ঋতুর সঙ্গে বিরোধ কেন?

সুচিত্রা সরকার:

সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, মাসিক, ষাণ্মাসিক- এসব শব্দ দিয়ে নারীত্ব বোঝানোতে ঘোর আপত্তি আমার। বরং একটা ঘটনা বলি, যেটা খুব দাগ কেটেছিল বাল্যবেলায়!

বয়সে পাঁচ কী ছয় বছরের বড় তিথি আপু। জন্মসূত্রে ইসলাম ধর্ম পালন করে। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়াসহ অন্যান্য আরো অনুষঙ্গ তার সঙ্গী।

তো, আমার বয়সী মেয়েরা যখন জেনে গেছি এই যে আমরা মা হতে পারবো, তখন তিথি আপু কোনো নিশানা পাচ্ছে না। প্রচুর ডাক্তার-বদ্যির পেছনে লেগে আছে তার পরিবার। মাসে মাসে প্রচুর পরামর্শ। দিনে দিনে বাড়িছে দেনা। তবু তিথি আপুর ‘সেই খবরের’ কোনো দিক-নিশানা নেই।
আল্লাহর প্রতি তিথি’পুর অসীম ভক্তি। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে। আর নামাজ পড়লে নেইলপলিশ দেয়া যায় না। একবার দুঃখ করে বলেছিলো, ‘আমার যদি তোমাদের মতো হতো, সাতদিনের জন্য নেইলপলিশ পরতে পারতাম!’ এটা ধর্মের প্রতি অশ্রদ্ধা নয়, ছেলেমানুষী শখ। এবং ধর্ম ভক্তির লক্ষণ।
সুতরাং তিথি’পুর কোনো নেইলপলিশ নেই। অথচ নখ রং করার শখ বেদম। শখ পূরণ করতো, এর- তার থেকে নেইলপলিশ নিয়ে নখে লাগিয়ে। ওযুর আগে মুছেও ফেলতো।

এভাবে অনেকদিন গেল। হঠাৎ একদিন বিকেলে ফিসফিসিয়ে বললো, কাল স্বপ্ন দেখেছি। বললাম, কী স্বপ্ন? উত্তরে আরও ফিসফিস করে বললো, নিউমার্কেট থেকে অনেকগুলো নেইলপলিশ কিনছি।
বললাম, ভালো তো!

তিথি’পু দু-হাত উঁচু করে দেখালেন। তার আঙুলে শোভা পাচ্ছে খয়েরি রঙের নেইলপলিশ। অবাক হলাম না। এবার কানে কানে বললো, তিথি’পুও এবার থেকে মা হতে পারবে। লক্ষণ দেখা দিয়েছে।
আনন্দ হলো। সঙ্গে প্রশ্নও এলো, কেন নেইলপলিশ পরা যায় না! কেন নামাজ না!

এবার নিজস্ব ঘটনা।
দুর্গাপূজার জন্য সারা বছর ধরে অপেক্ষা। কখন আসবে, কখন! যে মন্দিরে ফি বছর পূজায় যাই, তার পাশ দিয়ে গেলেই পুলক জাগে- কবে সেই দিন, কবে! শাপলা, পদ্ম, গোলাপ ফোটে। তবু অপেক্ষা শিউলি- কাশের দিন কবে আসবে!

শিউলি দিন এলে, দুর্গার জন্য আমি আর আলপনা মালা গাঁথি। ইয়াব্বড়! বাদ্যি বাজে। নতুন জামার গন্ধ। মায়ের হাতে নতুন শাঁখা। তাই বছরের মধ্যে প্রিয় দিন বলতে তখন এ কটা’ই!

প্রতি বৈশাখে মা মেলায় গিয়ে বাংলা পঞ্জিকা কিনতেন। আর আমি পঞ্জিকা মিলিয়ে দেখতাম সে বছর দুর্গাপূজা কবে। ইংরেজি ক্যালেন্ডারে সেই মতো গোল্লা দিতাম। তারপর বছরভর ‘সেদিনের’ অপেক্ষা।
আগেই বলেছি মেয়েদের সাপ্তাহিক, পাক্ষিক ইত্যাদি বোঝা সাড়া। নিজস্ব অভিজ্ঞতার দরুণ। বুঝে গেছি ওসব দিনে সকালে উঠে স্নান করতে হয়। বেশি টক খেতে হয় না। আরও কীসব আজুরিকুজুরি। শিখে গেছি এটা লুকিয়ে রাখতে হয় পুরুষের কাছ থেকে। শিখে গেছি, এই আমার লজ্জা। মেয়েদের চরমতম লজ্জার নাম ‘মাসিক’। লজ্জার রং ‘লাল’।

অষ্টম শ্রেণির গার্হস্থ্য বইয়ে এ বিষয়ে জ্ঞান বিতরণের জন্য একটা অধ্যায় ছিল। শ্রেণি শিক্ষক (নারী) যখন পড়াচ্ছেন ওই অধ্যায়, নিষিদ্ধ ছবির মতো গোগ্রাসে গিলছি, মিটমিট হাসছি, আর কান ঝাঁ ঝাঁ করছে। সকলের। একদম একশো’ ভাগ মেয়ের একই অবস্থা!

আরও শিখেছি, এ ক’টা দিন ধর্ম-কর্ম পালন থেকে লোকাচার নারীকে বিরতি দিয়েছে। অশুচি যে নারী তখন!

যেবার থেকে আমি ঋতুবতী, সেবার পঞ্জিকা দেখার সঙ্গে কাজ আরও বাড়লো। সেবার পুজো যে মাসে, সে মাসের ক’ তারিখে আমার ‘ট্যাঙ্ক ফুটা’ হতে পারে, তা দেখে নিতাম। বিরাট পরিশ্রমের কাজ। আটাশ দিন গুনে গুনে দাগ দেয়া।

এভাবে দু বছর বাঁচলাম। একবার তো কানের পাশ দিয়ে গেল। আর একদিন আগে হলেই দশমীতে ‘তর্পণ’ বিসর্জন দেখা হতো না।

বিধি বাম পরের বছর। সপ্তমীর আগের দিন মেঘ ঘনিয়ে এলো চোখে। এবার কি তবে পূজায় শিউলি ফুল গাঁথবো না দুর্গা মায়ের জন্য? ধূপের গন্ধ! সন্ধি পূজায় একশো আটটা নীলপদ্ম ফোঁটানো? হবে না? হবে না কিছু?

আর মাকে যখন জিজ্ঞেস করবে সকলে, আমি কেন মন্দিরে গেলাম না- মা ফিসফিসিয়ে বলবে, আমার লজ্জার কথা?

সারা সন্ধ্যে ভাবলাম। বিদ্রোহী মন আমার দিশা হারিয়েছে। কেন অশুচি, কীসে অশুচি! এটা না হলে পৃথিবীতে এতো মানুষ হতো? হতো না। তবে কেন পবিত্রতম কাজে আমি ‘অপবিত্র’!

হঠাৎ মনে এলো, আচ্ছা দুর্গা মায়েরও তো চার সন্তান। আই মিন, দুর্গা মা ঋতুবতী।

লোকজনকে জিজ্ঞেস করলাম, কখনো কি এমন হয়েছে যে দুর্গাপূজা হয়নি! মা আসেননি বাপের বাড়ি? কেউ এমন বছর মনে করতে পারলো না। এমন উদাহরণ নাকি নেই। মা প্রত্যেকবারই আসেন সদলবলে।

তবে কি তিনি ‘হলেও’ আসেন, ‘না হলেও’ আসেন? নইলে যে তার সমস্ত ভক্ত-কূল কেঁদে ভাসাবে। ভক্ত-কূলকে আনন্দ দিতে মা নিশ্চয়ই এদিনেও আসেন। অশুচির দোহাই ফেলে।

আমিও লুকালাম ব্যাপারটা সবার কাছ থেকে। প্রথম ‘সংস্কার’ ভাঙার সাহসটা কীরকম, তা এই মুহূর্তে বোঝাতে পারবো না। তবে সেইবার সপ্তমীর দিন পূজামণ্ডপে কারো দিকে তাকাতে পারছিলাম না। ঢাক বাজছে ‘ঢাক ডুমা ডুম ট্যাঙর ট্যাঙ’। আমি শুনছি ‘হলো কীরে সর্বনাশ, সর্বনাশ’!

অঞ্জলি শেষে প্রণাম করে বললাম, মা দোষ নিও না। তুমিও মেয়ে, আমিও। তুমি জানো তোমার কাছে আসার জন্য মন কেমন ব্যাকুল! দিন যাই হোক, কেমন করে না এসে পারি বলো?

সেই থেকে আজ অবধি কখনো দুর্গাপুজোয় অনুপস্থিত থাকিনি।

পুজোর সঙ্গে কত শত স্মৃতি। সেসব স্মরণ করতে, মিলিয়ে নিতে, সকলের সঙ্গে আনন্দ করতেই তো যাই।

আর এ ভারী অন্যায়। বলুন তো এ কেমন যুক্তি! নারীর শরীরে যে সিস্টেমের কারণে মানুষের সৃষ্টি, সে কারণে নারী অশুচি। নারী ‘ব্যান’ খায় মাসে মাসে! এ কি আচার, না অনাচার? এ কি নারীর দোষ হিসেবে খাটে কোনো যুক্তিতেই?

ঋতুর সঙ্গে বিরোধ কেন- ধর্মের? লোকাচারের? সংস্কারের? পুরুষের তো এমন নেই!

তাই বাল্য-মন বিদ্রোহ করেছিলো প্রচলিত সংস্কারকে। এখন এর কি গতি বলুন! শূলে চড়ানো চলবে? নাকি ‘সেনোরা’, ‘মোনালিসা’ ব্যবহার করে যে মেয়েরা প্রতিদিন পাহাড় ডিঙোয়, তারাই এই ধর্মের সংস্কারটা ভাঙবে?

শেয়ার করুন: