গৃহশ্রমকে অবমূল্যায়ন করে নারীবাদ ও নারী উন্নয়ন সবই তামাশা

ফারজানা আকসা জহুরা:

মনটা ভালো নেই, পিছনে রয়েছে অজস্র কারণ। আন্তর্জাতিক নারী দিবসে এতো এতো স্ট্যাস্টাস পড়লাম, কিন্তু কেউ সাধারণ নারীদের কথা বলে নাই!
এই যে সাধারণ নারী, যারা রান্ধে, বাড়ে পরিবারের লোকদের খাবার খাওয়ায়, অসুস্থ সদস্যদের দেখাশোনা করে, নিজেদের শিশুদের যত্ন নেয়, তাদের হাগুমুতু পরিষ্কার করে, লালনপালন করে, পড়াশোনা করায়, নিজেদের সংসারে সঞ্চয় করে সম্পত্তি করে, গরু ছাগল হাঁস মুরগি লালন-পালন করে, শাকসবজিসহ কত ধরনের কাজ করে পরিবারের খরচ কমায়, তাদের কথা তো কেউ বললো না? সমাজে কি এই সকল নারীদের কোনো অবদান নেই?

একবার ভাবুন তো আপনার বাবা, মা অসুস্থ হলে কে সেবা করে? এই সব সেবাযত্নের কি কোনো মূল্য নেই? আপনি যখন কাজে যান তখন আপনার সন্তানকে কে দেখাশোনা করে? এই সব কাজের কি কোনো মূল্য নেই? আপনি যেখানে দুই তিনজন টিচার দিয়ে সন্তানকে পড়াশোনা করাচ্ছেন, সেখানে অন্য আরেকজন নিজে তার ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা করিয়ে সংসারের টাকা বাঁচায়। সেটার কি কোনো আর্থিক মূল্য নেই?

ছবিটি ফেরদৌস আরা রুমীর ফেসবুক থেকে নেওয়া

কেউ কেউ বলেছে গৃহিণীরা স্বামীর টাকায় চলে, তাই তাদের কোনো মানসম্মান, অধিকার থাকতে নেই, তাদের উচিৎ নিজে রোজগার করে খাওয়া। খুব ভালো কথা, কিন্তু বিয়ের সময় কি কোনো পুরুষ বউকে এই শর্ত দেয় যে সে বউয়ের ভরণপোষন করতে পারবে না, যার যার টাকা তার তার? কেনই বা বিয়ের পরে সব কর্তৃত্ব পুরুষ নিজের হাতে রাখতে চায়? যে নারী চাকরি করে, বিয়ের পরে তার টাকা কি সে নিজের মতো খরচ করতে পারে? কিংবা পুরুষের মতো সংসারে কর্তৃত্ব বজায় রাখতে পারে? দয়া করে দুই একজনের কথা না ভেবে সংখ্যাগরিষ্ঠ নারীদের কথা ভেবে বলুন।

কেউ কেউ বলেছে, নারী ঘরে বসে থাকে, কোনো কাজ করে না। বাইরে কাজ না করা মানেই কোনো কাজ না করা? অথচ তারা দেখে না নারীর যে ২৪ ঘন্টা ঘরের কাজে শ্রম দিয়ে যাচ্ছে! আচ্ছা আপনাদের কাছে কি এইসব গৃহস্থালি কাজগুলিকে কাজ মনে হয় না? এসব কাজ করতে কি শ্রম লাগে না? সময় খরচ হয় না? এর কি কোনো বাজার মূল্য নেই? একটু ভেবে দেখুন এসব দৈনন্দিন কাজের প্রয়োজনীয়তা সবচেয়ে বেশি।

গৃহকর্মে ব্যবহৃত নারীদের শ্রমগুলি সমাজ, রাষ্ট্র নিজের কাজে ব্যবহার করছে। নারীর শ্রম সংসারে খরচ হচ্ছে। সন্তান মানুষ হচ্ছে। অসুস্থ মানুষ সেবা পাচ্ছে। মানব সম্পদ তৈরি হচ্ছে। অথচ আপনাদের চোখে নারীদের এই সব শ্রম চোখে পড়ে না? আপনার এইগুলিকে কাজ হিসেবে মূল্যায়ন করতে চান না? কিন্তু কেন? কেন এতো কার্পণ্য?

কেউ কেউ বলেছেন, পুরুষের উপর থেকে আর্থিক চাপ কমাতে হবে! কিন্তু নারীদের উপর থেকে কি সন্তান জন্মদান, লালনপালন থেকে মুক্তি আছে? সন্তান গর্ভধারণ, জন্মদান, লালনপালন এর সাথে যদি তার উপরে বাইরের কাজের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে কি তাদের উপরে কাজে বোঝা বেড়ে যাচ্ছে না?

যে সংসারে নারীকে সাংসারিক কাজে সহযোগিতার মানুষ থাকে সেই নারী হয়তো ইচ্ছে করলেই বাইরের কাজ করতে পারে, কিন্তু যার সেই সুযোগ নেই, তিনি কী করবেন? সংসার আর সন্তানের দায়িত্ব কাকে দিয়ে কাজে যাবেন? আর আমাদের সমাজে কয়টা পুরুষ গৃহস্থালি কাজে সাহয্য করে? একটু তাকিয়ে দেখুন তো, যে নারী চাকরি করে, তাদের কি সন্তান আর সংসারে কাজ করতে হয় না? তাহলে কি নারীকে পুরুষ চাইতে বেশি কাজ ও দায়িত্ব নিতে হচ্ছে, নাকি কম?

কেউ কেউ আবার সফল নারী খুঁজে বেড়িয়েছেন। মানে যারা চাকরি বাকরি করে, ব্যবসা করে ইত্যাদি ইত্যাদি। তাহলে যারা নিজ পরিবারের যত্ন নেয়, দিনের পর দিন, রাতের পর রাত এতো এতো শ্রম গৃহকর্মে ব্যয় করে সন্তান মানুষ করে, অসুস্থ সদস্যদের সেবা করে, এগুলি সব ছোট কাজ? এসব কাজের কোনো সফলতা নেই? নারীদের গৃহশ্রমকে অবমূল্যায়ন করে কি নারী অধিকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব?

আপনারা যতোই দিবস পালন করেন, আর নারী অধিকার নিয়ে গলা ফাটিয়ে গান করুন, এই সমাজে নারী অধিকার কিংবা নারী নির্যাতন বন্ধ হবে না। কারণ যতদিন আপনি, আমি, আমরা, সমাজ, রাষ্ট্র গৃহকর্মকে কাজ হিসেবে স্বীকৃতি না দিব, যতদিন মাতৃত্বকে রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মান না করবো, যতদিন সন্তান লালনপালনকে কাজ হিসেবে গণ্য না করবো, ততদিন নারী অধিকার, আর নারী উন্নয়নের স্বপ্ন বড় বড় পরিকল্পনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে।

মনে রাখবেন দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ নারী সমাজকে গালাগালি করে তাদের গৃহশ্রমকে হীন দৃষ্টিতে দেখে, তাদের কাজগুলিকে অবমূল্যায়ন করে নারীবাদ আর নারী উন্নয়ন সবাই তামাশা।

শেয়ার করুন: