উইমেন চ্যাপ্টার: শিশুদের সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে গণমাধ্যমকে সংবেদনশীল হওয়ার পাশাপাশি টেলিভিশন এবং সংবাদপত্রের সমন্বিত নীতিমালা তৈরির আহ্বান জানিয়েছেন বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। এদের মধ্যে আছেন কয়েকজন শীর্ষ অধিকার কর্মী ও আইনজীবী, সাংবাদিক এবং শিক্ষক।
সম্প্রতি নিহত এক দম্পতির সন্দেহভাজন কিশোরীকন্যা ঐশী রহমানকে নিয়ে সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে দায়িত্বহীনতার অভিযোগের প্রেক্ষাপটে শুক্রবার অনলাইন সংবাদপত্র বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম এক গোলটেবিল আলোচনার আয়োজন করে।
এদিকে একই কারণ নিয়ে টকশোর আয়োজন করে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল সময়।
‘সংবাদে ঐশী: পুলিশ ও গণমাধ্যমের আচরণ’ শীর্ষক বিডিনিউজের আলোচনায় শিশুদের বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে অভিভাবকদের ভূমিকারও সমালোচনা করেন আলোচকরা।
রাজধানীর ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক আনোয়ারা সৈয়দ হক বলেন, ‘গণমাধ্যমগুলোতে সবার আগে সংবাদ প্রচারের প্রতিযোগিতা থেকেই খুনের ঘটনায় ঐশীর সম্পৃক্ততা নিয়ে রগরগে সংবাদ প্রচার করা হয়েছে’।
শিশুদের নিয়ে সংবাদ সংগ্রহ ও তার প্রকাশ নিয়ে সংবাদকর্মীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার ওপর জোর দেন তিনি।
পুলিশের সমালোচনা করে এই মনোরোগ বিশেষজ্ঞ বলেন, “খুন করার কথা স্বীকার করলেও কেন রিমান্ডে নিতে হবে।”
সাংবাদিক আফসান চৌধুরী বলেন, “আমরা আইন ভাঙব এটাই যেন আমাদের জাতীয় ধর্ম। আমরা ভাবি, আইন ভাঙলে আমাদের শাস্তি দেবে কে? আমাদের দেশে প্রেস কাউন্সিল আছে কিন্তু আমরা কেউ পাত্তা দিই না।”
তিনি বলেন, “আমরা নিজেরা যদি সিদ্ধান্ত নেই আমরা (সাংবাদিক) কয়েকজন মিলে একটি নীতিমালা তৈরি করব এবং এগুলো মেনে চলব তাহলেই কেবল এ আইনগুলো মেনে চলা সম্ভব।”
সাংবাদিকদের দায়িত্বজ্ঞান নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে তিনি বলেন, “যারা আইন বানায় তাদেরও আমরা শ্রদ্ধা করি না, নীতিমালাও মানি না।”
‘সাংবাদিক ও বিচারকদের প্রভাবিত হওয়ার কোনো জায়গা নেই’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, “এদের অন্য মানুষ থেকে আলাদা থাকা দরকার।”
গণমাধ্যম প্রভাবিত হয়ে পড়লে কখনোই সঠিক তথ্য দিতে পারে না বলেও মতপ্রকাশ করেন এই সাংবাদিক।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইউএম হাবিবুন নিসা শিশুদের নিয়ে তার দেড় দশকের অভিজ্ঞতার বর্ণনা করে বলেন, ‘আমরা শিশু ও বড়দের বিচারের পদ্ধতি এক করে ফেলেছি। কাউকে দোষী করার আগে গণমাধ্যমের দায়িত্বশীলতার বিষয় রয়েছে। কিন্তু আমরা সত্যকে শ্রদ্ধা করি না’।
“একটা মানুষকে বিচারের আগেই এক্সপোজড করে ফেললাম এটা মানবাধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকে বড় অপরাধ।
সন্দেহভাজনদের টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে দাঁড় করিয়ে সাংবাদিক সম্মেলন আয়োজনের সমালোচনা করে তিনি বলেন, “দাগী খুনিকেও কি ক্যামেরার সামনে এক্সপোজ করতে পারেন? রাষ্ট্রের দায়িত্ব পানিশমেন্ট দেয়া নয়, কারেকশন (সংশোধন) করা। শাস্তি দিয়ে সুখ ভোগ করার জন্য না। এগুলো দিয়ে আমরা প্রতিহিংসার বীজ বপণ করছি।”
মনোরোগ পরামর্শক ফরিদা আক্তার কিশোরী ঐশীর জীবন পদ্ধতি নিয়ে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের খবরের কথা উল্লেখ করে বলেন, “ড্রাগ নেয়ার আগে একটা অবস্থান থাকে, সে কোনো কিছুকেই মানে না, সময় মতো কিছুই করে না। এসব দেখে অভিভাবকদের সাবধান হওয়া উচিৎ।
তার মতে, বর্তমান অবস্থায় এই কিশোরীর চিকিৎসা লাগবে কিনা, কাউন্সেলিং দরকার কিনা- তা দেখার দায়িত্ব রাষ্ট্রের।
শিশুদের বড় করার ক্ষেত্রে নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে সাংসদ বেবী মওদুদ বলেন, “ছোটবেলা থেকেই শিশুদের বইপড়া ও গান শোনার ব্যবস্থা করা উচিৎ।”
ঐশী ও তাদের শিশু গৃহকর্মীকে রিমান্ডে নিয়ে শিশু অধিকার আইন লঙ্ঘন করা হয়েছে দাবি করে তাদের নিয়ে খবর প্রকাশের ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের ভূমিকার কঠোর সমালোচনা করেন ইউনিসেফের যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ শাকিল ফয়জুল্লা।
তিনি বলেন, “গণমাধ্যমের কোনো ওয়াচডগ নেই। সব মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য কেন কাউন্সিল থাকবে না?”
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম কার্যালয়ে আয়োজিত এ আলোচনা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে আরো ছিলেন সাংসদ ও আইনজীবী ফজিলাতুন্নেছা বাপ্পি, ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল এক্সেল একাডেমীর ভাইস প্রিন্সিপাল সেবা তাসমিন হক এবং হ্যালো ডট বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের শিশু সাংবাদিক সামিন ইয়াসার প্রিয়ম।
দুই ঘণ্টার এই বৈঠকের সঞ্চালনায় ছিলেন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক মোজাম্মেল হোসেন মঞ্জু।
এদিকে সময় টেলিভিশনের টকশোতে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. কাবেরী গায়েন, সাংবাদিক জাহিদ নেওয়াজ খান, সুপ্রীতি ধর এবং একাত্তর টিভির সিনিয়র রিপোর্টার পারভেজ রেজা।
এখানেও আলোচনায় এই একটি ঘটনাতে মিডিয়া এবং পুলিশের সমালোচনা করে বলা হয়, সবারই এখানে দায়-দায়িত্ব রয়েছে। নিজের ওপর একটা নিয়ন্ত্রণ আরোপের ব্যাপার আছে দুটি পেশাতেই। কতোটুকু আমি বলতে পারবো, কতটুকু পারবো না, কতটা প্রভাব পড়বে সমাজের ওপর, এগুলো ভেবেই যার যার দায়িত্ব পালন করা উচিত বলে সবাই একমত হন।
তবে চ্যানেল আই এর বার্তা প্রধান জাহিদ নেওয়াজ খান এবং পারভেজ রেজা দুজনই স্বীকার করেন যে, মিডিয়ায় অসুস্থ প্রতিযোগিতার কারণেই ভারসাম্য বজায় থাকছে না। ফলে কোনরকম নীতিমালারই তোয়াক্কা করা হয় না। অনেকসময় সাংবাদিকরাও পুলিশের ওপর চাপ সৃষ্টি করে তথ্য দেওয়ার জন্য, একথাও বলেন তারা।
কাবেরী গায়েন বলেন, দেশে একের পর এক ঘটনা ঘটছে, আর আমরা মিডিয়ার আচরণের প্রতিবাদ করছি, ক্ষোভ জানাচ্ছি। কিন্তু এভাবে চলতে পারে না। আমার মনে হয়, সবাই একসাথে বসে একটা সমন্বিত নীতিমালা গ্রহণ করতে পারেন। তাছাড়া এই নীতিমালা লঙ্ঘনের দায়ে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা হলে সাংবাদিকরা একটু নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হবে।
গত ১৬ অগাস্ট ঢাকার চামেলীবাগের একটি বাসা থকে পুলিশের বিশেষ শাখার কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমান ও তার স্ত্রী স্বপ্না রহমানের ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এই ঘটনায় নিহতদের মেয়ে ও লেভেল পড়ুয়া ঐশী রহমান ও তার বন্ধু রনি এবং গৃহকর্মী সুমিকে আটক করে পুলিশ।
এই ঘটনার প্রথমদিন থেকে ঐশী এবং তাদের পারিবারিক ছবি, গৃহকর্মী সুমির (নাবালক) ছবি মিডিয়ায় প্রকাশ হওয়ার পর ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি হয়। পুলিশ এবং মিডিয়ার ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে।