মগের মুল্লুকের নাম ‘আজকের বাংলাদেশ’

সুমু হক:

“দালালেরা যখন মেয়েদেরকে পাচারের পর যৌনকর্মে বাধ্য করে, ধর্ষণের পর ধর্ষণে তাকে বিপর্যস্ত রাখে, দিনের ২৪ ঘন্টায় তাকে অজস্র খদ্দেরের মনোরঞ্জনে বাধ্য করে, তখনও তারা এই খেয়ালটুকু রাখে যে তাদের ব্যবসার প্রয়োজনেই সেই মেয়েটির শরীরের বাইরের অংশে যেন কোন আঘাতের চিহ্ন না থাকে এবং সে যেন এতোটা সুস্থ থাকে যে, যতটা সম্ভব বেশি সময় সে সেই ব্যবসাটা চালিয়ে যেতে পারে। গত কয়েক দশক ধরে যে সরকার এবং তার ক্ষমতার বলয়ে থাকা ক্ষমতাধরেরা আমাদের দেশটাকে ধর্ষণ করে চলেছে তো বটেই, এবং একজন দালাল তার আওতায় থাকা যৌনকর্মীর সাথে যে ন্যূনতম যে সাবধানতাটুকু দেখায়, সেইটুকুও তারা আর দেশটির প্রতি না দেখিয়ে দেশটাকে ছিবড়ে করে রেখে দিচ্ছে।”

কথাগুলো আমার নয়, প্রচণ্ড ক্ষোভ, অভিমান আর ক্রোধ থেকে উঠে আসা দেশকে ভালোবাসা আমার একজন বন্ধুর।
এবং আজকের বাংলাদেশে এই কথাগুলোই নির্মম সত্যি।

মনে করে দেখুন তো, সাধারণ নাগরিকদের প্রতিবাদ, তাদের আন্দোলন ছাড়া, শেষ কবে দেশটিতে কোন ধর্ষণ, খুন, কিংবা অপহরণের পর প্রশাসন আইনগত ব্যবস্থা নিয়েছে?
বিচারের কথা আর তুললাম না, কারণ সেটা আর প্রহসন ছাড়া কিছু নয়!
যে দেশে সরকার, প্রশাসন এবং আইন শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী থাকতেও প্রতিটি অপরাধের বিচারে জনতাকে মাঠে নামতে হয়, সে রাষ্ট্রে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে এতো সব মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী পোষার কোন কারণ আছে বলে কি মনে হয় আপনাদের?

আর সরকার আর নির্বাচনের কথা নাই বা বললাম।
এতো সব খরচের ঝামেলায় না গিয়ে দেশটাকে বরং পুরোনো রাজ্যপ্রথায় নিয়ে গেলেই ল্যাঠা চুকে যায় যেখানে বংশানুক্রমে আমৃত্যু রাজার কন্যা এবং তস্যপুত্র রাজ্যশাসন করে যাবেন। এমনিতেও যখন দেশটা সেভাবেই চলছে তখন আর গণতন্ত্র, নির্বাচন এসব প্রহসনের নাম অনর্থক অর্থক্ষয় এবং প্রতি পাঁচ বছর অন্তর নিয়ম করে জনগণের আবেগের সাথে ফাজলামো করে চলা নিতান্তই অর্থহীন।

ভাবছেন নারীবাদ ছেড়ে আমি আবার এইসব নিয়ে পড়লাম কেন?
পড়লাম, তার কারণ নারীবাদ মানুষের মুক্তির কথা বলে।
আর আজকের বাংলাদেশ যে জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে সেখানে রাষ্ট্র, আইনশৃঙ্খলা এবং বিচার বিভাগের এইসব প্রহসন নিয়ে কথা বলা, প্রতিবাদ করা নিতান্তই জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বেআইনিভাবে জনগণের অনুমোদন ছাড়া নির্বাচন হাইজ্যাক করে ক্ষমতায় আসা একটি সরকার আর তার ক্ষমতার বলয়ে থাকা কিছু মানুষ দিনের পর দিন দুর্নীতি, খুন, ধর্ষণ যা ইচ্ছে তাই করে যাবে, আর এর কোন বিচার হবে না, উল্টো বিচার চাইতে গেলে আপনাকেই ৫৭ ধারায় অর্থাৎ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করে হয়রান করা হবে! এ কোন মগের মুল্লুকে পরিণত হয়েছে দেশটা?
আপনি একটি খুনের বিচার চাইবেন? খুনের তদন্তের পরিবর্তে চলবে আপনার চরিত্র নিয়ে গবেষণা।
আপনার ব্যক্তিগত জীবনকে মিডিয়ার সামনে এনে গ্যাসলাইটিং করা হবে।
নামে বেনামে এমনকি সরকারি কর্মকর্তারাও তাদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রোফাইল থেকে আপনার ব্যক্তিগত ছবি ব্যবহার করে অশ্লীল পোস্ট দিয়ে যাবে। আপনি কিচ্ছু করতে পারবেন না, তার কারণ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন শুধু প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর প্রিয় মানুষদের অনুভূতির হাত ধরে চলে। আপনার আমার নয়!

আপনি একজন নারী হয়ে কোন বিপদে পড়বেন, ধর্ষণের শিকার হতে যাচ্ছেন, দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সম্মুখীন হতে যাচ্ছেন, তাহলে আগেই ভেবে নিন, আপনার লাইফস্টাইল আপনাকে আমাদের আল্ট্রা সালাফিস্ট পিতৃতান্ত্রিক সমাজের অনুযায়ী আদৌ কোন বিচার পাবার যোগ্য বলে বিবেচনা করবে কিনা?
আপনি কি একজন স্বাধীনচেতা আধুনিক নারী?
আপনি কি কোন ক্রিয়েটিভ পেশায় কাজ করেন, যেখানে আপনাকে দিনরাতের যে কোন সময় একলা চলাফেরা করতে হয়?
আপনার কি অনেক পুরুষ বন্ধু আছে? কিংবা আপনি কি পুরুষদের সাথে মানুষের মতো সমান মর্যাদার অর্থাৎ সপ্রতিভ আচরণ করেন?
আপনি কি আধুনিক পোশাক-আশাক পরেন? মেক আপ ব্যবহার করেন?
আপনি কি সিগারেট কিংবা মদ খান?
আপনি কি অমুসলিম?

উপরের প্রশ্নগুলোর একটির উত্তরও যদি ‘হ্যাঁ’ হয় তাহলে এবার আপনি দূরে গিয়ে ধর্ষণের শিকার হয়ে মরতেই পারেন।
কারণ এই সমাজ সুস্থ এবং জীবিত অবস্থাতেই আপনাকে মানুষের সম্মান দেয় না, এরপর আরও দেবে না।

তবে হ্যাঁ, কোন খুন কিংবা দুর্ঘটনার পেছনের আসল সত্য কিংবা রাজনৈতিক কানেকশন থেকে জনগণের দৃষ্টি সরাতে আর অনলাইনের পত্রিকার হিট বাড়াতে আপনার গুরুত্ব অপরিসীম!
তার বেশি কিছু আপনি কিন্তু আপনি ভুলেও আশা করবেন না!
কারণ আপনি একটি নারীদেহ মাত্র, মানুষ নন, আর যে মগের মুল্লুকে আপনি জন্মেছেন তার নাম ‘বাংলাদেশ’।

#JusticeForShipra

#JusticeForSinha

#JusticeForSifat

শেয়ার করুন: