নারীর সামাজিক অবস্থান: আমার গবেষণার কথোপকথন

সাবরিনা স. সেঁজুতি:

আমার পিএইচডি গবেষণার বিষয়বস্তু পুঁথিগত ভাষায় ব্যাখ্যা না দিয়ে যদি সাধারণ ভাষায় বলি, তাহলে প্রথমেই বলতে হয় আমি কাজ করেছি একদল নারীর জীবন-অভিজ্ঞতা নিয়ে। এমন একদল নারী যারা অনেক চড়াই-উৎরাইয়ের পর অস্ট্রেলিয়াতে আসতে সক্ষম হয়েছেন এবং সফলতার সাথে পিএইচডি করছেন।

তাদের অভিজ্ঞতার আলোকে আমি প্রমাণ করতে চাইছি যে নারী যখন একাধিক সমস্যার মধ্য দিয়ে যায় তখন তিনি এমন একটি সামাজিক স্থানে অবস্থান করেন, যা কেবল ভুক্তভোগী নারী ছাড়া অন্য কারও পক্ষে ব্যাখ্যা করা বা বোঝা অসম্ভব। সেকারণে এসব ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীর নিজস্ব বিশ্লেষণ গুরুত্বপূর্ণ। পুঁথিগত বা একাডেমিক ভাষায় একে থিওরি অফ ইন্টারসেকসনালিটি (Theory of Intersectionality) এবং ফেমিনিস্ট স্ট্যান্ড পয়েন্ট থিওরির (The Feminist Standpoint Theory) কম্বিনেশন বলা যেতে পারে।

তবে আজকে একাডেমিক বা থিওরির খটমট কথাগুলো আলোচনা না করে আমার গবেষণার ছোট একটা ফাইন্ডিংস নিয়ে কথা বলতে চাই। ইংরেজি ভাষাভাষিদের সাথে এ বিষয়ে বেশ কয়েকটি প্ল্যাটফর্মে ইতিমধ্যে বেশ কয়েকবার কথা হয়েছে, তবে বাংলা ভাষাভাষিদের জন্য এখন পর্যন্ত কিছুই লেখা বা বলা হয়নি। তার একটি অন্যতম কারণ হলো, বাংলায় এই জটিল বিষয়টি কীভাবে উপস্থাপন করবো তা বুঝে উঠতে পারছি না।

আমার গবেষণায় যারা অংশগ্রহণ করেছিলেন তারা ছিলেন বিভিন্ন দেশের নাগরিক। আমেরিকা, আফ্রিকা, চায়না, বাংলাদেশ, ভারত, ইউরোপ, মালয়েশিয়া- নানা অঞ্চল/দেশ থেকে অস্ট্রেলিয়াতে এসেছেন পিএইচডি করতে। তাদের আর্থিক এবং সামাজিক অবস্থাও ভিন্ন ভিন্ন। কেউ খুব ধনী পরিবারের শহুরে নারী। কেউবা ছোট কোন গ্রামের মধ্যবিত্ত বা দরিদ্র পরিবারের সন্তান। কেউ সারা জীবন পড়াশোনা করার জন্য পদে পদে লড়েছেন, কেউবা বাবা-মা, ভাইবোনের সহযোগিতায় সামাজিক রীতিনীতির বিরুদ্ধে এখনও লড়ে যাচ্ছেন। তাদের এই লড়াইয়ের পেছনে যেই ফ্যাক্টরগুলো খুবই প্রমিনেন্ট তা হলো – তাদের লৈঙ্গিক/জেন্ডার ও জাতিগত পরিচয়, আর্থিক অবস্থা এবং ধর্মীয় বিশ্বাস। তাদের জীবনের পথটি দুর্গম হয়েছে এই ফ্যাক্টরগুলোর ইন্টারসেকসনের কারণে। অর্থাৎ শুধু নারী কিংবা শুধু দরিদ্র হওয়ার কারণে তাদের যাত্রাপথ দুর্গম হয়নি, বরং তাদের সকল পরিচয় একত্রিত হয়ে তাদেরকে এমন একটি সামাজিক অবস্থানের মধ্যে ফেলেছে, যা থেকে বের হয়ে আসা ছিল তাদের জন্য কষ্টসাধ্য।

একই পরিবারে বেড়ে ওঠা একটি ছেলে আর একটি মেয়ের সামাজিক অবস্থান কখনও এক হয় না। সমাজ ছেলেটিকে ছেলে হিসেবে যে সুবিধা দেয়, মেয়েটি শুধু মেয়ে হওয়ার কারণে সেই সুবিধাগুলো থেকে বঞ্চিত করে। একইভাবে ছেলে হবার কারণে ছেলেদের অনেক অসুবিধার মধ্য দিয়েও যেতে হয়, যা মেয়েদের যেতে হয় না। ঠিক সেভাবেই একই সমাজ বা কমিউনিটির দুইজন নারীর জীবন দুইরকম। কারণ তাদের জীবন অভিজ্ঞতা সংজ্ঞায়িত হয় তাদের ব্যক্তিগত-পারিবারিক পরিচয়, ধর্মীয় বিশ্বাস, আর্থিক অবস্থা ইত্যাদি পরিচয়ের ভিত্তিতে। তবে উল্লেখ্য যে নারীদের মধ্যে অনেকেই জানেন না যে তাদের জীবনের অধিকাংশ সমস্যার সূত্রপাত তাদের লৈঙ্গিক/জেন্ডার এবং জাতিগত পরিচয় থেকে শুরু হয়েছে। অনেকেই মনে করেন তাদের যাবতীয় সমস্যা আসলে তাদের ব্যক্তিগত সমস্যা, অথবা দুর্ভাগ্যজনক কারণে তার সাথে এমনটা ঘটছে। এক্ষেত্রে তাদের জেন্ডার বা বর্ণ পরিচয়ের কোন ভূমিকা আছে কিনা তা তারা জানেন না, এবং জানতে চান না।

তবে আমার গবেষণায় এমন কিছু নারী অংশগ্রহণ করেছিলেন যারা জেন্ডারভিত্তিক বৈষম্য এবং বর্ণবাদ সম্পর্কে বিশদ ধারণা রাখেন। সেক্ষেত্রে তাদের প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান এবং পারিপার্শিক সামাজিক অবকাঠামো সহায়ক ছিল। তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা ছিল মুখ্য। তারা বুঝেছিলেন জেন্ডারভিত্তিক বৈষম্য এবং বর্ণবাদ কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বিশ্বজুড়ে এর প্রভাব নারী জীবনে এবং নারী উন্নয়নের পথে বাধা তাই তার লড়াইটা শুধু তার নিজের নয় বরং সকল নারীর। এইসকল নারীদের মধ্যে অন্য নারীদের প্রতি সহযোগিতামূলক হাত বাড়িয়ে দেবার প্রবণতাও বেশি। তারা জানেন, একজন নারী, সে যেই দেশে বা সমাজেই বেড়ে উঠুক না কেন, তার যাত্রা পথ কখনই মসৃণ হয় না।

একাডেমিক ভাষায় আমরা একটা কথা বলতে খুব পছন্দ করি তা হলো যেকোন সমস্যা সমাধানের প্রথম ধাপটি হলো ভুক্তভোগীর মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করা। যে সচেতনতা ভুক্তভোগীকে বোঝাবে যে সে সমস্যায় আছে। তারপর তাকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখাবে সমস্যার শেকড় কোথায়। সর্বশেষ ধাপটি হলো, শেকড় উপরে ফেলা।

অন্যদিকে অসচেতনতা মানুষকে হা হুতাশ করতে শেখায়, সমাধান খুঁজে দেয় না। অসচেতনতা শেখায় অন্যের দোষ খুঁজতে, সমস্যার সমাধান সেখানে হয় না। তাই বিশ্বজুড়ে নারীরা যতোদিন তাদের অবস্থান বুঝে উঠতে না পারছেন এবং নিজ নিজ জায়গা থেকে কথা বলতে ব্যর্থ হচ্ছেন, ততদিন পর্যন্ত নারী স্বাধীনতার কোন সম্ভাবনা দেখছি না। সেক্ষেত্রে নারীর শিক্ষাগত যোগ্যতা কাগজের অক্ষরে বাঁধা পড়ে থাকবে, আর আর্থিক স্বচ্ছলতা প্রসাধনীর পেছনে ব্যয় হয়ে যাবে।

পিএইচডি ক্যান্ডিডেট, নিউক্যাসল ইউনিভার্সিটি, অস্ট্রেলিয়া

শেয়ার করুন: