তাছলিমা আক্তার:
আমি একজন মা, এক পুত্র সন্তান এবং এক কন্যা সন্তানের। উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবেই পুত্রকে আগে নিয়ে এসেছি। নোয়াখালীর এখলাসপুরে ঘটে যাওয়া ঘটনা আমাকে যেমন ঘুমোতে দেয়নি আমার কন্যার নিরাপত্তার কথা ভেবে, তার থেকে বেশি জাগ্রত রেখেছে আমাকে আমার পুত্রের মনস্তাত্বিক গঠনের ভাবনায়। একজন মানুষ হিসেবে কতটা মূল্যবোধ আমি তাকে দিতে পেরেছি! নাকি পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নীরব প্রতিনিধিত্ব তার মাঝে অবস্থান করছে। মনে হচ্ছিলো কতজন মা আমার মতো দুশ্চিন্তায় বিনিদ্র রাত কাটাচ্ছেন? শুরুটা এখান থেকেই করি।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য মতে, বাংলাদেশে জানুয়ারি থেকে আগস্ট ২০২০ এই সময়কালে ৮৮৯ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ধর্ষণের চেষ্টা হয়েছে ১৪১টি, ৪১ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে, ৯ জন ধর্ষণের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছেন। গত বছরের মহিলা পরিষদের এক তথ্য অনুযায়ী জানুয়ারী থেকে নভেম্বর সময়কালে ৮৯৫ টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। জানুয়ারী থেকে জুন পর্যন্ত ছয় মাসে সংখ্যাটি ছিল ৩৮৭ এবং জুলাই থেকে নভেম্বর পাচঁ মাসে সংখ্যা দাঁড়িয়েছিলো ৫০৮ এ। গত বছর থেকে এ বছরের আগস্ট পর্যন্ত চিত্রটি যদি খুব ভালো করে লক্ষ্য করি ক্রমান্বয়ে সংখ্যা দ্বিগুণ অনুপাতে বাড়ছে।
চাঞ্চল্যকর প্রতিটি ঘটনার প্রতিবাদে বিক্ষোভ, মানববন্ধন, স্মারকলিপি প্রদান গতানুগতিক ধারায় প্রতিবাদ চলছে। খুব উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবেই গতানুগতিক শব্দটি আমি ব্যবহার করেছি। পরিবর্তনে এসেছে আনুপাতিকহারে দ্বিগুণের দিকে যাত্রা। কালরাতে অনলাইনের পাতায় পাতায় বিক্ষোভের সংবাদগুলো দেখছিলাম, আর ভাবছিলাম এই বিক্ষোভ একজন ধর্ষকের মূলবোধকে কতটা পৌঁছতে পারছে! উত্তরটা সকালে ঘুম থেকে জেগেই পেয়ে গেলাম ‘লক্ষীপুরে দরজা ভেঙ্গে ঘরে ঢুকে বিধবাকে ধর্ষণ’।
উপরোল্লেখিত তথ্যগুলো বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম থেকে সংগৃহীত। এক তথ্য মতে মাত্র ২ শতাংশ ঘটনা বিভিন্ন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে আসে সেবার জন্য আসে এবং এই সংখ্যাটিই রিপোর্টেড সংখ্যা হিসেবে আমরা বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে পাই। বেগমগঞ্জ এখলাসপুরের ঘটনাটি প্রকাশ পেয়েছে ঘটনার ৩২ দিন পরে। এটি ভাইরাল করেছিলেন কোন এক সাংবাদিক তার কোন সোর্স-এর কাছ থেকে ভিডিওটি পেয়ে। কাজের সূত্রে পরিচিত নোয়াখালীর কিছু সহকর্মীর সাথে কথা সূত্রে জানতে পারি, এমন অসংখ্য ঘটনা এই অঞ্চলে ঘটে যা প্রকাশের সাহস বা শক্তি কোনটাই সহিংসতার শিকার হওয়া পরিবারটির নেই।
গত বছরের ডিসেম্বরে নোয়াখালীর সুবর্ণচরে নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে আয়োজিত এক প্রজন্ম সংলাপে তাৎক্ষণিক এক স্টাডিতে ৯৮ জন কলেজ পড়ুয়া তরুণীকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো ঐদিন কলেজে আসতে পথে সে কোন ধরনের যৌন হয়রানির শিকার হয়েছিলেন কিনা! ৯৭ জনের উত্তরে হ্যাঁ শব্দটি পেয়েছিলাম আমরা। একজন কোন কথাই বলেননি।
আপনাদের সাথে আমার ক্ষুদ্র কর্মজীবনের ক্ষুদ্র এক অভিজ্ঞতা শেয়ার করি। ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত আসনের নারী সদস্যদের আত্মবিশ্বাসী এবং দৃঢ়প্রত্যয়ীকরণে কিছু প্রশিক্ষণে প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা হয়েছিল আমার। এখানে ইউনিয়ন পরিষদ সদস্যদের বাইরেও স্থানীয় নারী নেত্রী, শিক্ষক বিভিন্ন পেশার নারীরা অংশগ্রহণ করতেন। একটি সেশন ছিল যেখানে হরি প্রসাদ চৌরাশিয়ার বাশিঁর সুরে বিশেষ মেডিটেশনের মাধ্যমে তাকে শৈশবে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হতো এবং সেখান থেকে এমন একটি ঘটনা তুলে আনতে বলা হতো, যা ছিলো তার জন্য বেদনাদায়ক, কোনদিন কাউকে বলা হয়নি এবং সে মনে করেন যে এই ঘটনা তার আত্মবিশ্বাসকে থমকে দিয়েছে। সম্পূর্ণ সততা এবং বিশ্বস্ততার সাথে বলতে চাই ৯৯ শতাংশ নারী মন খুলে বলেছেন এবং ৯৯ শতাংশ ঘটনাই ছিল যৌন হয়রানির ঘটনা এবং এর মাঝে ২০ শতাংশ ধর্ষণের ঘটনা। কেউ কেউ মা’কে বলতে গিয়ে নিজেই পাল্টা সমালোচনার শিকার হয়েছেন। বাকিরা কোন দিনই কাউকে বলেননি। বাকি ১ শতাংশ কোন কিছু বলতে চাননি।
এবার আবার শুরুটায় চলে যাই। মা হিসেবে আমি কেন নিদ্রাহীন? ঘটনাগুলো ঘটেছে আমাদেরই কন্যা সন্তানদের সাথে, ঘটিয়েছে আমাদেরই পুত্র সন্তানেরা। খুব সচেতনভাবে আমি ‘আমাদের সন্তান’ কথাটা লিখেছি। মানব শিশু পৃথিবীতে আসে একেবারেই নিষ্পাপ, নিষ্কলুষ হয়ে। পরিবার, সমাজ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমনকি রাষ্ট্র ক্রমান্বয়ে এসকল প্রতিষ্ঠানের মধ্য দিয়ে মানুষ বেড়ে ওঠে। যাকে আমারা বলি সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া। এর মধ্য দিয়ে কেউ মানুষে পরিণত হয়, কেউ পরিণত হয় ধর্ষকে। একজন ধর্ষক তৈরিতে ব্যক্তি ধর্ষকের থেকে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা বেশি, যেখানে পরিবার প্রথম প্রতিষ্ঠান।
বাবা কিংবা মা হিসেবে আমাদের সন্তানদের মানসিক বিকাশে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে কতটুকু সক্ষমতা আছে আমাদের? নিজেদের মনস্তত্ব কোন সামাজিকীকরণের আদলে গড়া? সন্তানকে ইতি এবং নেতিবাচক এই শব্দ দুটোর সাথে পরিচিত করিয়েছি কোন আদলে? মানব মর্যাদা শব্দটি কি আদৌ তার অভিধানে সংযুক্ত? এমন অসংখ্য প্রশ্নের বেড়াজালে আমি আজ বিনিদ্র। আমার পুত্র সন্তানটি কি পারবে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষকে মানুষ হিসেবে মর্যাদা দিতে? প্রকৃত একজন মানুষ হতে? এর শুরুটা কি প্রতিটি ঘরে আদৌও সম্ভব?
লেখক পরিচিতি:
মানবাধিকার কর্মী এবং ডেপুটি ম্যানেজার- উইমেন রাইটস এন্ড জেন্ডার ইক্যুইটি, এ্যাকশনএইড বাংলাদেশ