বিবস্ত্র মানবতা আর ১৭ কোটির বঙ্গমাতা

ফাহমিদা জেবীন:

আজ ছিল আমার জন্মদিন। বন্ধু-শুভাকাঙ্খিরা এফবিতে, মেসেঞ্জারে উইশ করবে তার রিপ্লাই দেবার আশায় তাই অনেকটা সময় ধরে ফেসবুকে জুড়ে ছিলাম। এর মধ্যে কোনকিছু বুঝে উঠার আগেই একজনের শেয়ার করা অমন নারকীয়, পিশাচীয়, বর্বর ভিডিও দৃশ্যপটে আটকে যাবে ভাবতে পারছি না এখনও।

যৌন হয়রানি, ধর্ষণ, খুন ইত্যাদি নিউজগুলো আমি সাধারণত এড়িয়ে যাই। কারণ আমার মন-মস্তিষ্ক এই চাপ নেবার ক্ষমতায় অক্ষম। প্রথমে কোনো সিনেমার দৃশ্য ভেবে মনে মনে পরিচালককে গালি দিচ্ছিলাম। আজকাল এতো লোমহর্ষক দৃশ্যও দেখায় সিনেমাতে? তক্ষুণি চোখ পড়লো ক্যাপশনে। আনমনে বলে উঠলাম ’রক্ষা করো হে মাবুদ’! না, আর নিজ চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। যেখানে বর্বরতার সব সীমা লংঘিত এই ঘটনার সাক্ষী হয়ে মুখ থুবড়ে আছে নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ। এও কি সম্ভব? আব্বা/বাবা, ভাই ডেকেও শেষ রক্ষা পেলো না মেয়েটি। ভয়ানকভাবে অপ্রস্তুত আর মাথা হেট আমার, ঠিক ঐ মুহূর্তে ঘুমাতে যাবার প্রস্তুতি নিয়ে আব্বা মেসেঞ্জারে লিখছেন “Amma, May I go to bed”?

‘বাবা’ কত আস্থা, শক্তি আর আশ্রয়ের জায়গা এটা। অনেক চড়াই-উৎরাই, ভাল-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়ের পথ পেরিয়ে জীবনের মাঝবয়সে এসেও আমার সর্ব গোপনীয়তা জমা রাখার ভাণ্ডার, আশ্রয়-প্রশ্রয় আর শক্তির অন্যতম প্রধান মাধ্যম আমার বাবা। মা ধরাধামে বর্তমান থাকার পরও আমার ন্যায় প্রতিটি মেয়েরই আস্থার জায়গা হচ্ছে ‘বাবা’। আহা রে, এ বাবা ডাকেও মানবতা জেগে উঠেনি তাদের। নিরীহ কুকুর নিধনে নামে প্রশাসন আর দু’পেয়ে জানোয়ারদের থেকে রেহাই পেতে আমরা বাবা ডাকি তাদের!

বহু বছর আগে “ফুলনদেবী” একটি নামে ভারতীয় বাংলা মুভি দেখেছিলাম। যেখানে এক অসহায়, অবলা নারী হয়ে উঠেছিলেন ফুলনদেবী। বোধ করছি আমরা আজ সেই সময়ে দাঁড়িয়ে যেখানে অসংখ্য ফুলনদেবীর জন্ম দিবে বাংলাদেশ। চোখের সামনে ধর্ষিতার রক্তে ভেজা স্বাধীন বাংলার পতাকা, আইয়ুব শাসনকে হার মানানোর বর্বরতা। জাতির জনকের সোনার বাংলায় আর কত নারীর বস্ত্র হরণের তাণ্ডব চললে ক্ষান্ত হবে এ জাতি? এদেশের প্রতিটি ঘরের দরজায় কড়া নেড়ে এক একটি মেয়ে/নারীকে ধরে ধরে যদি প্রশ্ন করি- কার শরীর-মন অক্ষত? কয়জন তাৎক্ষণিক, নির্দ্বিদায়, নিঃসংকোচে পজিটিভ উত্তর দিতে পারবে? জানতে চাই আর কত এবং কিভাবে প্রতিবাদ জানালে এই বস্ত্রহরণের মহামারী থামবে?

মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র মতে, গত নয় মাসে ধর্ষিত ৯৭৫, গণধর্ষিত ২০৮, ধর্ষণ পরবর্তী হত্যা ৪৩, যৌন হয়রানির শিকার ১৬১ এবং হয়রানির শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছে ১২ জন নারী।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলীয় নেত্রী, স্পিকার, শিক্ষামন্ত্রী, নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রী, নারী সচিবগণ আপনাদের বলছি, আমরা কি তবে গণআত্মহত্যা করবো? হে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি কি দেখতে পাচ্ছেন জাতির পিতার সোনার বাংলায় আজ শত-শত দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের তাণ্ডব? যা কুরুক্ষেত্রের চেয়েও ভয়ানক পরিণতির ইঙ্গিত করছে বৈকি! পৌরণিক মহাভারতে বর্ণিত মহারাণী গান্ধারী চোখে কালো পট্টী বেঁধে স্বেচ্ছায় অন্ধ হয়েছিলেন। তাই হয়তো দুঃশাসন আর দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের পরও কৌরবদের ত্যাগ করেননি তিনি। যা পরিণতি হিসেবে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের মধ্যদিয়ে সম্রাট ধৃতরাষ্ট্রের জন্য বয়ে এনেছিল একশত কৌরব হারানোর গগণবিদারী আহাজারী। অথচ, তথাসময়ে তাদের প্রতিহত করলে এ নিদারুণ শোক নিশ্চিত সইতে হতো না।

একটা সময় ছিল, অবিবাহিত মেয়ে বন্ধুদের সাথে শহরের বাইরে কিংবা সন্ধ্যার পর বেড়াতে যেতে চাইলে মা তাকে “বিয়ের পর যখন যেখানে ইচ্ছা স্বামীর সাথে যাস”-এই বলে চুপ করিয়ে দিতেন। অবশেষে সিলেটের এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে এ বাক্যটিও যোগ্যতা হারালো। এবার মা-বাবাকে মেয়ের বর হিসেবে একজন স্বাভাবিক, শিক্ষিত, ভদ্র ছেলে নয় বরং (ঠিক সিনেমায় যেমনটি দেখা যায়) এমন পুরুষ বাছাই করতে হবে, যে কিনা একাই ৮/১০জন সর্বোপরি একটি ফৌজ/বাহিনীর সাথে লড়াই করে তাদের মেয়েকে অক্ষত রাখতে সক্ষম।

জানি, শ্রেণি হতে শ্রেণিভেদে নারী আরো ভালনারেবল হয়ে ওঠে। এর শেষ কোথায়? কীভাবে সমাধান? এও জানি সমাজ বদলে দেবার আমি কেউ না। বদলানো সম্ভবও না। কিন্তু আমার ভেতরের এসব ঝড় থেকে নিদ্রাহীন বাধ্য আমি তাই কী-বোর্ড আঁকড়ে ধরি। এই চাপ আর নিতে পারছি না। একটি ঘটনার পর এর চেয়ে ভয়ানক আরেকটি ঘটনার অপেক্ষায় রোজ নিজেকে রক্তাক্ত আর ক্ষত-বিক্ষত অনুভব করি। নারী অধিকার, স্বাধীনতা, নারী শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন এতো ভারী ভারী শব্দগুলো নিয়ে কী-বোর্ডের উপর এতো যে ঝড় বয়ে যায় তারপরও বাংলাদেশ তোমার পতাকা ধর্ষিতার রক্তে ভেজা আর মানচিত্র আজ বিবস্ত্র।

রোজই নীলারা ভাইয়ের কোলে লাশ হয়ে ফিরে, স্বামীর সামনে ধর্ষণের শিকার হয় প্রিয়তমা স্ত্রী, বাবা-মায়ের সামনে আদরের ফুলকুমারী। মাঠে, পথে, অফিসে, কলেজে বন্ধ জানালা কিংবা খোলা আকাশের নিচে রোজ লাঞ্ছিত হয় তোমার কন্যা-জায়া-জননী। তবুও সোনার কাঠি-রূপার কাঠি শিয়রে তুমি ঘুমিয়ে থাকো বাংলাদেশ। এভাবে আর কতদিন ঘুমাবে’, বলো না? আর কতদিন, কতকাল, আরো কতকাল?

ফাহমিদা জেবীন
৬ অক্টোবর ২০২০ইং

শেয়ার করুন: