বিশ্বের সবচেয়ে বেশি চুমু পেয়েছিল সেইন নদীর মেয়েটি

শাহরিয়া দিনা:

The most kissed face on Earth যে মেয়েটিকে বলা হয়, তার নাম কেউ জানে না। অদ্ভুত না! তাকে ‘সেইন নদীর মেয়ে’ নামে ডাকা হয়। ১৮৭০ থেকে ১৮৮০ কোন এক সময় ফ্রান্সের সেইন নদীতে ভেসে এসেছিল একটি মেয়ের লাশ। লাশটি হাসপাতালে নেবার পর দেখা যায়, তার শরীরে কোন আঘাতের চিহ্ন নেই, নেই কোন ক্ষত কিংবা বেদনার ছাপ। বরং অদ্ভুত রকম এক চিলতে হাসি লেগে রয়েছে তার ঠোঁটে। হাসিমুখে যেন ঘুমের ভান করে আছে সে। মেয়েটির বয়স ছিল মাত্র ষোলো।

সেইন নদী থেকে ডুবে যাওয়া মৃতদেহগুলি বের করার জন্য দায়িত্বরত প্যারিস নদী পুলিশ ব্রিগেড ফ্লুভিয়েলের চিফ ব্রিগেডিয়ার প্যাসেল জ্যাকুইন বলেছেন, “এমন একটা শান্তিপূর্ণ মুখ দেখে অবাক হয়েছি।” পেশাগত কারণেই প্যাসেল জ্যাকুইন প্যারিসের অন্য কোনও ব্যক্তির চেয়ে বেশি ডুবে যাওয়া মৃতদেহ দেখেছেন। তিনি বলেন, “দুর্ঘটনায় পানিতে ডুবে মারা যাওয়া এবং আত্মহত্যার উদ্দেশ্যে ডুবে যায় যারা, তাদের কখনই এতো শান্ত লাগে না। তাদের শরীর ফুলে বিকৃত হয়ে যায় স্বাভাবিক মৃতদেহের মতো দেখায় না। এমনকি আত্মহত্যাকারী ব্যাক্তিটিও জীবনের শেষ মুহূর্তে লড়াই করে। ক্ষত, বেদনা, ভয় এবং সন্দেহের এই চূড়ান্ত মুহূর্তগুলি প্রায়শই তাদের মুখে জমাট বাঁধে। অন্যদিকে এই মেয়েটি, তার নির্মল মুখের সাথে, আরও বেশি ঘুমন্ত এবং অদ্ভুত সুন্দর হাসিতে মনে হচ্ছে তিনি তার মি. চার্মিংয়ের সম্পর্কে স্বপ্ন দেখছেন”।

ধারণা করা হলো, মেয়েটি আত্মহত্যা করেছে। তার ছবি ছাপা হলো। লাশকাটা ঘরের কাচের জানালার সামনে রাখা হলো লাশ, যদি কেউ দেখে সনাক্ত করে সেই আশায়। কিন্তু সেই আসেনি, কেউ দাবি করেনি তার স্বজন। জানা যায়নি; কী ছিল তার দুঃখ, কতোটা ছিল তার অভিমান! কেনইবা মৃত্যুর যন্ত্রণাদায়ক ব্যাপারেও প্রশান্তির হাসির রেখা ফুটে উঠেছিল তার ঠোঁটের কোনায়!

মর্গের ডাক্তার পর্যন্ত বিস্মিত হয়ে গেল মেয়েটি সেই হাসিমাখা মুখ দেখে। রাতের আঁধারে সেই ডাক্তার চুপিচুপি এলেন মেয়েটির লাশের সামনে। প্লাস্টার অফ প্যারিস দিয়ে লাশটির মুখের ডেথমাস্ক বা মৃত্যুমুখোশ বানাবে বলে। কিন্তু ডেথমাস্ক বানাতে হলে সরকারি অনুমোদন লাগে, মৃতের স্বজনের অনুমতি লাগে। যে মেয়ের নাম পরিচয় কেউ জানে না, সেখানে অনুমতি মিলবে কার কাছ থেকে! তাই ডাক্তারের লুকিয়ে আসা। কিন্তু বিধি বাম, তিনি ধরা পরে গেলেন অন্য সহকর্মীদের হাতে। ফলাফল তার জেল হলো। এ ঘটনা জানাজানি হতে হতে নামহীন মেয়েটা বিখ্যাত হয়ে গেল। অজস্র নিউজ হলো তাকে নিয়ে, রচিত হলো গান, কবিতা, গল্প, উপন্যাস। মোনালিসার হাসির মতোই ভুবন বিখ্যাত হলো তার হাসি। তুলনাও চললো মোনালিসার হাসির সাথে সেইন নদীর মেয়েটির হাসির রহস্যময়তার! শুধু মোনালিসাই নয়, আরও অজস্র সুন্দরী নারীর হাসির সাথে তুলনা করা হয় ১৬ বছরের কিশোরী মেয়েটিকে।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, সারা পৃথিবীতে এনাটমি ক্লাসের জন্য যে কৃত্রিম ডামি বানানো হয় সেই ডামির মুখ বানানো হয় এই মেয়েটির মুখের আদলে। পানিতে পড়া রোগীর চিকিৎসায় যে শ্বাস প্রশ্বাস চালু করার ট্রেনিং, তা’ও দেয়া হয় এই ডামি দিয়েই। অনেকেই মজা করে বলে- পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি চুমু পড়েছে নিঃসন্দেহে সেইন নদীতে একদিন ভেসে আসা এই মেয়েটির ঠোঁটে।

গুগল সার্চ দিয়ে এই মেয়েটির ছবির দিকে মাঝে মাঝে তাকিয়ে থাকি। সে কত বিখ্যাত অথচ নিজেই জানলো না! এমন বিখ্যাত হবার চাইতে অখ্যাত কেউ হয়ে বেঁচে থাকাও মন্দ না। জীবনে খ্যাতি, সুনাম, যশ, অর্থ-প্রতিপত্তি হয়তো সফলতার বাহ্যিক মাপকাঠি। আত্মিক শান্তি পরিমাপের কোনো স্কেল নেই। সবকিছু থাকার পরও যেমন কারো নিঃস্ব লাগতে পারে, তেমনি কিছু না থাকার পরেও কেউ স্বস্তিতে থাকে। জীবন তো একটাই, একবারই আসে। যতটা পারা যায় বেঁচে থাকাকে উদযাপন করতে হয়। মরে গেলে এই পৃথিবীর কোথাও কিছুই থেমে থাকে না। সময়ের ধুলোতে ঝাপসা হওয়া স্মৃতিতে কেউ মনেও রাখে না। সবই চলে স্বাভাবিক নিয়মে।

প্রাণহীন ঠোঁটে অতটা চুমু’র চাইতে প্রাণবন্ত একটা জীবন অনেক সুন্দর। নদীতে ঝাঁপ দিয়ে মরে যাওয়ার চাইতে বেঁচে থাকাটা কৃতিত্বের, হোক না সেটা স্রোতের বিপরীতে লড়াই করে…।

শেয়ার করুন: