ফারজানা নীলা:
ধরুন, কোনোদিন আমার মায়ের কাছে একটা অফিশিয়াল চিঠি আসলো, ডাক হরকরা এসে বললো, “এখানে আইমুন নাহার নামে কেউ থাকেন?” আমি নিশ্চিত আমার মা হতভম্ব হবে। কারণ মাকে তাঁর নিজের নামে কেউ ডাকেনি বোধহয় বহু বছর। যদি এসে কেউ বলতো, “এখানে নীলার মা থাকেন?” তবে তিনি ঠিকই কোনোরকম অবাক না হয়ে বলতেন, হ্যাঁ, আমিই নীলার মা।
তিনি বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ কারো মা, কারো বউ, কারো বোন, কারো মেয়ে এইসব ডাক শুনতে অভ্যস্ত। শুনতে শুনতে নিজের আসল নাম কখনো হুট করে শুনে ফেললে অবাকই হবেন বৈকি!
আমি খুব বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করতাম, যখন আমার মা খালা একত্রিত হয় বা মা খালাদের নিয়ে কথা বলছে শুনি, তখনও তিনি ডাকছেন তাদের সন্তানের মা নামে। যেমন, “কনকের মা ফোন দিয়েছিল”, “তুলির মার সাথে দেখা করবো”।
একদিন তো জিজ্ঞেসই করলাম, “তুলির মা বলে কেন ডাকো? উনি তো তোমার ছোট বোন, নাম ধরে ডাকো। বললেন, “ঐ তুলি হওয়ার পর ওই নামই ডাকি”
আচ্ছা কেন এমন হয় বলুন তো? জন্মের পর সবাই তো একটা নাম পায়। কিন্তু আস্তে আস্তে সম্পর্কের লাইন বাড়তে বাড়তে নামটা হারিয়ে গিয়ে সম্পর্কটাই রয়ে যায় কেবল।
কিন্তু ব্যাপারটা সবার ক্ষেত্রে কি সমান হয়? আজ যদি আমার মা গৃহিণী না হয়ে চাকুরীজীবী হতেন, তবে অতি অবশ্যই তাঁর নাম খানা জ্বলজ্বল করতো। তাঁর কর্মক্ষেত্রে কেউ তাঁকে অমুকের মা, তমুকের বউ বলে ডাকতো না। তাঁর স্বনামে তিনি পরিচিত হতেন। যেমন পরিচিত হচ্ছেন আমার বাবা। তাকেও যে নীলার বাবা নামে কেউ ডাকে না তা নয়। তবে তাঁর এই পরিচয়ের বাইরে আলাদা পরিচয় আছে। তাঁর নামের পরিচয়। তবে হ্যাঁ তিনি “আইমুন নাহারের বর’ এই নাম কাগজে-কলমেই আছে শুধু, কেউ ডাকে না।
এই নামের পরিচয়ের মর্মার্থ আমরা কজন বুঝি? আমার মা’রা, খালা’রা নিজেদের নাম ভুলে সম্পর্কের নামেই নিজেদের পরিচয় দিতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। কারণ তাদের সেই সময়, সেই সুযোগ ছিল না যে নিজের নামে পরিচিত হওয়ার জন্য কিছু করবেন বা করার প্রয়োজন বোধ করবেন।
কিন্তু এখন সেই সময় আছে, সেই সুযোগ আছে, শুধু ইচ্ছেটা নিজের থাকতে হবে। সম্পর্কের নামে পরিচিত হওয়া খারাপ কিছু নয়। বরং আনন্দের ব্যাপার। কিন্তু এটাই যদি একমাত্র পরিচয় হয় তবে সেটা সুখকর নয় আর। বাধ্যবাধকতাপূর্ণ অভ্যাস মাত্র।
পরীক্ষার সার্টিফিকেটে যখন নিজের নাম দেখতে পাওয়া যায়, খুব ভালো লাগে না? তেমনি যদি নিজের একটা পরিচয় থাকে যে পরিচয়ে মাধ্যম হবে শুধুমাত্র নিজের নাম, তবে কেমন দারুণ হয়! গর্ব হয়!
এই নামের পরিচয় অর্জন করতে না জানলে একসময় বড্ড আফসোস হবে। আফসোস হবে জেনে যে সুযোগ ছিল, সময় ছিল, সমস্যাও ছিল, কিন্তু নিজের ইচ্ছাশক্তির জোরের অভাবে নামটাকে ধরে রাখা গেল না। সব “স”কে ফেলে রেখে এক “সমস্যা”কেই আঁকড়ে ধরে হারিয়ে গেলো নিজের নাম। নিজেকে আলাদা করার পরিচয়। এখন তুমি শুধুমাত্র কারো মা, কারো ঘরের বৌ বা অমুক বাড়ির ভাবী। তোমার নিজের নামটা উচ্চারণ করার মানুষও খুঁজে পাবে না একসময়।
মেয়েদের কোনো কিছু সোনার চামচ মুখে দিয়ে অর্জন হয় না। যাদের হয় তারা উদাহরণের বাইরে। সামগ্রিক বিচারে মেয়েদের কিছু পেতে হলে অতিরিক্ত খাটতে হয়। এই “অতিরিক্ত” এর মধ্যে পড়ে সমাজ পরিবার আপনজন পাশাপাশি পরজন। নিজেদের পুরুষের সাথে তুলনা দিলেও চলবে না। তারা কিন্তু কোনো “অতিরিক্ত” লড়াই করে এগিয়ে যায় না। পুরুষের নিজেদের নাম পরিচয় থাকবে এ তো স্বচ্ছ পানির মতো সোজা স্বাভাবিক।
মেয়েদের থাকবে এ কিন্তু স্বচ্ছ নয় কিছুটা ঘোলা। এই ঘোলা পানিকে স্বচ্ছ করার দায়িত্ব মেয়েদের নিজেদের। যদি সে নিজের নামের পরিচয়ের গুরুত্বটা বুঝে। যদি সে চায় যে তাঁর নামই তাঁর প্রথম পরিচয় হবে।