শাহেদ ইকবাল:
তিনি হতে পারতেন জনপ্রিয় সঙ্গীতশিল্পী। হতে পারতেন অভিনয় জগতের সেলিব্রিটি। হতে পারতেন প্রথিতযশা ডাক্তার কিংবা প্রকৌশলী। কিংবা অন্য কোনো বনেদী পেশার উচ্চপদস্থ নির্বাহী। নেহায়েত একজন আটপৌড়ে বাঙালি গৃহিণীও হতে পারতেন। কিন্তু সে সকল পথে তিনি হাঁটলেন না।
জার্মান ভাষার ডিপ্লোমাধারী এই তরুণী পূর্ব জার্মানির মেডিকেলের স্কলারশিপ ফিরিয়ে দিলেন। ইডেন কলেজে ভর্তি হলেন বিএসসিতে। কিন্তু মন তাঁর প্রজাপতির মতোই উড়ুউড়ু। কোথাও যেন থিতু হয় না। ক্ষ্যাপা যেন খুঁজে ফেরে পরশপাথর। রেডিও-টিভির নন্দিত এই শিল্পীর রক্তে শুধু বাজতে থাকে শিকল ভাঙার গান।
শুধু স্বভাব নয়, নামের মধ্যেও ছিল তাঁর ওড়াউড়ি। ডাকনাম ছিল তিতলী, যার অর্থ প্রজাপতি। ভালো নাম রোকসানা। সৈয়দা কানিজ ফাতেমা রোকসানা। প্রিয়জনদের কাছে ‘লিটল আপা’। জন্মেছিলেন ১৯৫৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি। সাধারণ বাঙালি মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে। কিন্তু এই মেয়ের রক্তে ছিল আকাশ জয়ের নেশা। ১৯৭৬ সালেই খুঁজে বের করলেন বাংলাদেশ ফ্লাইং ক্লাব। দু’বছরের প্রশিক্ষণে সেই ক্লাব থেকে পেলেন কমার্শিয়াল বিমান চালানোর লাইসেন্স। তারপর?
যে সময়ের কথা বলছি, তখন বাংলাদেশ বিমানের ককপিটে কোনো নারী বৈমানিক দর্শন তো দূরের কথা, কল্পনাও করা যেত না। কিন্তু এই তরুণী হাঁটছিলেন সময়ের আগে আগে। তাঁর সামনে দুটো পথ খোলা ছিলঃ এক. ইতিহাসের পুরাতন পথে হাঁটা এবং দুই. নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করা। তিনি দ্বিতীয়টাই বেছে নিয়েছিলেন। তাঁর অসামান্য প্রতিভা, দুর্দমনীয় ব্যক্তিত্ব ও মনোবল তাঁকে এ কাজে শক্তি জুগিয়েছিল।
১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ বিমান পাইলট নিয়োগের জন্য বিজ্ঞাপন দেয়। বৈমানিক রোকসানাও সেই বিজ্ঞাপনে সাড়া দিয়ে আবেদন করেন। কিন্তু নিয়োগ পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ বিমান তাঁর নিযুক্তি নিয়ে টালবাহানা শুরু করে। এক পর্যায়ে তাঁকে একটি গ্রাউন্ড জব অফার করে। রোকসানা সে অফার প্রত্যাখ্যান করেন। অবশেষে ২৫ মে ১৯৭৯ তারিখে বাংলাদেশ বিমান এই মর্মে সংশোধিত নিয়োগ-বিজ্ঞপ্তি দেয় যে, ‘কেবলমাত্র পুরুষেরা আবেদন করিতে পারিবেন।’
এই বিজ্ঞপ্তির প্রতিবাদে ক্যাপ্টেন রোকসানা ৩১ মে ১৯৭৯ তারিখে দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় ‘বাংলাদেশ বিমান বনাম মহিলা বৈমানিক’ শিরোনামে একটি চাঞ্চল্যকর চিঠি লেখেন। সেখানে তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় উল্লেখ করেন, ‘মহিলা হিসাবে আমি একবিন্দু সুবিধা চাই না বা কোটার সমর্থকও আমি নই, যদি আমি পুরুষের মধ্যে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করিতে পারি, তবে শুধু মেয়ে হইয়া জন্ম নেওয়ার জন্য আমাকে যেন আমার ন্যায্য অধিকার হইতে বঞ্চিত করা না হয়।’
এই চিঠি সারাদেশে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। জাতীয় সংসদের নারী সদস্যগণ সংবিধানের ২৯ (১) অনুচ্ছেদের প্রতি সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। যেখানে লেখা আছে, ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ ও পদ লাভের ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষ সমান সুযোগ লাভ করবে।’ অবশেষে সরকারের হস্তক্ষেপে বাংলাদেশ বিমান কর্তৃপক্ষ তাদের বিজ্ঞাপন থেকে বৈষম্যমূলক শর্ত প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। বাকি অংশটুকু ইতিহাস। উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার সকল স্তরে শ্রেষ্টত্ব দেখিয়ে ক্যাপ্টেন রোকসানা ১৯৭৯ সালের ২৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ও মুসলিম বিশ্বের প্রথম মহিলা পাইলট হিসাবে নিয়োগপত্র লাভ করেন। সর্বজনের শ্রদ্ধায় ভালবাসায় তিনি হয়ে ওঠেন এক বৈজয়ন্তী বৈমানিক।
৫ আগস্ট ছিল ক্যাপ্টেন রোকসানার ৩৬তম মৃত্যুবার্ষিকী।
১৯৮৪ সালের এই দিনে ক্যাপ্টেন রোকসানা ঢাকার উপকণ্ঠে এক বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হন।
ক্যাপ্টেন রোকসানার স্মৃতি রক্ষার্থে ১৯৮৫ সাল থেকে ‘মাসিক রোকসানা’ নামে একটি পত্রিকা আত্মপ্রকাশ করে। সম্পূর্ণ নারী পরিচালিত এই পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীর চেয়ারম্যান ছিলেন আলহাজ্জ সৈয়দা সুলতানা রাজিয়া, সম্পাদক সৈয়দা আফসানা, নির্বাহী সম্পাদক সৈয়দা কিসওয়ার জাহান, বৈদেশিক সম্পাদক সৈয়দা কিসওয়ার ফাতেমা মিলু ও বৈদেশিক সম্পাদক শরমীন নাহার শাহীন। আরও যুক্ত ছিলেন ডা. হারুন অর রশীদ (প্রধান প্রতিবেদক) ও জনাব খাইরুল আলম (চিত্রশিল্পী)।
আমার সৌভাগ্য যে, পত্রিকাটির জন্মলগ্নে ও শুভযাত্রায় আমিও অংশীদার ছিলাম। পত্রিকা কর্তৃপক্ষ আমার জন্য “All Women” নীতিমালা স্থগিত করে। আমিও সহকারী সম্পাদক হিসাবে যোগদান করি। ১৯৮৫ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত কর্মরত ছিলাম। এর মধ্যে কখন যে জড়িয়ে গেলাম ওই পরিবারের সাথেও, কখন যে হয়ে গেলাম তাঁদেরই একজন, নিজেও জানতে পারিনি।
তাঁর স্মৃতি কোথাও সংরক্ষিত নেই। উইকিপিডিয়ায় একটা সংক্ষিপ্ত বর্ণনা আছে, তা-ও অসম্পূর্ণ। জন্মবৃত্তান্ত নেই, শিক্ষাজীবন নেই, পেশাজীবন নেই। আছে শুধু দুর্ঘটনার বিবরণ। সবচেয়ে দুঃখ লাগে, গুগলেও রোকসানার ছবি নেই। অন্যজনের ছবি দেখায়। আমরা রিপোর্ট করেছি। তার মানে কী? আমার কাছে যা ডিটেইলস আছে, আমি মারা গেলে তাও হারিয়ে যাবে? কেউ কিছু সংরক্ষণ করবে না? জাতি হিসাবে আমরা কি এমনই অকৃতজ্ঞ হয়ে গেছি? আসলে যারা ১৯৭৯ সালে তাঁর নিয়োগ চায়নি, সেই পুরুষতন্ত্রের দৈত্যদানব এখনও সক্রিয় আছে। বরং আরও শক্তিশালী হয়েছে।
‘লিটল আপা’ আজ আর নেই। তাঁর শরীরী মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু যে দুর্নিবার সাহসের মশাল তিনি জ্বেলেছিলেন, তা আজও অনির্বাণ। আজও সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে নারী-পুরুষ বৈষম্য ও নারীর প্রতি অব্যাহত সহিংসতা যেন প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে আরেকজন ‘লিটল আপা’র অনিবার্যতা প্রমাণ করছে। তিনি ছিলেন সাহসের জীবন্ত পোস্টার। তাঁর হাত ধরেই বাঙালি নারীর প্রথম বিজয় সূচিত হয়েছিল আকাশে। রচিত হয়েছিল এমন এক অমর কীর্তিগাঁথা, যাকে বাদ দিয়ে এদেশের নারী আন্দোলনের ইতিহাস লেখা আর কখনও হয়তো সম্ভব হবে না।
তাঁর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।