শেখ হাসিনার বাংলাদেশ

শামীমা জামান:

রাজনীতিতে চরম ঘটনাবহুল ২০১৮ শেষ হলো। শেষ চমক ৩০ ডিসেম্বর এর নির্বাচন যা ধাতস্থ হতে বুঝি স্বয়ং আওয়ামী নেতাদেরও সময়ের প্রয়োজন। একদিকে আওয়ামী সমর্থকেরা যেমন এই নির্বাচনকে সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন দাবি করছেন, অপরদিকে বিরোধী শক্তি তথা সাধারণ জনগণ নির্বাচনের থলের বিড়াল বের করতে সময় নেয়নি।

দেশের ৩০টি টেলিভিশন চ্যানেল এখন বিটিভির মাসতুতো ভাই বই কিছু নয়। মাত্র ২০ কোটি টাকা ব্যয় করে হয়তো মেইনস্ট্রিম অনেক মিডিয়াকে মূক ও বধির করা সম্ভব। কিন্তু এই সময়ের সবচেয়ে বড় মিডিয়া তো আসলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। একে সামলাবে কে? গত দশ বছরে উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় সবচেয়ে বড় উন্নয়ন হয়েছে ডিজিটাল সেক্টরে। ডিজিটাল বাংলাদেশ আজ শুধু মুখের ফাঁকা বুলি নয়, প্রকৃত অর্থেই দেশ ডিজিটালি দারুণ সুবিধা ভোগ করছে। সেই সুবিধাতেই আজ কোন ঘটনাকে ধামাচাপা দেওয়া দুষ্কর হয়ে উঠছে। হাতের মোবাইল সেটটার কল্যাণে মুহূর্তে কত ফুটেজ ছড়িয়ে পড়ছে।

কী চমৎকার দেখা গেলো, নারীকে ভোটদানে বাধা দিয়ে বলা হচ্ছে ‘শুধু শুধু ঝামেলায় পড়বেন। ভিতরে যেয়েন না’। নারীটিও সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করলো তার আওয়াজে ‘আরে এরকম করতিসেন কেন, ভোট আপনাগেই দিবানি’। ক্যাডার হাত সরিয়ে বললো ‘আমরা কিন্তু দেখতে পারবো কোথায় দেছেন’। ভোট দিতে না পেরে কেউ বা চিৎকার করে অভিশাপ দিচ্ছেন ক্ষমতাসীনদের প্রতি।
অনেক আওয়ামী সমর্থককেই দেখা গেলো ভোট দিয়ে এসে কালিমাখা আঙ্গুলফিতে ফেসবুক সয়লাব করতে। বলা হচ্ছে, ব্যালট পেপারে আগে থেকেই নৌকায় সিলমারা যজ্ঞ চলেছে। এবং প্রশাসনের সহায়তায় সারাদেশব্যাপী এই কম্ম পূর্বপরিকল্পিতভাবেই হয়েছে বলে দায়িত্বপ্রাপ্ত কিছু কর্মকর্তা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন।

পূর্ণাঙ্গ নিরপেক্ষ নির্বাচন স্বাধীন বাংলাদেশে হয়তো হয়নি, কিন্তু এই প্রকারের ডাকাতিয়া নির্বাচন ও স্বয়ং আওয়ামী সমর্থক যারা কিনা আর কোন বিকল্প যোগ্য দলের অভাবজনিত কারণে কিংবা সিরিয়া, আফগানিস্তান বা পাকিস্থানী জুজুর ভয়ে হীরক রাজার দেশের চলমান স্বৈরতান্ত্রিকতাকে নীরবে মেনে নিচ্ছেন, তারাও চাননি।
এর ফলে প্রকৃত বিজয়ী নেতাদেরও বিজয়ের গৌরব আর রইলো না। আফটারঅল ৭২ সালের পরীক্ষাতেও তো কিছু মেধাবী ছিলো। গত দশ বছরে উন্নয়ন তো কিছু কম হয়নি। যদিও নেতাকর্মীদের লুটপাট, রিজার্ভ চুরি, সোনা চুরি নানাবিধ ঘটনাকেই বিরোধী শিবির তথা সাধারণ জনগণ বড় করে দেখেছে। পাপের ঘড়া পূর্ণ হলে আত্মবিশ্বাস এর অভাব চলে আসে। কথা হচ্ছে দেশের সবচেয়ে প্রাচীন আর বড় রাজনৈতিক দলটির আত্মবিশ্বাস এর লেভেল কি এই পর্যায়ে নেমে এসেছে যে এই প্রকারের একটি নির্বাচন এর পরিকল্পনা করতে হলো! আধমরা বিএনপিকে সত্যিকারের মোকাবিলা করার সাহসই হলো না।

ড. কামাল হোসেনের আগমন, ঐক্যফ্রন্ট গঠন বিএনপি’র মতো প্রায় মরহুম দলকে পুনরুজ্জীবিত করে বটে তাতে এতোটাও ঘাবড়ানোর দরকার ছিলো না। যদিও কামাল হটাও প্রকল্পের অংশ হিসেবে ড. কামালের গাড়ি বহরে আক্রমণ থেকে সাংবাদিকদের পুশিং কিছুই বাদ ছিলো না। ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনকে জামাতের প্রতিনিধিত্ব বিষয়ে মাসুদা ভাট্টি ৭১ টেলিভিশনে যে ধরনের আক্রমণাত্মক এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রশ্ন করেছিলেন, ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে ড. কামাল হোসেনকেও একই কায়দায় ধরা হলো। বয়সজনিত কর্কশ মেজাজে তিনি ‘খামোশ’ শব্দটি উচ্চারণ করে একেবারে পেনাল্টি দিয়ে দেন।
দুই হোসেন একই টোপ গিললেন। যদিও এই কামালকে ভয় পাবার এতো দরকার ছিলো না উন্নয়নের সরকারের। ড. কামাল হোসেন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি, সংবিধান প্রণেতাদের অন্যতম। তার যোগ্যতা নিয়ে লিখতে গেলে দিস্তা দিস্তা কাগজ শেষ করা যাবে। কিন্তু এই কামাল কি সেই কামাল? যারা ডেভিড বার্গম্যান এর কার্যবিধি সম্পর্কে জানেন, তাদের কি আর কামালে সেই আগের শ্রদ্ধা থাকে?

তবু কেন জানি মনে হয় ড. কামাল আজ যার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলেন, শেষ বয়সের সমস্ত শক্তি দিয়ে তিনিই হয়তো এই কামালকে সৃষ্টি করেছিলেন। এটাই ছিল জাতির জন্য দুর্ভাগ্যের যাত্রা। এই কথাটি আজ মনে হলো এই কারণে যে লৌহমানবী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অসাধারণ রাজনৈতিক কৌশলে অনেক বদহজমের জিনিসকেও হজম করতে জানেন। পাশে নিয়ে হাসিমুখে চলতে জানেন। জাতি ধ্বংসকারী ইয়াবা বদি আজ তাবলীগ জামাতের ওয়াজ করে। বদির স্ত্রী বিজয়ী বেশে ইয়াবার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সংকল্প করে। এর চেয়ে বড় জোক তো আর হতে পারে না।
এখন প্রশ্ন হলো এরা কি প্রধানমন্ত্রীর জন্য এতোটাই অপরিহার্য যে সমস্ত ভয়ানক সত্য জানার পরও তিনি (কিম্বা হয়তো জানেন না, প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত খবর পৌঁছানো লোকগুলো কি তোষামোদি ছাড়া সত্যিকারের খবর তাকে দেন?) এই পরিবারটিকে ছাড়ার ক্ষমতা রাখেন না। মাদকের অভিযানে ষড়যন্ত্র করে অনেক কম অপরাধীকেও ক্রসফায়ারে দেওয়া হয়েছে। আমরা ইকরাম এর মেয়েটির আর্তনাদ ভুলে যাইনি। ‘আব্বু তুমি কান্না করতিছ কেন?’

বিশ্ব মিডিয়ায় এই ষড়যন্ত্রের নির্বাচন এর খবর প্রচার হয়েছে। ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগ সরকার তার হ্যাট্রিক শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান সম্পন্ন করেছে। ঝাঁকে ঝাঁকে নেতা কর্মীরা ফুলেল শুভেচ্ছা জানাতে ভিড় করছে গণভবনে। বুড়োপাতি মিলিয়ে কিছু শোবিজ তারকাকে দেখা গেলো গণভবনে গণ্যমান্যদের মাঝে যেতে পেরে ধন্য হতে। এরা আওয়ামী এম্বাসেডর হয়ে নির্বাচনী প্রচারণায় অর্থের বিনিময়ে অংশ নিয়েছিলো। যেন তারা বিজয় ছিনিয়ে এনে দিলো চোখে-মুখে সেই ভাবভঙ্গি অটুট রেখে ফুলের শুভেচ্ছা জানাচ্ছিলো প্রধানমন্ত্রীকে।

এখন নতুন ষড়যন্ত্র নিয়ে হয়তো মাঠে নামবে বিএনপি। কিইবা আর করতে পারে তারা আগুন লাগানো আর গুজব ছড়ানো ছাড়া! যারা দেশকে স্বৈরশাসনমুক্ত করার স্বপ্ন দেখেছিলেন, তারা জেনে রাখুন, বিএনপি ক্ষমতায় এলে আওয়ামী লীগের চেয়েও বেশি দুঃশাসন এর রাজত্ব কায়েম করতো। তাদের নির্বাচন পরবর্তী মাস্টারপ্লান সেই কথাই বলে। বরং আওয়ামী সরকারের মধ্যে এখন কিছুটা হলেও জবাবদিহিতার রাজনীতি থাকবে। পেট্রোল বোমার সেই ভয়ংকর দিনগুলোর কথা মনে করেও মানুষ আওয়ামী স্বৈরশাসনকে মেনে নিতে বাধ্য হয়।

তবে একথা স্বীকার করতেই হবে, একজন শেখ হাসিনার মতো রাজনৈতিক কৌশলী নেতা অন্য কোন দলে নেই। ২৫ ফেব্রুয়ারির শোকগাথা, সাগর-রুনীসহ কিছু বিতর্কিত ঘটনা নিয়ে নিন্দুকদের কানকথা বাদ দিলে শেখ হাসিনাকে অপছন্দ করার কোন কারণ নেই। ব্যক্তি শেখ হাসিনা চমৎকার একজন মানুষ। তাকে ঘিরে বাংলাদেশ স্বপ্ন দেখতেই পারে নতুন করে যদি নবনির্বাচিত সরকার মন জবাবদিহিতার প্রক্রিয়ার মধ্যে থাকতে পারে নতুন তরুণ সৎ রাজনীতিবিদদের সাথে করে।

শেয়ার করুন: