সুদীপ্তা ভট্টাচার্য্য রুমকি:
একজন সিঙ্গেল মাদার তার চার বছরের বাচ্চাকে স্কুলে ভর্তির খোঁজ নিতে গিয়েছিলেন, তার কথাবার্তা কতগুলো নরখাদকের অসংলগ্ন মনে হওয়ায় তারা তাকে ছেলেধরা সন্দেহ করে, স্রেফ সন্দেহের বশেই পিটিয়ে মেরে ফেলেছে! আর কয়েক শ মানুষ নামধারী জন্তুজানোয়ার তা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেছে, ভিডিও করেছে। যেন কোনো সার্কাস দেখছিল সবাই!
একজন একা মা যখন সন্তানের ভবিষ্যত চিন্তায় অস্থির, কিন্তু সন্তানের জন্মদাতা বাবার দায়িত্বজ্ঞানহীনতার কথাও তাকে লুকাতে হয় পরিবেশ পরিস্থিতি বিবেচনায়, তখন তার কথাবার্তা অসংলগ্ন হওয়াটা মোটেও অস্বাভাবিক কিছু না। কিন্তু সেই কথার জের ধরে তাকে ছেলেধরা বলে সন্দেহ করা এবং একেবারে প্রাণে মেরে ফেলা কতোটা ‘সংলগ্ন’ ছিল?
গণ্ডায় গণ্ডায় শিশুদের ধর্ষণ করা ধর্ষকরা ঘুরে বেড়ায়, পুলিশ যাদের নাগাল পায় না, সেই তাদের একজনও গণপিটুনিতে মরেছে বলে খুব একটা শুনিনি…অথচ একজন শিক্ষিত মাকে মারতে মারতে মেরে ফেলতে তাদের কালক্ষেপণ হয়নি।
বাচ্চার বাবা বাচ্চার খোঁজ নেবে না, বাচ্চাকে দেখবে না, খরচ দেবে না, বাচ্চা হয়তো বাবাকেও চিনবেও না, সেটা কোনো বিচার্য বিষয় নয়। অথচ সেখানে একটা মা কোথায় বাচ্চাকে রেখে যাবে, তার নিরাপত্তা কে দেবে, তার মানসিক গঠনে কোন সমস্যা না হয় সেজন্য হয়তো চাকরির হাজার সুযোগ জলাঞ্জলি দেবে, বাচ্চা নিয়ে অসহায় হয়ে ঘুরবে, আবার অজস্র মানুষের অজস্র প্রশ্নের সংলগ্ন উত্তরও দেবে! কী সুন্দর সমাজ ব্যবস্থা!
বাচ্চা পালা কাকে বলে জানেন? এতো সোজা, তাই না!! সকাল থেকে রাত পর্যন্ত উদয়াস্ত একটা শিশুর পিছনে খাটতে হয়। সুস্থতা, অসুস্থতা সবকিছু টানতে হয়। সেই কাজ ভাগ করে নেয় না কেউ, অথচ সন্তান জন্মদানের কারণে বাবা ডাকের অধিকারী ঠিকই হয়।
ইচ্ছাকৃতভাবে তারা সন্তানের মাকে ডিভোর্স দেয়ার নামে ডিভোর্স দেয় সন্তানকেও। মা পারে না ছেড়ে যেতে, সমস্ত দায়ভার মাথায় নিয়ে সর্বংসহা হয়ে ঠাঁয় দায়িত্ব পালন করে যায় মা।
আর সমাজ তখন বসে ম্যাগনিফাইয়িং গ্লাস নিয়ে সেই শিশুর মায়েরই চরিত্র এন্যালাইসিসে। কেন, কীসের জন্য, কোন কারণে তার স্বামী তার পাশে নেই?আহারে, উহুরে, ইশরে তো অনেক ভালো, আরেক পার্টি আছে যারা এক হাতে তালি বাজে না বিশেষজ্ঞ, তাদের নিজের চরিত্র থাকুক বা না থাকুক।
কোন সভ্য সমাজে অন্যের ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক গলানো অসভ্যতা বিবেচিত হয়, অথচ আমাদের সমাজে এই ধরনের প্রশ্ন এড়ানোর সুযোগ সিঙ্গেল মায়ের কোথাও নেই। একটা সামাজিক ট্রমার মধ্য দিয়ে মা’টিকে যেতে হয় আবার সন্তানের সমস্ত দায়িত্বও পালন করতে হয়।
কিন্তু কেউ সেই সুমহান পুরুষটিকে কি প্রশ্ন করে যে তার শারীরিক, মানসিক, চারিত্রিক কোন সমস্যার কারণে সে তার সংসার, সন্তান জলে ভাসিয়েছে! কোন চাহিদা তার সন্তানের ভবিষ্যত জীবন ছাপিয়ে উর্ধ্বে উঠে গেছে!
জানি সেই প্রশ্ন করবে না!
অথচ চরম সত্য একটা কথা হলো শুধু সন্তানের কারণে হাজারও নির্যাতন সহ্য করেও একটা মেয়ে চায় তার সংসার টিকে থাকুক, তার সন্তান অন্য সন্তানের মতো স্বাভাবিক জীবন পাক। সংসার নিজ থেকে ভাঙার শক্তি প্রকৃত অর্থেই এই সমাজের ডিভোর্স আইনত থাকার পরও মুসলিম মেয়েদেরও খুব একটা নেই, আর হিন্দুদের তো সেই সুযোগই নেই। এরপরও যদি সংসার ভাঙে, সেই দায়ও কিন্তু মাকেই বইতে হয়।
এমনও আছে বাচ্চাটির বাবা ভ্যানিশিং ক্রিম মেখে এদের জীবন থেকে এমনভাবে ভ্যানিশ হয়ে যায় যে যে তিনি কোথায় আছেন, কী করছেন তার প্রকৃত তথ্য মায়ের কাছে নাও থাকতে পারে…এখন জোড়াতালি দিয়ে এই জঘন্য আচরণকারীর সাথে সুন্দর স্বাভাবিক জীবন উপস্থাপন করতে গেলেও তো কথাবার্তায় অসংলগ্নতা প্রকাশিত হতে পারে।
বাচ্চাটির বাবার তো স্কুলের দ্বারে দ্বারে গিয়ে বাচ্চাকে ভর্তির দায় নেই, অসংলগ্ন কথা বলারও প্রয়োজন নেই। ফুরফুরে মেজাজে তিনি হয়তো প্রেমের পর প্রেমই করছেন, তাই তার পিটুনি খেয়ে মরার তো প্রশ্ন আসে না। বাচ্চাটি তো শুধু মায়ের! এই মায়ের বাচ্চাটির মা যখন আর কোনদিনই ফিরে যাবে না তার ঘরে, তখন তার বাচ্চাটিকে কে পালবে, পুষবে, ভালবাসবে, মমতা দিবে, ভাবতেও শরীর অবশ হয়ে আসছে।
আমার খুব কষ্ট হচ্ছে মা টির জন্য, আমি হলফ করে বলতে পারি সে মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও তার সন্তানটির জন্য বাঁচতে চাচ্ছিল। আমার নিজেরও তো ছোট্ট বাচ্চা আছে, আমি বুঝি আমার বাচ্চা আমি ছাড়া কিছু বুঝি না…আমিও তো ওর জন্য অনন্তকাল বাঁচতে চাই…।
আমার ছেলের স্কুলে ভর্তির ফরম জমা, ওর ভর্তির ইন্টারভিউ এ প্যারেন্টস এর জায়গায় একা বসা থেকে শুরু করে সবকিছুই আমিই করেছি, আমার হ্যাজব্যান্ড বগলদাবা হয়ে আমাদের সাথে যাননি, স্কুলের বাইরেও কোনদিন বাচ্চার জন্য দাঁড়াননি।
এখন আমার কথাও তো কারো কাছে অসংলগ্ন মনে হতে পারে…এখন থেকে হ্যাজব্যান্ডের নামের মালা গলায় পড়ে আমি বাসা থেকে বের হবো…ব্যাগে থাকবে তার মোবাইল নম্বর, কারণ আমার সন্তানের জন্য আমার বেঁচে থাকা জরুরি.. আমার হ্যাজব্যান্ড নিজেকে অবিবাহিত /সিঙ্গেল পরিচয় দিয়ে ঘুরে বেড়ালেও তাকে কেউ জিজ্ঞেস করবে না তার স্ত্রী বা সন্তান সম্পর্কে, কিন্তু আমার বা আমার সন্তানের কিন্তু বস্তাপঁচা, ঘুণে ধরা প্রশ্ন থেকে মুক্তি নেই…।
ছোট্ট শিশুর মা হিসাবে আরেকটা ছোট্ট শিশুর মায়ের নৃশংস হত্যায় এই নোংরা সমাজের মাথায় পদাঘাত করে বলছি….
তোদের মুখে মা ডাক একেবারেই অযোগ্য, অসহনীয়। তোরা কোনো মায়ের সন্তান নস।