সাম্প্রদায়িকতার বিষ কেন মনের ভিতর?

শান্তা মারিয়া:

সমস্যা ফেসবুক নয়। সমস্যা মগজে। চল্লিশ বা পঞ্চাশের দশকে তো ফেসবুক ছিল না। তখন কীভাবে দাঙ্গা লাগানো হতো? তখনও মিথ্যা গুজব রটিয়ে নিরীহ মানুষকে খুন করা হতো।

নোয়াখালিতে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর একইভাবে গণহত্যা চালানো হয়েছিল। তখন মুসলিম প্রধান পূর্ববঙ্গে বলা হতো হিন্দুরা মসজিদে হামলা করেছে বা অমুক তমুক মুসলমানকে খুন করেছে। আর বিহার বা পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু প্রধান অঞ্চলে বলা হতো, মুসলমানরা মন্দিরের ভিতর গরু জবাই দিয়েছে কিংবা হিন্দু মেয়েকে ধরে নিয়ে গেছে।

এই ধরনের গুজব ছড়িয়ে অসংখ্য মানুষকে হত্যা করা হয়েছে এই উপমহাদেশে। এজন্য চাই শুভ সাংস্কৃতিক আন্দোলন। মানুষের মন থেকে সাম্প্রদায়িকতার বিষ দূর করা ছাড়া উপায় নেই। খুবই দুঃখজনক। একটা বিষয় বুঝি না, ফেক আইডি থেকে একটা বাজে কথা পোস্ট করা হলো আর ওমনি সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়লো! সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপরে হামলা করতে তৎপর হয়ে উঠলো! আমিও তো মুসলমান। রীতিমতো নামাজ-রোজা করা মুসলমান।

আমি যখন শুনি অমুকে তমুকে এই কথা বলেছে, কই আমার তো ধর্মীয় অনুভূতি এতো তিড়িং করে লাফিয়ে ওঠে না। আমি তো চিন্তা করি যে কে কেন কী কথা বলেছে সেটা আগে ভাবতে হবে।

মানুষের ঘাড়ের উপর আল্লাহ যে মাথাটা দিয়েছেন সেটা কি শুধু টুপি পরার জন্য? মস্তিষ্ক বলে যে বস্তুটা আছে সেটা এতো কম কেন? মানুষের মন এতো বিষাক্ত কেন? এই বিষ দূর করতে না পারলে বারে বারে ঘটনা ঘটতেই থাকবে।

অনেক তথাকথিত প্রগতিশীল মানুষের মনে (হিন্দু মুসলমান দুদলেরই) সাম্প্রদায়িকতা ঘাপটি মেরে থাকে। এমনকি এদেশের নাস্তিকরাও সাম্প্রদায়িক। কেউ হিন্দুবিদ্বেষী নাস্তিক, কেউ মুসলিমবিদ্বেষী নাস্তিক। প্রকৃত অসাম্প্রদায়িক মানুষ এদেশে হাতেগোণা। এই কারণেই এই অবস্থা। সত্যি বলতে সকলে ভয় পায়। আর রাজনৈতিক কিছু খেলা তো আছেই।

রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য বলা হয় চিলে কান নিয়ে গেছে। এখন ধ্বংস কর চিলের বাস। লাগাও অরণ্যে আগুন। আমার ভাবতে অবাক লাগে দুই ধর্মীয় সম্প্রদায় হলেও সবই তো বাঙালি জাতি। এই দেশেরই মানুষ। একসঙ্গে বসবাস। পরস্পরের প্রতি এতো ঘৃণা নিয়ে কিভাবে বেঁচে আছে এরা? এই তৌহিদি জনতা কারা? ফেসবুকের একটা উড়ো পোস্টের ভিত্তিতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার চক্রান্ত কারা করে?

সংখ্যালঘুদের উপরে তো এমনিতেই যথেষ্ট নির্যাতন হচ্ছে। রামুর ঘটনাও তো আমরা দেখেছি। তৌহিদি জনতার ব্যানার কারা তৈরি করেছে তাদের বিষয়ে তদন্ত করলেই থলের বেড়াল বেরিয়ে আসবে। ধর্মীয় আবেগকে ব্যবহার করে আর কতো খেল দেখতে হবে কে জানে।

বাংলাদেশের কথাই বলি। ভারতের বা পাকিস্তানের কথা বাদ দেই। কারণ আমার দেশ তো বাংলাদেশ। আমি এই দেশের মানুষ। এখানে মেজরিটি মুসলিম। হিন্দু জনগোষ্ঠি তো কমতে কমতে এখন নাই হয়ে যাচ্ছে। আমার শৈশবে যে হিন্দু সম্প্রদায়ের উত্সব অনুষ্ঠান দেখতাম তাও তো অনেক কমে গেছে। সেই মানুষগুলোও তো হারিয়ে গেছে।
কেন হারিয়ে গেছে? কিছু হলেই বলা হয় ভারতের মুসলমানদের তুলনায় বাংলাদেশের হিন্দুরা অনেক ভালো আছে। কেন ভারতের সঙ্গে তুলনা? ভারত কি আমার দেশ? দ্বিজাতিতত্ত্ব এখনও কি তাহলে মগজে শিকড় গেড়ে আছে? বাংলাদেশে হিন্দুরা যদি একেবারে রাজার হালেই থাকবে, তাহলে তারা দেশ ত্যাগ করছে কেন? তাদের উপরে চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে। পূজা আসলেই মূর্তি ভাঙচুরের খবর কেন শুনি? কেন কথায় কথায় মন্দিরে হামলা?

সত্যি কথাটা হলো হিন্দুদের সম্পত্তি দখল করার জন্য এই হামলা। তাদের ভিটামাটি দখল করার জন্যই ধর্মীয় অনুভূতির এতো রমরমা। এইজন্য এতো তৌহিদি জনতার বুকের রক্ত টগবগ করে ফুটছে। আসল কথা ভাঙচুর, হামলা। আসল কথা সমাজে অস্থিরতা তৈরির খেলা। যেখানে খুব বেশিসংখ্যক হিন্দু নাই (যেমন পাকিস্তানে), সেখানে শিয়া-সুন্নি কাজিয়া। আবার পাহাড়েও একই খেলা। পাহাড়ি জনগোস্ঠির ভূমি দখলের জন্য সেখানেও ধর্মীয় অনুভূতিতে সুড়সুড়ি দেওয়া হয়।

বাংলাদেশের মানুষের মন থেকে সাম্প্রদায়িকতা দূর করতে যে কী পরিমাণ ডিটারজেন্ট লাগবে তা খোদামালুম। শুভ সংস্কৃতির চর্চা হোক। বাঙালি সংস্কৃতির চর্চা হোক। মানবিক সংস্কৃতির চর্চা হোক। না হলে এসব অশুভ ঘটনা ঘটতেই থাকবে। বাংলাদেশকে রক্ষা করতে হলে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ সৃষ্টি করতেই হবে।

শেয়ার করুন: