কাজী তামান্না কেয়া:
বাংলাদেশের ঘরে ঘরে পুরুষেরা ধর্মপ্রাণ। তো ধর্মে বলা আছে স্ত্রীর হক আদায় করতে হবে, তার ভরণপোষণ দিতে হবে, স্ত্রীকে পর্দায় রাখতে হবে। স্ত্রীকে পর্দায় রাখার ব্যাপারে এখনকার প্রায় সব পুরুষ এক পায়ে খাড়া। তো পুরুষেরাই যদি না চাইবেন, তবে বিশ বছর আগে যেখানে অল্প কিছু বয়স্কা বা ধার্মিক পরিবারের নারী বোরকা পরতেন, সেখানে এখন অর্ধেকের বেশি বা ৭০-৮০ ভাগ নারী বোরকা পরেন কেন?
আমার মায়ের যখন বিয়ে হয়েছিল তাদের পর্দা ছিল ১২ হাত শাড়ি, দরকার মনে করলে মাথায় ঘোমটা দেয়া। এখন কী করে সেই জায়গায় বোরকা, হিজাব, নেকাব এসে দখল করলো, তা এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। বরং আজকের লেখার কারণ বিয়ের ভঙ্গুরতা, ক্ষেত্রবিশেষে এর অসারতা, বিয়ে করে সুখে থাকার ভান করা এবং এর কার্যকারণ নিয়ে।
শুরু করেছিলাম নারীর প্রতি পুরুষের কর্তব্য নিয়ে। বর্তমানে আমরা দেখছি, পুরুষ মানুষ স্ত্রীর পর্দা নিয়ে অত্যধিক সচেতন এবং স্ত্রীরা নিজেরাও সেটা মেনে নিয়েছেন। তাহলে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, স্বামীরা কি একইভাবে কর্তব্যপালন করছে স্ত্রীর হক এবং ভরণপোষণে?
তার আগে দেখি ‘স্ত্রীর হক’ মানে কী? প্রচলিত অর্থে স্বামীর সম্পদ এবং শরীর-মনের উপর স্ত্রীর অধিকারই হলো ‘স্ত্রীর হক’। অনেক পুরুষ এই দুটি হক সুন্দর করে আদায় করেন, স্ত্রীকে সম্মান করেন এবং দুই পক্ষ মিলে সুখে বসবাস করেন। এ পর্যন্ত সব ঠিক আছে।
বাস্তবে অনেক পুরুষ আবার সেটি মেনে চলেন না। ঠিক কত পারসেন্ট পুরুষ মেনে চলেন না, এই তথ্য এই মুহূর্তে আমার হাতে নেই। তবে সাম্প্রতিক সময়ে ডিভোর্সের হার যেমন বেড়েছে, তেমনি বেশিরভাগ ডিভোর্স নারীরা দিচ্ছেন পুরুষদেরকে। তার অর্থ, বিয়ে মানেই সারা জীবনের নিশ্চয়তা নয়।
অন্য কথায়, সব পুরুষ যদি স্ত্রীর হক সঠিকভাবে আদায় করে চলতো, তাহলে এতো পরকীয়া সমাজে এলো কী করে?
আমার পরিচিত এক বন্ধু সেদিন বলছিল, জানো, ভালবেসে বিয়ে করেছি, কিন্তু ওর পকেটে কনডম পেয়ে আমার ভালবাসা আর বিশ্বাস চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেছে। বন্ধুটি বাংলাদেশে থাকে এবং তার স্বামীর পরিবার যথেষ্ট ধার্মিক।
আরেক পরিচিতার কথা জানি, তার স্বামী কখনও তাকে নিজের ফোন ধরতে দেয় না, পাসওয়ার্ড দিয়ে রাখে এবং ফোনে কী আছে জিজ্ঞেস করলে স্ত্রীর সাথে ভীষণ খারাপ ব্যবহার করে। এই পুরুষও কিন্তু স্ত্রীকে পর্দায় রাখে, কিন্তু নিজে স্যুটে বুটে জড়িয়ে দারুণ স্মার্ট হয়ে চলাফেরা করে। অথচ এই দুজন নারীই উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত, তাদের স্বামীরা শিক্ষিত, এবং সমাজে গণ্যমান্য মানুষ। এই যদি হয় শিক্ষিত নারীদের জীবন, তাহলে অল্প শিক্ষিত, উপার্জন করতে না পারা নারীদের কথা বুঝতে আর বাকি থাকে না।
তবে সমাজে এমন পুরুষ আছেন যারা উদার মনের এবং আদতেই স্ত্রীর প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দিয়ে চলেন।
এর পরে আসি ভরণপোষণের পয়েন্টে। কম বয়সী অবিবাহিত নারীর কাছে মনে হতে পারে স্বামী মানে সারা জীবন ভরণপোষণের নিশ্চিত ব্যবস্থা, কারণ, সমাজ বা পরিবার তাকে তেমনটাই ভাবতে শিখিয়েছে। কম বয়সী নারীদেরকে কেউ বিয়ের অন্ধকার দিকগুলির সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় না। অথচ আমাদের অনেকের পরিবারেই একবার বিয়ে হয়েছিল, বনিবনা হয়নি, তাই স্বামীর সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে এমন নারী আছে।
তো বিয়ে মানে যদি সারাজীবন বসে খাবার সুযোগ হয়, এই নারীরা তবে সারা জীবন বসে খতে পারলেন না কেন? তাছাড়া যারা স্বামীর সংসার করছেন, তারা সবাই কি বেশ সুখে আছে? উত্তর হচ্ছে না।
আদতে সব নারী তেমন স্বামী পান না যাতে সত্যিকার অর্থেই তিনি মনে করেন বিবাহিত জীবন মানে সুখী জীবন। যারা বিয়েতে অসুখী কিন্তু বিয়েকে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন, তারা অনেকেই সুখের ভান করেন। পরিবারের সদস্যদের কাছে কিংবা আত্মীয় স্বজনের কাছে নিজেদের অসুখী বিয়ে লুকিয়ে রাখেন। ফেইসবুকের কল্যাণে নারীদের সুখী দেখানোর ভাণ করার জায়গাটা আরও চওড়া হয়েছে। যে নারী স্বামীর মার খান, একদিন বাইরে খেতে নিয়ে গেলে সেও স্বামীর সাথে পোজ দিয়ে ছবি তুলে ফেইসবুকে দেন।
তাই সত্যিকার অর্থেই কতজন নারী সুখী দাম্পত্য জীবনে আছে, তা বোঝা অবিবাহিত নারীর জন্যে খানিকটা কঠিন। আর সংসারে যদি একটা বাচ্চা বা দুইটা বাচ্চা চলে আসে, তাহলে অধিকাংশ নারীরা স্বামীদের অনেক বড় ধরনের দোষ বা সমস্যা সয়ে সংসার করে যান। আর অবিবাহিত বুঝতেই পারেন না বিয়ে একটা অতিরঞ্জিত বা ওভার রেটেড বিষয়।
যে নারীরা ডিভোর্সের মুখে পড়েন বা অত্যাচার-নির্যাতন সয়ে সংসার করে যান, তারা আসলে সংসারে কী ধরনের সমস্যায় পড়েন? অনেক রকম সমস্যা– যেমন স্বামীর অন্য নারীর প্রতি আসক্তি জন্মাতে পারে, বিশেষ করে স্ত্রী যখন গর্ভবতী হন বা ছোট বাচ্চা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন; স্বামীর যৌনকর্মে অনীহা থাকতে পারে বা স্ত্রীকে সন্তুষ্ট করতে অক্ষম হতে পারেন; স্বামীর আয়ের একটা বড় অংশ অন্য কাজে যেমন নেশা, মদ বা অন্যান্য কারণে ব্যয় করতে পারেন; স্ত্রীকে সংসার চালানোর বা হাতখরচ বাবদ প্রয়োজনীয় খরচ না দিতে পারেন; স্ত্রীর দোষ ধরে বেড়ানোর স্বাভাব থাকতে পারে তার এবং স্ত্রীকে সামাজিক মেলামেশায় বা কোথাও যেতে বাধা প্রদান করতে পারেন।
তাই অবিবাহিত নারী, বিয়েকে সারা জীবন ফ্রিতে সুখে থাকার চাবি মনে করবেন না। বিয়ের আগে সচেতন হোন, নিজেকে লেখাপড়ায় ও উপার্জনে যোগ্য করে তুলুন।