বিয়ে, সংসার নিয়ে জল্পনা-কল্পনার জায়গা নেই

দিনা ফেরদৌস:

বিয়ে নিয়ে অবিবাহিতদের জল্পনা কল্পনার যেমন শেষ নেই, তেমনি সংসার নিয়েও বিবাহিতের গল্পের শেষ নেই। মুসলিম আইন বা ধর্মে বিয়ে শুধুই একটি চুক্তি, যা কোন ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা নয়। চুক্তি মানেই তার সাথে শর্ত থাকবে, শর্তের সাথে সামর্থ্যের ব্যাপার জড়িত। চুক্তি যেখানে আছে, সেখানে বিয়ে ভাঙ্গার নিয়ম থাকবে যা বেআইনী কিছু নয়।

এই বিয়ে অতিরঞ্জিত ভাবার ফলে দেখা যায় মানুষ মুখে আধুনিক কথাবার্তা বললেও বিশ্বাস করেন সেই প্রথা যে, লাল শাড়ি পরে বাপের বাড়ি থেকে বের হয়ে, সাদা কাফনে মোড়ে (মরার পর) স্বামীর সংসার ছেড়ে বেরুতে হয়। তার আর কোনো বাড়ি ছিল না কোনকালে, আর কোন বাড়ি নেই, তার কোন অতীত ছিল না, তার কোন ভবিষ্যত নেই এই সংসার ছাড়া।

আমাকে যদি কিছু বলতে হয় বিয়ে নিয়ে, তো বলবো, বিয়ে হচ্ছে গায়ের জামার মতো, যার মাপজোক গায়ের সাথে যাবে, পরেও আরাম লাগবে, দেখতেও মানানসই হবে। জামাটি পরতে গিয়ে একদিকে ঠিক করতে করতে যেন অন্যদিক খুলে পড়ে না যায়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

তারপরও অনেক সময় দেখা যায়, বাজার থেকে দেখে-শুনে বা ভালমতো মাপজোক দিয়ে নিয়ে আসা জামাও কোন এক সময় আর গায়ে ঠিকমতো লাগছে না। হয় আপনি মোটা হয়ে গেছেন, জামা হয়ে গেছে ছোট। এখন পরতে হলে সেলাই খুলে জোড়াতালি দিতে হবে। নয় আপনি হয়ে শুকিয়ে গেছেন, এখন সেই জামা পরতে গেলে কেটেকুটে হয়তো জামার সুন্দর অংশ বাদ দিয়ে পরতে হবে। বিয়েটা ঠিক একই রকম, সবকিছু আজ ঠিকঠাক মনে হলেও কাল সেই ঠিকঠাক নাও থাকতে পারে, যার জন্য ওইসব জল্পনা কল্পনা না করে নিজের কিছু প্রস্তুতি নিয়ে বিয়ে করা দরকার।

বিয়ের জন্য নারী-পুরুষ দুজনেরই শারীরিক, মানসিক, আর্থিক প্রস্তুতি থাকা দরকার। অনেক ছেলে আছে ত্রিশ হাজার টাকা ইনকাম করেও বিয়ে করার সাহস করতে পারছে না, সেখানে একটি মেয়েও যদি একই প্রস্তুতি রাখে যে সংসার খরচে সেও সমান অংশ গ্রহণ করবে তো অনেক সহজ হয়ে যায় বিয়েটা।

আর বাচ্চা জন্ম যেহেতু মেয়েদেরই দিয়ে হয়, সেহেতু ওই সময়ের প্রস্তুতি আগে থেকেই নিয়ে রাখা (যারা বাচ্চা নিতে ইচ্ছুক) যে ওই সময়কার খরচ বা বাচ্চা দেখাশোনা, সঙ্গে চাকরি ম্যানেজ। এইখানে ফালতু তর্কে যেতে চাই না, যে বাচ্চা জন্ম দিয়ে ক্যারিয়ার শেষ মেয়েদের। কে কীভাবে ক্যারিয়ারকে দেখবেন, তা আগে থেকে প্রস্তুতি রাখেন। ক্যারিয়ার চান তো বিয়ের চিন্তাই বাদ দিন। অনেকে বিয়ে না করে ভালোই আছেন, আর সেজন্য তাদের প্রস্তুতিও আছে।
জাপানে এখন বেশিরভাগ মেয়ে ক্যারিয়ারের জন্য বাচ্চা নেয় না। তাদেরও চলে। শুধু আধুনিক হবেন আর আধুনিকতার দায়ভার নিবেন না, তা হয় না। আধুনিকতার, স্বাধীনতার অনেক দায়ভার আছে আমার ভগিনীরা। মানুষ কথা বলবেই। কেনো কথা বলে তার উত্তর দিতে কারো ঠেকা পড়েনি। একবার কথা বলে মানুষ হাঁটা ধরে, পিছনে ফিরে তাকাবার সময় বেশি মানুষেরই নেই। যেমন বেকার সময় আপনারা কাটান অন্যে কে কী বললো তার গোঁ ধরে।

আমি বিশ্বাস করি, যারা সত্যিকার কিছু করার তারা সব বাঁধা পেরিয়ে, সব সমালোচনার মধ্যে থেকেই করছে। নিজেকে জিজ্ঞেস করেন উল্লেখযোগ্য কী এমন করেছেন, কী এমন আটকে গেছে অন্যের সমালোচনায়? আগে নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে শিখুন। তারপর সমাজকে গালি দিন। সমাজের বিবাহিতদের তালিকায় নাম উঠাতে বিয়ে করবেন, বাচ্চা নেবেন কেউ যাতে আঁটকুড়ে না বলে, সংসারে কেমন প্রেমে ডুবে আছেন ঘন্টায় ঘন্টায় তার পোস্ট করবেন, কারও কারও ছবি দেখলে তো মনে হয় এই মাত্র সেক্স করে উঠে আসলেন। পারলে দুজনে একসঙ্গে বসে টয়লেট করেন সেই ছবিও দিতেন।

সেক্স শুধু আপনারা জানেন না, কুদ্দুসের বাপ-মায়েও করে, না হলে দেশের এতো জনসংখ্যা বাড়ে ক্যামনে। আপনাদের প্রেম নিয়ে আমার সমস্যা নেই, সমস্যা হচ্ছে যখন দুজনের পোষায় না, তখন নিজেদের কথা না ভেবে লোকে কী মনে করবে তা ভেবে ভেবে অস্থির হয়ে যান। বিয়ে, প্রেম, সংসার, সন্তান সব সমাজের জন্য, আবার বিয়ে করে যখন পোষায় না তখনও ভাবছেন সমাজকে নিয়ে, সমাজ এখন কী ভাববে আপনাদের নিয়ে!

প্রিয় ভাই-বোনেরা, আপনাদের এতো প্রেমের মাঝে যখন সংসারটা নরক হয়ে উঠে, সমাজ কি তার দায় নেয়? আপনার সন্তান যখন আপনাদের বিচ্ছেদের ফলে মা-বাবার একসঙ্গে ভালবাসা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়, তার দায় কি সমাজ নেয়? আপনারা একবেলা না খেয়ে থাকলে, সমাজ ঘরে এনে খাবার দেয়?

শুনুন, রাস্তায় বেরুলে দুই/তিনটা দুর্ঘটনা ঘটতেই পারে, তাই বলে প্রয়োজনে ঘরে বসে থাকে না কেউ। নিজেরা কী চান আগে ঠিক করুন।
সংসার সমাজের একটা অংশ। আগে সংসারে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করুন। বাইরে বেরুলে সমাজ যেভাবে আপনার পিছনে উঠে পড়ে লাগে, সংসারেও এমন বহু লোক আছে আপনার কাজে বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে। ঘরের ফাইট থেকে বাইরের ফাইট অনেক সহজ মনে রাখবেন। যে জায়গায় আপনার মন সায় দেবে না প্রথম থেকেই সেই জায়গায় না বলুন, ফাইট করুন। আপনার ঘর থেকেই শুরু করুন। তারপর বাইরে এসে গলা ফাটিয়েন।

যারা মনে করেন বিয়ে সংসার করবেন তারা করুন, আর যারা করতে চায় না, তাদের দেখলে এইসব ন্যাকামি বন্ধ করুন। বিয়ে শুধুই যৌন জীবনের সার্টিফিকেটের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে একজন ভালো বন্ধুর সঙ্গ মনে করে যাপন করুন।

জীবন প্রতিদিন উদযাপন করা যায় না। প্রতিদিন কারোই ভালো যায় না। ভালোয় ভালোয় বেশি সময় যায় বলেই একটি সংসার টিকে থাকে। আর মন্দের ভাগ বেশি হলে তা বিচ্ছেদে গড়ায়। যাদের মন্দ ভাবে থাকার পরও টিকে আছে তারা কেউই ভালো নেই। এখানেও সমাজ যে কিছু বলে না, তা নয়। পারলে তৃতীয় পক্ষ মাঝখানে ঢুকে সেই সম্পর্কে আরও বিষ ঢেলে দেয়।

বিয়ে, সংসার নিয়ে খুব একটা জল্পনা-কল্পনার জায়গা নেই। এটাকে একটি চুক্তি ভেবে তার প্রস্তুতি নিয়েই আগাতে হবে। ফ্যান্টাসি কল্পনাতেই রাখুন, সংসার করুন সিরিয়াসলি। এখানে অনেক যত্ন লাগে, মায়া লাগে, বিশ্বাস লাগে, ভালবাসা লাগে, সব কিছুতে হিসাব কষতে যাইয়েন না। আর নিজের আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে কিছু করতে যাইয়েন না। সেই আত্মসম্মান থাকতে হলেও তার জন্য প্রস্তুতি লাগে, দুর্বলের আত্মসম্মান থাকে না। অপরের কাছে হাত পেতে আত্মসম্মান দেখানো যায় না।

অবশেষে বলবো, বিয়ে শুধুই একটি চুক্তি। চুক্তি যেখানে আছে সেখানে শর্ত থাকবে, শর্তের খেলাপ হবে। এই সমাজে সংসার করে অতীতেও কেউ কিছু উল্টায়নি, আগামীতেও আশা করা যায় না।

পরিবর্তন আনতে হলে ব্যক্তিকেই আনতে হবে, নিজ কর্মের মাধ্যমে। কিছু করতে চাইলে নিজে করুন, কে পিছনে কী বললো আর কার কী চুলকালো, তা নিয়ে ভাবা বন্ধ করুন। আপনি না পাল্টালে সমাজ পাল্টাবে না। মুখের কথায় সমাজ পালটায় না, সমাজ পাল্টায় সামাজিক কর্মে, মানে আপনার কাজ কর্মের মধ্য দিয়ে।

নিজের উল্লেখ্যযোগ্য কোন কাজ আছে কি, একটু তুলে ধরেন, কিছু লোক গালি দিলেও, কিছু অন্তত উপকৃত হবে। সমাজকে দোষারূপ করা বন্ধ করুন। যারা কিছু করেছেন তারা, এই সমাজের মুখে লাথি মেরেই দেখিয়ে দিয়েছেন। অধিকার আদায় মুখের কথায় হয় না যুদ্ধ লাগে, যুদ্ধ। যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি আছে তো?

শেয়ার করুন: