ধর্ষণ : নেপথ্যে আমি, আপনি এবং গোটা সমাজ

অর্ভ নগভিত শুভ ঔষ্ণিক:

একটি স্বাধীন, সুন্দর, প্রগতিশীল এবং মানবিক রাষ্ট্রে ‘ধর্ষণ’ কখনই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হতে পারে না। সেই রাষ্ট্রে বড়জোর শিশুদের শিক্ষা দেয়া যায় ধর্ষণের সংজ্ঞা, ধর্ষণ কীভাবে অন্যের ব্যক্তি স্বাধীনতা হরণ করে, ধর্ষণ কেন নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে অন্যায় এবং পাশাপাশি কীভাবে এটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ!

কিন্তু বাংলাদেশে এতোসংখ্যক (গত ৬ মাসে ৭৩১টি নারী ও মেয়েশিশু ধর্ষণ, সূত্র- প্রথমআলো) ধর্ষণ হয়েছে যে এটি বর্তমানে একধরনের জাতীয় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হতে বাধ্য হয়েছে। যদিও অল্পসংখ্যক দৃষ্টান্ত ব্যতিত ধর্ষণ নির্মূলের উদ্দেশ্যে আলোচনা গড়িয়েছে ভিন্ন দিকে।

ধর্ষণ নির্মূলের উদ্দেশ্যে কাজ না করে বরং তা অপরিকল্পিতভাবে দমানোর প্রচেষ্টায় অধিক শ্রম ব্যয় করা হচ্ছে। অনেকটা ‘গাছ গোড়া থেকে না কেটে স্বল্প পরিশ্রমে ডাল-পালা কেটে’ দেওয়ার মতো অথবা ‘অস্ত্রবহনকারীকে পেঁদিয়ে লাট বানিয়ে ফেলা, আবার অন্যদিকে অস্ত্রব্যবসায়ীদের পশ্চাৎদেশে তা দেয়া।’

অতএব কাজ করা উচিত ধর্ষণ পুরোপুরি নির্মূলের উদ্দেশ্যে, মেয়েশিশুর হাতে ‘প্লিজ আঙ্কেল, আমায় রেইপ করবেন না’ এই জাতীয় প্ল্যাকার্ড ধরিয়ে দিয়ে অসহায়ত্বের সাথে দমানোর উদ্দেশ্যে নয়। যদিও দমন করার উদ্দেশ্য নিঃসন্দেহে সৎ এবং প্রশংসনীয়। কিন্তু পদ্ধতিটা কিঞ্চিৎ ভুল।

ধর্ষণের জন্যে আমি সর্বপ্রথম দায়ী করবো সমাজে প্রচলিত ‘পুরুষতন্ত্র’ এবং সুশিক্ষার অভাবকে। বলে রাখা ভালো, পুরুষতন্ত্র বা পিতৃতন্ত্র একটি দর্শন,তত্ত্ব বা সাইকোলজিক্যাল স্ট্যান্ড। পুরুষতন্ত্র মানেই কোনো ব্যক্তিপুরুষ নয়। একজন পুরুষ মাত্রেই যে তাকে পুরুষতান্ত্রিক হতে হবে, ব্যাপারটা এরকম মোটেও নয়। যেকোনো নারীও পুরুষতন্ত্রের চর্চা করতে পারে, সেটি তার নিজের অজান্তেই হোক না কেন!
আমাদের দেশে এই ধরনের নারীর সংখ্যাই বেশি যারা কিনা নিজের অজান্তেই যুগ যুগ ধরে পুরুষতন্ত্রের ঠিকাদার হিসেবে কর্মরত আছেন।

এইটুকু নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন যে ধর্ষণ নির্মূলের উদ্দেশ্যে সামনে এগোনোর সময় দৈত্যরূপ যে কাঁটাটি আপনার পায়ে বিঁধবে তার নাম ‘পুরুষতন্ত্র’।

এখন দেখা যাক, এই পুরুষতন্ত্র ধারণাটি অদৃশ্যরূপে কীভাবে সমাজে বলবৎ আছে এবং এর পরিণতি কতটা বীভৎস! আমাদের সমাজে বেশকিছু অদৃশ্য আইন রয়েছে যা আপাতদৃষ্টিতে যথেষ্ট যৌক্তিক এবং নৈতিক বলে প্রতিয়মান হয়, কিন্তু বস্তুত তা এমনটি নয়।
যেমন – নারীদের বাইরে অবাধে চলাচল উচিত নয়, নারীরা রান্নাবান্না-ঘরঝাড়ু-কাপড়সেলাই রেখে পুরুষের ন্যায় চাকরি-বাকরি করবে কেন, নারীদের পোশাকে শালীনতা থাকতে হবে (যদিও তা পুরুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য না এবং অশালীনতা আসলেই কী তা প্রশ্নবিদ্ধ হবার দাবি রাখে), নারীরা রাতে বাইরে ঘুরতে পারবে না ইত্যাদি ইত্যাদি।

তাই নারীরা যখন উল্লেখিত অদৃশ্য আইনগুলো ভঙ্গ করে তখন এই সমাজেরই কিছু পুরুষতান্ত্রিক তথাকথিত আইনরক্ষাকারী ব্যাটম্যান হিসেবে আবির্ভূত হয়। এই আইন ভঙ্গের জন্যে তারা নারীদের শাস্তি দেয়, সেটা হতে পারে মানসিক অথবা দৈহিক নির্যাতন অথবা ধর্ষণ!
প্রায় সংখ্যক নারীরাও এই নির্যাতনকে জায়েজ মনে করে থাকে। এবার নিশ্চয়ই ব্যাপারটা পরিষ্কার যে নারীরাও কীভাবে পুরুষতন্ত্রের চর্চা করে আসছে আদিকাল থেকে। তাই হত্যা করতে হবে এই অদৃশ্য আইনসমূহকে, ব্যক্তিকে নয় (নির্যাতক,ধর্ষক)। এই আইন যতদিন থাকবে, শত ব্যক্তি হত্যার পরেও এরুপ ব্যক্তি হাজারটা জন্ম নিবে।

পাশাপাশি ছোটকাল থেকে নারীবিদ্বেষপূর্ণ সমাজে বড় হওয়া, নারী-অবমাননাকে কৌতুক ভাবা, নারীদেরকে কাম-চরিতার্থের একমাত্র পণ্য ভেবে মগজ পরিপক্ব করা, আবার প্রকৃত নারীবিদ্বেষপূর্ণ পরিস্থিতিকে কৌতুক রূপে উপস্থাপনের অভিনয়ে (নাটক, সিনেমা) নারীদেরকেই ব্যবহার করা ইত্যাদি কুশিক্ষা যে আমাকে আর আপনাকে কখন ধর্ষক রুপ দিতে সাহায্য করে, তা আমরা নিজেরাও জানি না।

তাই সাহিত্যে, শিল্পে, চলচ্চিত্রে, ছোটোদের বইপত্রে, চিত্রে – নারী অবমাননা বিষয়ক উপাদান ব্যবহার না করে সামাজিক জীব হিসেবে আমাদের আরও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে।
নারীদের এই ব্যাপারে অধিক সচেতন হওয়া জরুরি। নিজ কর্মে আরও স্বাধীন, সচেতন এবং চিন্তাশীল হওয়া আবশ্যিক। আপনার কর্ম দ্বারা নারী অবমাননা হচ্ছে কিনা, নারীদের শুধুই ভোগ্যপণ্য রুপে উপস্থাপন করছে কিনা, নিজের অজান্তেই পুরুষতন্ত্রের ঠিকাদার হয়ে কাজ করে যাচ্ছেন কিনা তার সম্পর্কে জ্ঞান রাখা আপনারই দায়িত্ব।

সবশেষে বলবো, শিশুদেরকে পারিবারিকভাবে সুস্থ যৌন শিক্ষাই পারে এরকম সামাজিক, নৈতিক এবং মানবীয় গুণাবলীর অবক্ষয় থেকে এই সুন্দর বাংলাদেশকে রক্ষা করতে।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.