সৈয়দা সাজিয়া আফরীন:
মেয়ে/নারী ঈর্ষাকাতর,পরস্পরের অমঙ্গল বা অনিষ্ট কামনাকারী; একেকজন নারী মানেই পৃথিবীশুদ্ধ নারীর প্রতিদ্বন্দ্বী। যদিও প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকা জীবনের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কিন্তু নারীর প্রতিযোগিতা হবে শুধু নারীর সাথে পুরুষের সঙ্গে নয়। খুব আপন কেউ হলেও এক নারীর রূপে, গুণে, মর্যাদায় অন্য নারীর কপালে কিঞ্চিৎ ভাঁজ পড়বে, হিংসের হালকা আভাস দেখা দেবে চোখে, মুখে থাকবে অনিশ্চয়তার অন্ধকার।
-এরকম একটা থিউরির চর্চা বেশ চলে, এই থিউরির ডোজটা অনেকেই ভালো মতো গলাধঃকরণ করেছেন বলেই নিজের সুখের কথা, অর্জনের কথা, গর্বের কথা বলতে গিয়ে অন্যের চোখে খোঁজেন আকাংখিত ঈর্ষা; যেন ঈর্ষা না পেলে সুখটা ঠিক জমে না।
উদাহরণে আনি ঐশ্বরিয়ার রূপে তামাম পৃথিবীর নারী ঈর্ষাবোধ করবে, অন্যদিকে সালমান খানকে পুরুষ ঈর্ষা করবে না বরং তার ভক্ত হবে, ধনাঢ্য বিল গেটসকেও পুরুষ ঈর্ষা করবে না অনুসরণ করবে।
বউ শাশুড়ির দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে এই ধারণাটাকে আরেকটু পাকাপোক্ত করা হয়।
এই তত্ত্বের ফলাফল সুদূরপ্রসারী। এই রেষারেষি নামক ফলের স্বাদ কিন্তু নারী আস্বাদন করে না। পুরুষ করে। ব্যখ্যা দিচ্ছি- সন্ধ্যায় অফিস শেষে পুরুষ বয়েজ আড্ডায় যায়, বয়েজ পার্টি করে। ছুটিতে ওদের হ্যাং আউট করতে হয়, ট্র্যাকিংয়ে যেতে হয়, ওদের ধুমধাম প্রোগ্রাম সেটও হয়ে যায়। ওরা টাচে থাকে। একটা বন্ধু দলে বা কলিগ দলে যদি পাঁচটা মেয়েও থাকে, মেয়েদের ওরা গুরুত্বপূর্ণ মনে করে না যতক্ষণ না বিপরীত কোনো আকর্ষণ না জন্মায়, বা কোন স্বার্থ না থাকে।
অন্যদিকে মেয়েদের যোগ্যতা আছে, বন্ধুও আছে, অথচ গার্লস পার্টিতে ধুমধাম করে হয়ে যায় না। মেয়েরা পরস্পর টাচে থাকে না। মেয়েদের হ্যাং আউট হয়ে ওঠে না। কর্মস্থলের ক্লান্তি মুছতে রিমোটে চ্যানেল বদল করা ছাড়া নৈমিত্তিক নিজস্ব রিফ্রেশমেন্ট থাকে না। এর কারণ কি আসলেই শুধু সংসারের কাজ বা দায়িত্ব? যেখানে দুদণ্ড সময় বের করা যায় না!
আমি কোনো গবেষণা না করেই বলতে পারি মেয়েদের সামাজিক একাকিত্বটা তুলনামূলকভাবে বেশি। চাকরি, ব্যবসা, সৃষ্টিশীল কিছু যাই করুক, তার পরিমণ্ডল যত বড়ই হোক, নারীর নিজস্বতা নিয়ে দ্বিধাহীন বন্ধুত্বের দৈর্ঘ্য এবং ঘনত্ব খুব সীমিত। তাই হুটহাট একটা চা চক্রও হয়ে ওঠে না।
এরকম নেতিবাচক অনুভব নারীর সহজাত বা প্রাকৃতিক নয়, এগুলো নির্মিত এর কিছুটা নির্মাণ করেছে সমাজ কিছুটা পুরুষ। যারা বারবার প্রতিদ্বন্দ্বীরূপে এক নারীকে অন্য নারীর মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। তুমি সখিনার মতো গৃহস্থালী কাজ জানো না, জরিনার মতো সুন্দর না, কমলার মতো গান জানো না, কবরীর মতো নাচতে পারো না, শ্যামার মতো কথা বলতে পারো না।
এই ঈর্ষা নিজস্ব নয়, আরোপিত। সামাজিক উপহাস, অমর্যাদাপূর্ণ তুলনা এই ঈর্ষা ঘৃণা এবং অপ্রয়োজনীয় প্রতিদ্বন্দ্বিতার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে। নারীর জন্য বরাবরই প্রতিকূল পরিবেশ, নারীর প্রতি দূষিত প্রতিক্রিয়া সেটাকে আরও উসকে দেয়।
বউ শাশুড়ি দ্বন্দ্ব নিয়ে আমার একটা কাজ আছে।
আমি যত সংখ্যক সম্ভব শাশুড়ি ফিগারদের সাথে ঘনিষ্ট কথা বলেছি। বিশেষভাবে তাদের বধূ জীবনের গল্প। কোন না কোন ছলে আমি বের করে এনেছি সেইসব দিনের কথা, যেদিন তিনি ভিক্টিম ছিলেন। তাতে এমন সব অমানবিক ঘটনা জেনেছি যা নৈমিত্তিক হজম করে করেই আজ তিনি শাশুড়ি। খুব সম্ভবত এ কারণেই তিনি বউ এর প্রতি অন্যায় হলে, বা নিজে নিপীড়ন করতে পারলে রোমাঞ্চ বা এর চে গভীর উপভোগের অনুভূতি আসে। এটি অনেকটা স্যাডিজমের ব্যাখ্যায় পড়ে। সেজন্যই গণহারে টিপ্পনি শোনা যায়, তুমিও একদিন শাশুড়ি হবে, তুমিও ছেলের মা। মানে হলো, আজ সইলে একদিন আমিও অত্যাচার করতে পারবো, আমিও ভীষণ তৃপ্তি নেবো অনাগত বউকে অত্যাচার করে। খড়্গটা আজ সিনিয়র শাশুড়ির কাছে, কাল আমার কাছে হবে।
তাই তো?
নারীর অনুভব বন্দী শুধু অন্য নারীর তুলনায় সুন্দরী ও সেরা হবার প্ররোচনায়। সেজন্যে নারী ঈর্ষা করবে নারী খেলোয়াড়, নারী বৈমানিক, নারী অভিনেত্রী, নারী গায়িকা এবং চকচকে ত্বকের সুন্দরী নায়িকাদের। নারীদের প্রধান বিনোদন অন্যদের হিংসা, ঘৃণা আর নিন্দা করে হবে। বিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয় বা কর্মক্ষেত্র নারীদের পরস্পর সম্পর্ক হবে ভীষণ মেকি, ফেব্রিকেটেড। যেন একেকজন ভিন্ন পৃথিবীর এলিয়েন। এবং নারীর উজ্জ্বল ভবিষ্যত হবে পুত্রবধূকে নির্যাতন এবং পুত্রবধুর কাছে সমুন্নত মর্যাদার সুখের মধ্যে।
এতোকিছুর পর যদি নারীর একটু ফেলো ফিলিং আসে স্বজাতির জন্য, একটু সহানুভূতি জেগে যায়, একটু পক্ষপাত আসে, একটু মায়া আসে, সেটাতে খুব একটা অনুমোদন থাকে না। নারীরা সংগঠিত হলে কার ক্ষতি?
আমি ব্যক্তিজীবনে মেয়েবন্ধুদের বেশি গুরুত্ব দিই, প্যাম্পার করি, যোগাযোগে এর ফলাফলটাও খুব ভালো। সে বন্ধুগুলোকে আমি একটা অর্জন ভাবি। আমি সেখানে আন্তরিক অভ্যর্থনা পাই যা আমি বন্ধুত্বে আশা করি।
নারীর ঈর্ষাকে কিছুপথ এড়িয়ে গেলে সেখানেই একটা নির্ভেজাল সহানুভূতিশীল মানুষ পাওয়া যায়, এটুকুই আমি বিশ্বাস করি। সেটা বউ শাশুড়ি সম্পর্কেও অনেকখানি প্রযোজ্য।
নিজের কথায় বলতে হয়, আমার চরিত্রেও ঈর্ষা আছে, সেটা কখনো খুব জেঁকেও বসে; চরিত্রের এই নেগেটিভ অংশটুকু যে কারো জন্য উস্কে ওঠে, তবে নারীর জন্য এই অনুভূতিকে আমি ঘেঁষতে দিই না।
নেতিবাচক অনুভূতি আসা খুব স্বাভাবিক। এটা নিয়ে একটু ভেবে নিলে একটু নিজের সাথে বোঝাপড়া করে নিলে এর প্রকোপ কমিয়ে আনা যায়।
নারী নারীর বন্ধু হোক। নারীর নিজের জগৎ হোক। বিপরীতে বন্ধুত্ব পরে আগে নিজের সাথে পরিচয় হোক।