পত্রিকার শিরোনাম হতেই যেন নারীজন্ম!

ফাহমিদা খানম:

মন, মননে ও মানসিকতায় কতোটা আধুনিক আমরা? গোঁড়ামির যাঁতাকলেই আজও পিষ্ট কিনা এই জাতি! নারীরা নিজেদের প্রাপ্যতা চাইলেই ‘নারীবাদী’ খেতাবে ভূষিত করাটা কতোটা সুস্থ্য মনের পরিচয়?

আজকালকার নারীরা স্বাবলম্বী হচ্ছে, নিজেদের ব্যাপারে সচেতনতা বাড়ছে, নিজেদের ইচ্ছা- অনিচ্ছা প্রকাশ করছে, তাতেই কি তাদের ‘উগ্র’ বলে মনে হচ্ছে? নিজেদের প্রাপ্যতা চাওয়াকে কেনো সবার কাছে ‘নারীবাদ’ মনে হয়? আর ‘নারীবাদ’কে কেন নেতিবাচকভাবে দেখা হচ্ছে? নারী নিজের কথা, নিজের অধিকারের কথা বলছে বলে?

একজন নারীকে মানুষ ভাবতে যাদের এতো আপত্তি, তারা আসলে কারা? দেশের অধিকাংশ পুরুষ আয় করেই ধরে নেয় সংসারে সেই সবকিছু করছে, দিনের লম্বা সময়টুকু সংসারে দিয়ে নারীর শ্রম, আর কাজের কতটুকু মূল্যায়ন হচ্ছে সংসারে? সবকিছুকেই সমাজ, সংসার খুবই স্বাভাবিকভাবেই নিচ্ছে। এই ভাবনার শুরু কিন্তু হাজার বছরের পুরাতন। আর আমাদের দেশের গল্প, নাটক ,উপন্যাস আর সিনেমায় নারীদের এমনভাবে উপস্থাপন করা হতো যে সবার মগজে ঢুকেই গেছে নারী মানেই হলো নিজের সবটা উজাড় করেই দেয়া — নারী কোন রক্তমাংসের মানুষ নাহ সেখানে, মা- বাবার অনুগত সন্তান, স্বামীর প্রতি বিশ্বস্ত আর অনুগত আর সন্তানের মা হবার পরে বাকি যেটুকু ছিলো সেটাও বিলীন করে দেবার জন্যেই – সবার সুখের জন্যই যেন নারীজন্ম!

এটা কতোটা সুস্থ চিন্তা? ধনীর দুলারী প্রেমে পড়ে বস্তিতে গিয়েও মানিয়ে নিতে পারে, কিন্তু বিত্তশালী পরিবারের কোনো ছেলে যদি সাধারণ মেয়ের সাথে বিয়ে হবার পরে সে ছেলে দূর দূর করে তবুও মেয়েটি মাটি কামড়ে পড়ে থাকে মন পাবার আশায়! যে দেশের আমজনতা এসব দেখে বড়ো হয়, তারা শিখে নারীকে যে পাত্রেই রাখো না কেনো সে ঠিক খাপ খাওয়ানোর অসীম ক্ষমতা রাখে – মাঝেমধ্যে অবাক হয়ে অনুভব করি এ দেশের কবি, লেখক নারীর রুপের স্তাবকতা ছাড়া ভিন্নভাবে কিছুই তেমন লিখেননি –এটা কি ইচ্ছে করেই নাকি তারাও ছকের বাইরে কল্পনা করতে পারেননি!

অনেকদিন আগে একটা নাটক দেখেছিলাম — “মুখরা রমণী বশীকরণ”, মেয়েটাকে বশে আনার পর সবাই বাহবা দিলেও সত্যিকার মুখরাকে জেনেশুনে ভালবাসার সাহস কিন্তু দেখানো হয়নি, একবার চিন্তা করুন – এভাবেই কিন্তু নারীদের হেয় করার প্রবণতা সমাজে চলে এসেছে। এদেশে নারীদের সম্মান করার বিষয়টা সেভাবে কখনও আসে না, কী ঘরে কী বাইরে! তাই নারী যখন তার নিজস্ব প্রাপ্যতা চায় সেটা কারোরই পছন্দ হয় না – এটাকে নারীবাদ খেতাব দিয়ে নিজেদের বাহাদুর ভাবে কিছু পুরুষ, তবুও নিজেকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে আয়নায় নিজেদের দেখতে আপত্তি তাদের।

মেয়েদের পোস্টমর্টেম করা নিয়ে উস্তাদ জাতিরা পদে পদে কেবল নারীদের ভুল নিয়ে উল্লাসে মেতে উঠে – কোন নারী পরকীয়ায় লিপ্ত, কোন নায়িকা, গায়িকা কতবার বিয়ের পিঁড়িতে বসলো, সেসব নিয়ে গসিপ করে পৈশাচিক সুখ নেয় — উল্টোদিকে যখন স্বজাতীয় শিক্ষক, ডিসি সাহেব, হুজুর বা পুরোহিত যখন একই কাজ করে, তারা একসাথে হয়ে প্রতিবাদ করতে তেমন আগ্রহী হয় না। আমি কিন্তু বলছি না একাধিক পুরুষের বাহুলগ্না হয়ে কেউ ঠিক করছে, ব্যাপারটা হচ্ছে যেটা অন্যায় সেটা অন্যায়ই, সেখানে আলাদা খাতির করার চিন্তাটাই ভুল।

অনেকেই বলেন সৃষ্টিশীল মানুষেরা একটু/আধটু এমন হয়েই থাকে! এটাও আরেক ভুল – এভাবেই অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়া হয়। আর ওয়াজে যেভাবে নারীদেরকে নিয়ে বলা হয় – তাতে মনে হয় জগতের সকল অপরাধের মা-জননী কেবল নারীই – পুরুষ যে বিপদ টের পেয়ে নারীদের ভিক্টিম বানিয়ে সব ধোয়া তুলসীপাতা বানায় নিজেদের, এই সহজ সাধারণ সত্যিটা অস্বীকার করার নামই পুরুষতন্ত্র, নারীর সবটাই ভুল – পোশাকে ভুল, হাঁটায় ভুল, কথায় ভুল – অথচ একবারও কেউ বলে না পুরুষের দৃষ্টি সংযত করে চলার কথা! যে নারীর যত্নে পরম মমতায় সবারই বেড়ে উঠা, সেই নারীকেই অসম্মান করা হয় সব জায়গায়।
এসব সবাই মন দিয়ে শুনে, গিলে আর নারীদের অসম্মান করতে শিখে। স্বল্প জ্ঞানে যা বুঝি নারীদের সম্মান করার বিধান সব ধর্মেই আছে। দিনে দিনে যেভাবে গোঁড়ামি আমাদের আষ্টেপৃষ্টে পিছনের দিকে নিচ্ছে, তাতে করে মনে হচ্ছে নারীদের শুধুমাত্র ‘নারী’ করার পক্ষেই পুরুষতন্ত্রের কাছে হেরে যাচ্ছে মানবতা।

একজন মায়ের কাছে সন্তান সব একই হওয়া উচিত অথচ ঘর থেকেই শুরু হয় প্রথম বঞ্চনা — ভাইবোনের জন্যে ছাড় দাও, বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ির সবার মন জুগিয়ে চলো আর মা হলে নিজেকে ভোঁতা করে বাকি জীবন পার করে দাও, তুমি মহান হবে তাহলে।

বাহ্ কী সুন্দর ব্যবস্থা! মরণোত্তর ছাড়া আর কি জুটে এই দেশের নারীদের? যারা সত্যিকার সম্মান করেন তারাও সংখ্যালঘুদের দলেই, মানেন আর নাই মানেন! শিক্ষার হার বাড়লেও নারীর প্রতি মনোভাব সেভাবে এখনো বদলায়নি। সংসার চালাতে হলে পরিবারের প্রধানের ভূমিকা প্রয়োজনে কঠোর করতে হয়, অথচ সেটা এই দেশে সামান্য ভোটের কাছে জিম্মি, তাই বিদেশ থেকে দেশে ফেরত আসা মৃত নারীর সংখ্যা ‘আশংকাজনক নয়’ বলেই বিবৃতি শুনে অবাক বা বিস্ময়ের ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলি। বোধ, বিবেকের তাড়নায় অক্ষমতার নিস্ফল যন্ত্রণা ছাড়া কিছুই করার নাই আমাদের। সেই দেশের নারীদের অবস্থান আসলে কোথায় বুঝতে অসুবিধা হয় না, এদেশের নারী দেশে মরে, বিদেশে মরে – পড়াতে গিয়ে মরে, পড়তে গিয়ে মরে, কুপিয়ে মারার চেষ্টা করে, আগুনে পুড়িয়ে মারে! শুধুমাত্র পত্রিকার সংবাদ হতেই যেনো তাদের জন্ম!

পুরাতন পৃথিবীর চশমাটা খুলে নিজেদের মধ্যে সামান্য মানবীয় গুণাবলী অর্জন করে নারীদের যথাযথ মানুষ ভাবতে কবে যে শিখবে এই দেশের পুরুষকুল!

শেয়ার করুন: