিছনে বিশেষ কোন কারণ নেই…প্রেমে ব্যর্থতা বা পরিবার ভেঙ্গে যাওয়া কিংবা মনের মতো কাউকে খুঁজে না পাওয়ার মতো গল্প মেয়েটার ছিলো কীনা কেউ জানে না। থাকলেই কী? অমন গল্প তো কতজনেরই থাকে। তাই বলে কি তারা একলা থাকে? মেয়েটা একা থাকবে বলেই একা থাকে। মেয়েটা এই একা থাকাটাকে ভালোবাসে।

একলা মেয়েটার আগলহীন জীবন আর বাঁধনহারা প্রাণ দেখে কেউ যদি ভ্রুকুটি করে, মেয়েটা ফিরেও দেখে না। একলা মেয়েটা প্রাণখুলে হাসে। হাসির দমকে অনভ্যস্ত চারদিক সচকিত হলে তার আনন্দ হয় বেশ। নিয়ম ভাঙ্গার আনন্দ, নিজের অস্তিত্ব জানান দেয়ার আনন্দ, প্রাণখুলে হাসতে পারার আনন্দ, একা বাঁচতে পারার আনন্দ।

একলা মেয়েটা দাপিয়ে বেড়ায় জীবন। একলা জীবন সে বেছে নিয়েছে, সাজিয়ে নিয়েছে নিজের মতো করে। কেউ তাকে বাধ্য করেনি। কখনো সে বেলী ফুলে সাজে তো কখনো স্কুটিতে তুফান তুলে ছুটে চলে রাজপথের বুক চিড়ে।

একলা মেয়েটা সারাদিন গৎবাঁধা কাজ করে হাঁপিয়ে ওঠলে অফিস শেষে জুটে যায় বন্ধুদের আড্ডায়, কখনো বা সমাজসেবা মূলক কাজ করে বা নিছক আপনমনে ঘুরে বেড়ায়। জীবনের স্বাদ সে নিতে চায় নিজের মতো করে।

একলা মেয়েটা দিনশেষে ঘরে ফেরে, তার নিজের ঘরে। নিজের মাঝে ডুব দেয় আপন মনে। ব্যালকনিতে বসে কখনো গান শোনে, কখনো কবিতা লেখে বা কখনো সিগারেটের তৃষ্ণা পেলে ধোয়ার রিং ছুঁড়ে দেয় বাতাসে। যখন যেমন ইচ্ছে।

একলা মেয়েটা মাঝে মাঝে খুব কাঁদে। নিজের মতো কাঁদতেও তার ভালো লাগে। এতোদিন দূরে দূরে থাকলেও দোকলা মেয়েটা এবার তার পাশে এসে বসে। মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় -“একা থাকা অনেক কষ্টের তাই না?”

একলা মেয়েটা চোখে কান্না নিয়েই হেসে বলে, “কই, নাতো। বেশ আছি।”

– তবে অমন করে কাঁদো কেন?

– সেটাই তো মজা। আমার যখন ভালো লাগে মন খুলে হাসি। যখন ভালো লাগে মন খুলে কাঁদি। আমার কোনটাই লুকাতে হয় না তোমার মতো।

– আমি লুকাই বুঝি?

– লুকাও তো। কান্না গিলে গিলে তোমার চোখগুলো কেমন মেঘলা হয়ে থাকে সবসময়। কান্নার গ্রহণযোগ্য কারণ লাগে তোমার, আমার লাগে না। মন খুলে কাঁদতে পারলে কত ভালো লাগে, তুমি বুঝবে না।

– তা বটে। আমার সন্তানেরা আমার বুকে লেপ্টে থাকে যখন, আহ্, কী শান্তি! ওদের মুখে হাসি ফুটাতে, একবার মা ডাক শুনতে আমি অমন হাজার কান্না হাসিমুখে গিলতে পারি। তুমি বুঝবে না।

একলা মেয়ে খানিক উদাস হয়, বলে – যা নেই, যা আমার কখনোই ছিলো না, সেটা না থাকার শূন্যতাকে আমি ছুঁতে পারি না। এমনি কত জিনিসই তো আমাদের নেই।

একলা মেয়ে বলতে থাকে, তোমার সংসার আছে, সন্তানের সুখ আছে। কিন্তু তোমার ঘর কি বালুচরে বাঁধা নয়, বলো? তোমার সেই সুখের ঘর ভেঙ্গে পড়তে চায় না কি যখন তখন? কত তুচ্ছ কারণে তুমি ছেড়ে যাও সেই ঘর। আবার কত গুরুতর অন্যায়কে মেনে নিয়েও একসাথে বাস করো।

আর আমাকে দেখো। আমার দোকলার ঘরও নেই, ঘর ভাঙ্গার শঙ্কাও নেই, মানিয়ে নেয়ার কষ্টও নেই। তুমি ঘরের জানালা দিয়ে এক চিলতে আকাশ দেখো,  আর আমার আকাশটা মুক্ত খোলা। আমি চাইলেই তারাদের গুনতে পারি সারারাত।

দোকলা মেয়ের হাত ধরে একলা মেয়েটা বলে, তবে তুমি মানুষ গড়ার কারিগর। সৃষ্টিকর্তা তোমার দিকে তাকিয়ে থাকে তার কাজের ভাগ নেয়ার জন্য। তুমি মায়াবী, তুমি যাদুকর। কেমন মায়ার বাঁধনে বেঁধে রাখো সবাইকে। তুমি আছো বলেই আমি আছি।

তবু শোনো, আমি তোমার সন্তানের জন্য নতুন দিনের পথ বানাই। পথের বাঁকে বাঁকে বুনে দেই দুঃসাহসের বীজ। গৎবাঁধা চাপিয়ে দেয়া নিয়মকে অস্বীকার করেছি আমি। আমার চলার পথে এখনো অনেক বাঁধা, জানোতো। একদিন আমার দেখানো এই পথে দুঃসাহসেরা ফুল ফুটাবে, দেখে নিও। তোমার মেয়ে মাথা উঁচু করে হাঁটবে এই পথে, কেউ তাকে বাঁধা দেবে না। তোমার ছেলেও কাছেও তা সুন্দর, স্বাভাবিক মনে হবে। কথা দিলাম।

(যারা জীবনের পথে একলা হাঁটেন সাহসের সাথে, তাদের প্রতি উৎসর্গিত)

 

শেয়ার করুন: