একজন কিশোরের মৃত্যু আমাদের সম্মিলিত ব্যর্থতা

সুপ্রীতি ধর:

২০১৩ সালের এপ্রিলের কথা। ধসে পড়া রানা প্লাজায় তখনও উদ্ধার কাজ চলছিল। দেয়ালের পরতে পরতে লাশ ঝুলছিল ক্ষতবিক্ষত হয়ে, একদম নিচে চাপা পড়াদের দেয়াল কেটে, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কেটে উদ্ধার করা হচ্ছিল। কী ভয়াবহ সেই সময়! একটা না, দুইটা না, শয়ে শয়ে লাশ। সারা জাতি স্তব্ধ, যে যেভাবে পারছে সাহায্যের হাত বাড়াচ্ছে। সারাবিশ্বের চোখও বাংলাদেশের রানা প্লাজার দিকে। ওইসময় বাঙালী দেখেছিল একটি জাতির ‘সামাজিক মূলধন’ কাকে বলে! কতো সহস্র, অযূত-নিযুত, লক্ষ কোটি হাত তখন বাড়ানো হয়েছিল এই মানবিক বিপর্যয়ে! কিন্তু সেই সময়েও প্রথম আলো মেরিল তারকা জরিপের মতোন ঝলমলে অনুষ্ঠানটি করেছিল সম্মিলিত প্রতিবাদ সত্ত্বেও। তাদের যুক্তি ছিল, সব ঠিক হয়ে গেছে, সম্পন্ন হয়ে গেছে, এটা ফেরানো সম্ভব না। তবে অনুষ্ঠানে কিছুটা কাটছাঁট করা হবে। ওখান থেকে অর্জিত অর্থ দেয়ার আশ্বাস দেয়া হয়েছিল হতাহতদের জন্য। কতোটুকু হয়েছে জানি না। হয়েছে নিশ্চয়ই।

প্রথম আলোরই দোসর বেঙ্গল ফাউন্ডেশন। কর্পোরেট কালচারে দোসর মানেই দোসর। একে অন্যের অন্যায় আর দুর্নীতিগুলো ধামাচাপা দিতে তৎপর। প্রতিবছরের মতোন সেবারও তারা ক্লাসিক্যাল মিউজিক ফেস্টিভালের আয়োজন করেছে এরশাদ আর্মি স্টেডিয়ামে। আমাদের জাতীয় সম্পদ চিত্রকর কাইউম চৌধুরী ফেস্টিভালের চতুর্থ দিনে তার বক্তব্য দেয়ার সময় ডায়াসে দাঁড়িয়েই হঠাৎ করে ঢলে পড়েন হাজার হাজার মানুষের সামনে। সেখান থেকে তাকে সিএমএইচ- এ নিয়ে গেলে কর্তব্যরত ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন। আসলে মঞ্চেই তিনি মারা যান। এই খবরটি ছড়িয়ে পড়ার পরও উৎসব চলছিল। আমরাও সেই উৎসবে শামিল হয়ে মৃত্যুর গন্ধকে একপাশে সরিয়ে রেখে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে বোদ্ধা সেজে বুঁদ হয়ে পড়েছিলাম পুরো রাত। জীবন এমনই নিষ্ঠুর হতে শেখাচ্ছে আমাদের প্রতিনিয়ত।

সুতরাং কাল যখন একটি সদ্য প্রস্ফুটির কুঁড়ি রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুলে ঢলে পড়লো মৃত্যুতে, আমরা তখন ‘এই পৃথিবীতে কে কাহার’ বাণীতে শিক্ষিত জাতির আনন্দকেলিতে মত্ত হয়ে রইলাম। কোনো এক অভাগা মায়ের মন তখন ঠিক ওই মুহূর্তে দু:শ্চিন্তায় ছেয়ে গিয়েছিল কীনা, কে জানে!

তাইতো মাসকাওয়াথ আহসান লিখেছেন,

কেউ একজন কোনকালে বলেছিলো, দ্য শো মাস্ট গো অন। আমরা দক্ষিণ এশিয়রা একে অত্যন্ত আক্ষরিক অর্থে নিয়েছিলাম। পরীক্ষা দিয়ে বাবার শেষকৃত্যে আসা, ভাই মারা গেছে তবু বোনের বিয়ের লগ্ন পেরুতে দেয়া যাবে না, অসুস্থ রোগী সিক বেডে পরীক্ষা দেবে, রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের ক্রসফায়ারে শিশু মারা গেলেও থেমে থাকবে না নির্বাচনী প্রচারণা।

অভিভাবক উপদেশ দেয়, কে মরলো কে বাঁচলো তোমার দেখার দরকার কী, তুমি অংক করো।

দেশবরেণ্য চিত্রকর মঞ্চে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লে তারপরেও চালিয়ে যেতে হবে উচ্চাঙ্গ সংগীত সন্ধ্যা। কিংবা বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে কিশোর মারা গেলেও চালিয়ে যেতে হবে কিশোরদের নিয়ে আয়োজিত অনুষ্ঠান মালা।

এ হচ্ছে জাতিগত ইমোশনাল কোশেন্ট (ই কিউ)-এর দৈন্য বা সমানুভূতির বোধহীনতায় চলতে থাকা জীবন চর্যা। ঠিক এ কারণেই ইন্টেলিজেন্স কোশেন্ট ( আই কিউ) থাকার পরেও দক্ষিণ এশিয়ার জাতিগোষ্ঠীগুলো সভ্যতার আলোর মুখ দেখতে পেলো না। এইজন্যই মাঝে মাঝে আক্ষেপ করে বলি, ওরে মানুষের জীবনই যদি না বাঁচে; তোমার জিডিপি গ্রোথের চাটনি দিয়ে কী করবো!

এই ঘটনাটির পর স্বভাবতই সমালোচনার তীর প্রথম আলো পত্রিকাটির দিকে এবং বিশেষ করে কিশোর আলোর সম্পাদক কথাসাহিত্যিক আনিসুল হকের দিকে। সবার নজরও ছিল তাই আনিসুল কী লেখেন তার দিকে। সেটাও হতাশ করেছে আমাদের অনেককে। কিশোর আলো যদি পরিবার হয় তবে আবরার সেই পরিবারের একজন সদস্য। কিন্তু আনিসুল হকের কথায় স্বজন হারানোর কষ্টটার ছোঁয়া পাওয়া যায়নি। একটু দায়সারা গোছের লেগেছে। দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার মতোন মনে হয়েছে। কী জানি ভুলও হতে পারে। তাকে তো সাংবাদিক বা সাহিত্যিক হিসেবে জানার বাইরেও একজন পিতা হিসেবে জানি। কিন্তু তার ওই ফেসবুক পোস্টে একজন পিতাকে পাইনি আমরা। তাছাড়া প্রথম আলো পত্রিকাটিও অনেকটা দায়সারাভাবেই আবরারের মৃত্যুর খবরটি ছেপেছে। কাগজের পত্রিকাটি আমি দেখিনি। তবে কেউ কেউ জানিয়েছেন ভিতরের পাতায় খবরটি ছাপা হয়েছে। পত্রিকাটির সাংবাদিকরা নিজেদের অনেক উচ্চমানের সাংবাদিক ঠাওরান। কাজেই কোন খবরটি কোথায় ছাপা হবে এটা তাদের চেয়ে ভালো করে আর কারও জানার কথা না। শুধু বলবো, একজন কিশোরের লাশের ওপর দিয়ে হাজারও কিশোরের আনন্দ করার খবরটি দৃষ্টিকটু লাগছে আমার।

কিশোর আলোতে দায়িত্ব পালন করছিলেন আনজিলা জেরিন আনজুম। তিনি এই ঘটনার পর সেই দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন সংক্রান্ত একটি পোস্ট দিয়েছেন এবং লিখেছেন,

জাস্টিফিকেশান দিয়া কোলবালিশ বানায়া আপনেরা রাত্রে ঘুমায়েন। ভোর থেইকা শেষ পর্যন্ত ইভেন্টে উপস্থিত থাইকাও একটা কিচ্ছু টের পাইলাম না, টের পাইতে দেন নাই আপনেরা। সব জাইনাশুইনা প্রোগ্রাম শেষে দুইশ ভলান্টিয়ার আবার স্টেজে উঠাইলেন, লাইন কইরা গ্রুপছবি তুলাইলেন, মেমোরি রাখলেন! ছবিতে লাইট ভাল আসতেসে না, এঙ্গেল ভাল আসতেসে না, এইসব নিয়া বিস্তর গবেষণা করলেন! ছোটকাল থেইকা আপনাদের চারপাশে দেইখা বড় হইসি তো, অবাক লাগতেসে না কষ্ট লাগতেসে এখনো বুঝতেসি না!

নাদিয়া সারওয়াত লিখেছেন,

আমার মেয়ে কিশোর আলোর প্রোগ্রামে ছিল, ও ঘটনার কথা জেনেছে ৭টার কিছু পরে, ওখান থেকে চলে আসার পর। এখন পর্যন্ত ও শুধু এই আফসোসই করছে, ছেলেটা যখন মারা গেল, তখনও ওরা কনসার্টে হৈ-হুল্লোড় করছিল। ঘটনা জেনেও অনুষ্ঠান চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রথম আলো কর্তৃপক্ষ, এর জন্য শাস্তি হওয়া উচিত। ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা, এতো বড় প্রোগ্রামে নিরাপত্তার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নেয়া, সেসব অভিযোগেরও সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া উচিত।

ম্যারিনা নাসরীনও অপর একজন মা, যার ছেলে ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিল। তিনি লিখেছেন,

অত্যন্ত দুঃখের সাথে এই পোস্ট শেয়ার করছি। গতকাল ছিল প্রথম আলোর কিশোরদের পত্রিকা কিশোর আলোর (কিআ) আনন্দ উৎসব। যেটি ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল এন্ড কলেজে অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রতিবছর অসংখ্য শিশু কিশোর এই আনন্দ আয়োজনে অংশগ্রহণ করে। গতকালও প্রায় বিশ হাজার শিশু কিশোর কিআতে এসেছিল। আমার ছেলে মাহির আবরার রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল এন্ড কলেজের ক্লাস নাইনের ইংলিশ ভার্সনের একজন ছাত্র। কাল সেও কাজিন এবং বন্ধুদের সাথে কিআ’র অনুষ্ঠানে গিয়েছিল। প্রতিবছর যায়। গতকাল সাথে আমরা অভিভাবকেরা কেউ ছিলাম না। মনে হয়নি থাকা লাগবে। কারণ রেসিডেন্সিয়ালে নিরাপত্তার অভাব বোধ হয়নি কখনও। তবুও বারবার বলে দিয়েছিলাম এদিকে যেও না, ওদিকে যেও না, একসাথে থেকো। নাইমুল আবরার রেসিডেন্সিয়াল মডেলে আমার ছেলের ক্লাসমেট, তবে ও ডে শিফটে বাংলা ভার্সনে পড়ে। ওর মাও নিশ্চয় এমন ডিরেকশন দিয়েই ছেলেকে কিআতে আনন্দ করতে পাঠিয়েছিল। কিন্তু কী হলো?
কিশোর আলোর অনুষ্ঠানের একদম শেষদিকে (যতদূর জানা যায় অর্ণবের শেষ গানের সময়) নাইমুল বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়। তাকে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে এম্বুলেন্সে করে মহাখালিতে ইউনিভার্সাল হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে কিছুক্ষণ পর ডাক্তার তার মৃত্যু ঘোষণা করেন।

এই দুর্ঘটনা নিয়ে নানা অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে আমি সেদিকে যাবো না, আমার প্রশ্ন হলো এতো বড় একটা প্রোগ্রাম, যেখানে শিশু কিশোরেরাই মূলত অংশগ্রহণ করছে। এই ধরনের ঘটনা কীভাবে ঘটলো? বিদ্যুতের লাইন টানা বা ইত্যাদি বিষয়ে সর্বোচ্চ নজরদারী ছিল কি? সব থেকে বড় কথা সোহরাওয়ার্দীসহ আশেপাশে কয়েকটি হাসপাতাল থাকা সত্ত্বেও দ্রুত সেখানে না নিয়ে মহাখালিতে ইউনিভার্সাল হাসপাতালে ছেলেটিকে কেন নেওয়া হলো? দুর্ঘটনা হয়তো দুর্ঘটনাই, তারপরও এসব প্রশ্ন থেকেই যায়। তাৎক্ষণিক ভুল সিদ্ধান্ত বা গাফিলতির কারণে যদি একটি জীবন শেষ হয়ে যায় তার কষ্ট ভোগ করতে হয় শুধুমাত্র পরিবারকেই।

ঘটনাটি শোনার পর থেকে অদ্ভুত রকমের অস্থিরতায় ভুগছি। বিশেষ করে ছেলের ক্লাসমেট বলেই হয়তো। আমার বাচ্চা, ভাগ্নে তাদের বন্ধুবান্ধবসহ হাজারও ছেলেমেয়ে সেখানে ছিল। যে কারোর সাথেই ঘটনাটি ঘটতে পারতো। আমাদের কেমন লাগছে? ওই বাচ্চাও আমার। ওর জন্য ওর মায়ের মতো আমিও মায়ের কষ্ট অনুভব করছি। আমি আমার সন্তানকে কোথাও আনন্দ করতে পাঠালাম দিনশেষে শুনলাম আমার ছেলেটি আর নেই! এ কেমন কথা? কেমন অনুভব?
এসব বড়বড় অনুষ্ঠানগুলোতে আরো দায়িত্বশীলতা দেখানো জরুরী। না হলে পরে কোন ভরসায় আমি আমার সন্তানকে পাঠাবো?
আমার দাবি, পুরো বিষয়টিকে খতিয়ে দেখা হোক। আর কারও দায়িত্বে গাফিলতা থাকলে তার বিচার হোক।
প্রতিনিয়ত আমাদের সন্তানদের অপমৃত্যু দেখতে দেখতে ধীরে ধীরে আমরা জড় হয়ে যাচ্ছি। অচল জমাট আর নিরেট অনুভূতিহীন এক ধরনের পদার্থ – যার নামও মানুষ!

ফুলেশ্বরী প্রিয়নন্দিনীর মেয়ে অপ্সরী নন্দনাও গিয়েছিল ওই অনুষ্ঠানে। সেকথা উল্লেখ করে তিনি লিখেছেন,

গতকাল কিশোর আলোর অনুষ্ঠানে, রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুলের মাঠে আমার বড় কন্যা ও তার বন্ধুরা উপস্থিত ছিলো। অনুষ্ঠান দেখতে এসে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মৃত্যুবরণ করা নাইমুল আবরার রাহাতের বিষয়টি ঘূণাক্ষরেও বুঝতে দেয়া হয়নি কাউকে। বাচ্চাটা নবম শ্রেণিতে পড়তো, আমার অপ্সরীর মতো। গতকাল ভরসন্ধ্যায় আমার কাছেও আসতে পারতো কলিজা ছিঁড়ে নেয়া কোনো ফোনকল!
আবরারের মায়ের জায়গায় হতে পারতাম আমি সেই দুর্ভাগা মা! আমার কলিজার টুকরোর মৃত্যুসংবাদ গোপন করে চলতে পারতো আপনাদের ‘#কীআনন্দ’ কনসার্ট!

নীল জোনাকি লিখেছেন, কেয়া কসমেটিকসের পৃষ্ঠপোষকতায় ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল কলেজের মাঠ ভাড়া নিয়ে প্রথম আলোর আয়োজিত অনুষ্ঠানে জেনারেটরের তারে বিদ্যুতস্পৃষ্ট হয়ে মারা গেল আবরার নামের নবম শ্রেণীর ছাত্রটি। অথচ এমনটি হওয়ার কথা না। আয়োজক ও পৃষ্ঠপোষকদের দায়িত্ব ছিল অনুষ্ঠানে আগত ছাত্র-দর্শকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। কিন্তু তা তারা করেননি। করতে পারেননি। এতো বড় একটি আয়োজনে অরক্ষিত বিদ্যুৎ সরবরাহ থেকেই বোঝা যায় তারা ব্যর্থ হয়েছেন ন্যুনতম নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে। জেনারেটরের অরক্ষিত তারে জড়িয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়ার পর কলেজ কতৃপক্ষ কিংবা কলেজের প্রিন্সিপালকে দুর্ঘটনার বিষয়ে অবহিত না করে অনুষ্ঠান চলমান রেখে কেয়া কসমেটিকসের নির্ধারিত হাসপাতালে নেয়া থেকে বোঝা যায় আয়োজকরা কতোটা দায়িত্বহীন। হাসপাতালে নেয়ার পর ছাত্রটিকে যখন মৃত ঘোষণা করা হয় তখনও জীবন্ত ছিল মঞ্চে স্প্যানিশ গীটারের তারগুলো, জীবন্ত ছিল ড্রামসগুলো- মঞ্চে রাখা সারি সারি লাউড স্পিকারগুলো।

এ থেকেও বোঝা যায় এদেশে মৃত্যু কত সহজলভ্য, জীবন কত সস্তা! সম্ভবত কোনো বিশেষ মহলের ইশারায় আবরারের বাবা-মায়ের চুপ হয়ে গিয়ে তড়িঘড়ি করে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে লাশ দাফন করা থেকেও বোঝা যায় এদেশে জীবন কত মূল্যহীন!

শেয়ার করুন: