মহুয়া ভট্টাচার্য:
গত বছর বা তারও কিছু আগে থানায় গিয়েছিলাম জিডি করতে। আমার সেই সময়কার প্রেমিক খুব উৎসাহ নিয়ে এলেন, তিনি চট্টগ্রামের নামকরা মানুষ। তাঁকে সবাই চেনে জানে। তিনি একপায়ে খাড়া হয়ে জিডি করতে চলে এলেন আমার সাথে। থানার বড়কর্তা তাঁকে খুব ভালো জানেন। সেই সুবাদে তাঁর খাস কামরায় চা নাস্তা খেতে খেতে, এসির ঠান্ডাতে বসে আমি জিডির উদ্দেশ্য বয়ান করতে আরম্ভ করলাম।
আমি আমার সাথে ঘটে যাওয়া সমস্ত বিষয়ের বয়ান করছিলাম। বলছিলাম আমার কোন কোন সমস্যার পরিপ্রেক্ষিতে শারীরিক ও মানসিক নিরাপত্তাহীনতার দরুন আমি বাধ্য হয়ে জিডি করতে এসেছি। থানার বড়কর্তা নানা প্রশ্নবাণে আমাকে জর্জরিত করে চলেছেন সমানে। যদিও আমি স্রেফ একটি সাধারণ ডায়রী করতে গিয়েছিলাম এবং মামলা তো নয়ই। অথচ, ওসি সাহেব যেন কিছুতেই আমার দর্শানো কারণগুলোতে সন্তুষ্ট হতে পারছিলেন না, এদিকে আমার সঙ্গে আসা ভদ্রলোকও তাঁর চেনাজানা। এমন সময় ঘটে গেলো সেই দৈবঘটনা!
আমার সেই সময়কার প্রেমিক ভদ্রলোক বয়সে আমার বেশি এবং সমাজের মান্যগণ্যদের কাতারের প্রথম সারির দিকের মানুষ হওয়া স্বত্তেও আমি তাঁকে ” তুমি ” সম্বোধনই করতাম। অবশ্যই সেই সম্বোধনের অনুমতি আমার ছিলো, এবং এই সম্বোধনের মধুরতা আমরা দুজনেই উপভোগ করতাম। তো এই আত্মিক শান্তি কখনো লুকিয়ে চুরিয়ে উদযাপন করার পক্ষপাতী আমি ছিলাম না। আমি এই গোটা বিশ্বসংসারের ভরা বাজারেই তাঁকে তুমি সম্বোধন করতাম। থানার বড় কর্তার সামনেও তাঁকে কি এক কথার ফাঁকে ” তুমি ” ” তুমি ” বলা চালিয়ে যাচ্ছি, বড়কর্তার তা কান এড়ালো না। তিনি যে খপ্ করে পয়েন্টটা নোট করে ফেললেন তা আমি বুঝতে পারি আরো খানিকক্ষণ বাদে।
আমার সাথে যিনি ছিলেন, তাঁর সামনে তো আমাকে যথাযথ জেরা করেও মনে হয় যেন তৃপ্তি পাচ্ছিলেন না। এদিকে আমি মানুষটা শরীরে আঘাত নিয়ে, কপর্দকশূন্য অবস্থায় একদিন, একরাত চন্দনাইশ কি তারও পরের কোনো এক গ্রামে চলে গিয়েছিলাম স্বামীর মারের হাত থেকে বাঁচার জন্য। ফিরে এসে একটা স্রেফ সাধারণ ডায়রী করবো তাতেই আমি কাঠগড়ায়! একপর্যায়ে থানার বড়কর্তা বললেন আমাকে তিনি কিছু ব্যক্তিগত প্রশ্ন করতে চান, যথারীতি আমার সাথে আসা পাবলিক ফিগার ভদ্রলোক বাইরে চলে গেলেন। এবার থানার কর্তা মহোদয় প্রথমেই আমাকে তার পড়াশোনা, ডিগ্রি, কখন কোন ঘাগু অপরাধীকে ধরতে কি সুচতুর কৌশল অবলম্বন করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন সেসবের একটা ফিরিস্তি দিয়ে দিলেন, অবশ্যই তা খুব মার্জিত বয়ানে। সবচেয়ে বড় কথা হোলো কর্তা মশাই প্রতি লাইনেই আমাকে সম্মান প্রদর্শনপূর্বক “দিদি” শব্দটি ব্যবহার করছিলেন সচেতনতার সাথে।
তো থানার বড়কর্তার যেনো কিছুতেই আমার নিজের সমস্যার বয়ান মনঃ পুত হচ্ছিলো না! তিনি যেনো আরো খানিকটা সিন্ধু সেঁচে মুক্তো আনার চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। অর্থাৎ হোলো গিয়ে, তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন ঘর থেকে বাইরে বের হওয়া যেকোনো নারীর সংসার ভেঙে যাওয়া কিংবা স্বামীর অত্যাচারের একটিই কারণ – তা হোলো মহিলার চারিত্রিক ত্রুটি। তিনি আমার কথার ফাঁক ফোকড় গলিয়ে যখন সে অন্তর্নিহিত গোপন তথ্য বের করে আনার দূরুহ চেষ্টা করছিলেন – আমি তখন তাকে আর বেশি ব্যোমকেশ বক্সী হওয়ার সুযোগ না দিয়েই বললাম – আমার পুরুষ বন্ধু আছে, যা আমার স্বামীর অপছন্দের মূল কারণ। তাছাড়া বিভিন্ন সংগঠনিক যোগাযোগও তাঁর রাগের মূল কারণ।

এবার থানার বড়কর্তা হালে পানি পেলেন। তিনি তখন যেসব কথা বলেছিলেন তার সারসংক্ষেপ হোলো, সংসারের সব দায়িত্ব বহাল রেখেই নারীকে বাইরের কাজে যেতে হয়, তাছাড়া অন্যকোনো পুরুষের সাথে “ঘনিষ্ঠতা” থাকা নারীকে তার স্বামীর “শাসন” করার অধিকার অবশ্যই আছে। তাঁর মতে আমাকে যেটা করতে হবে, সেটা হোলো – নিজেকে “সংশোধন” করতে হবে। তিনি বারবার বললেন, নিজে তিনি খুব উদার চিন্তার, তবে সমাজ তো নারীদের দোষই বেশি দেখবে! সবচেয়ে সুক্ষ্ম এবং তীক্ষ্ণ বিদ্রুপ করেছিলেন আমার সাথে আসা নামজাদা সাংবাদিককে সবার সামনে “তুমি” সম্বোধন করা নিয়ে। পৃথিবীতে কখনও এমন মধুরতম বিষয় নিয়ে কোন বিদ্রুপ করা যেতে পারে বলে আমার মনে আসেনি। তাঁর কক্ষ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় আমাকে তিনি যে উপদেশ দিয়েছিলেন তা আমার আজীবন মনে রইবে। তিনি বলেছিলেন – ” আজকের পর থেকে উনাকে আপনি কখনও, কারো সামনেই আর ‘তুমি’ সম্বোধন করবেন না।”
সেদিন তার কক্ষে বসেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, পারতপক্ষে কখনও আর আইনের দ্বারে বিচারের জন্য হাত পাতবো না।
শিপ্রা নাকি মেজর সিন্হাকে “আমার মানুষটা” বলাতে নিন্দার ঝড় উঠেছে! একজন মেজরকে সে কেন “তুমি” সম্বোধন করল, তাতে নাকি বিশাল অপরাধ হয়েছে তার! আমাদের চারপাশে এখন বড় বড় ক্রাইম ডিটেকটিভ জুটে গেছেন, যারা এই “আমার মানুষটা” শব্দদুটো থেকেই হত্যার অপ্রকাশিত সব ক্লু পেয়ে যাচ্ছেন! ওরে আমার শার্লক হোমস রে!!
জানি না অপরাধী কে? কার কী অভিসন্ধি ছিলো এই হত্যার পেছনে? কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে এই বিষয়টিই মুখ্য হয়ে উঠল কেন। আমাদের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে হীনচিন্তা আর চটুলতার ছড়াছড়িতে আমরা মূল জায়গায় ফোকাস করতে পারছি কম। নানা অপ্রাসঙ্গিক বিষয়কে দ্রবীভূত করে মূল ঘটনা থেকে মনযোগ নষ্ট করার জোর চেষ্টা চালানো হচ্ছে সাম্প্রতিক বিষয়গুলোতে। সাবরিনার ছবি নিয়ে আদি রসাত্মক পোস্টগুলোতো বেশিদিন আগের ঘটনা নয়। আমরা কি আর একটু শিক্ষিত, আর একটু উদার মানবিক বোধসম্পন্ন হতে পারি না? সম্পর্কের মধুরতম দিকগুলোর সাথে আমাদের পরিচিতি নাই থাকতে পারে, মতের ভিন্নতা থাকতেই পারে। কিন্তু নিজেরাই যা বুঝি সেটাকেই কেন যুক্তি প্রমাণের তোয়াক্কা না করেই ধ্রুবসত্য বলে রায় চড়িয়ে দিই!? এতো জাজমেন্টাল হওয়ার রাইট কোথায় পেয়েছেন আপনারা?