সারা বুশরা দ্যুতি:
ফেসবুকের কল্যাণে কিছুদিন আগে অপরিচিত এক মেয়ের বিয়ের ভিডিওর একটি ছোট্ট অংশ চোখে পড়লো, সেখানে মেয়েটি নাচতে নাচতে বান্ধবীদের সাথে আসরে ঢুকছে। তাকে দেখে বোঝা যাচ্ছে সে নিজের বিয়ের অনুষ্ঠান ভীষণ এনজয় করছে এবং আসন্ন বিয়ে নিয়ে সে খুবই আনন্দিত।
দেখে ভাবলাম যাক, মেয়েরা আজকাল রাখঢাক ছাড়াই নিজের খুশি জাহির করতে পারছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখলাম পাবলিক যা তা কমেন্ট করছে। মেয়েটি কতোটা লির্লজ্জ ও বেহায়া সেটা নিয়ে গবেষণা হচ্ছে। খুব অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম সমালোচনা যারা করছে সবাই মেয়ে/নারী। পুরুষরা শুধু ‘মজা পেলাম, ইন্টারেস্টিং,ফানি’ এই টাইপ কমেন্ট করে ছেড়ে দিয়েছে। বদনাম বা তুলোধুনা যা করার সব নারীজাতি করে যাচ্ছে।
মেয়ে হয়ে আরেকটি মেয়ের ফ্রিডম আমরা যে সহ্য করতে পারি না, এই মনস্তত্ব আমি জানি। যা আমি পাইনি তা আরেকজন পাচ্ছে, যা আমি করতে পারিনি, তা আরেকটি মেয়ে করে দেখাচ্ছে, এই ব্যাপারটি মেয়েরা সহজে মেনে নিতে পারে না। সেখান থেকেই এই সমালোচনা বা বদনাম জিনিসটা আসে, নিজের অপ্রাপ্তির দুঃখটা আমরা অন্য আরেকটি মেয়ের নিন্দা করে ভুলতে চাই। ধর্ম, আইন ও সমাজ স্বীকৃত বিয়ের অনুষ্ঠান, সেখানেও নাচনেওয়ালি, প্রস্টিটিউট থেকে শুরু করে এমন কোনো গালি নেই যে ব্যবহৃত হয় না।
কিছুদিন আগে পোশাক নিয়ে একটি লেখা লিখেছিলাম। লেখাটার পিছনের মূল ভাবনা ছিল একটি প্রাপ্তবয়ষ্ক মেয়ে কী পোশাক পরবে সেটার সিদ্ধান্ত তার নিজের হওয়া উচিত। সে যদি হিজাবে কমফোর্টেবল হয়, তাহলে সেটা নিয়ে ব্যঙ্গ করার কোনো অধিকার কারো নেই, ঠিক তেমনি সে যদি পাশ্চাত্য পোশাক ভালোবাসে, তাহলে তাকে জোর করে সেটা ছাড়তে বাধ্য করার অধিকারও কারো নেই।
লেখাটি লেখার সময় থেকেই আমি জানতাম, পুরুষসমাজ নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দিবে এবং আমার কথাটি সঠিকভাবে অনুধাবন না করেই অযথা গালাগাল শুরু করবে। কিন্তু নারীরাও যে কোনো অংশে কম যান না, বরং আরও বেশি যান, সেটি ওই লেখাটি কয়েকটি গ্রুপে দেয়ার পর টের পেয়েছি। পুরোটা না বুঝেই (অথবা না পড়েই) সবাই ধরে নিলো যে আমি বাংলাদেশের মুসলিম মেয়েদের রাস্তায় বিকিনি পরে চলাফেরা করতে আহবান জানাচ্ছি। আমি মেয়েদের অশ্লীলতা অসভ্যতা করতে উৎসাহ দিচ্ছি, আমাকে খোদার কাছে জবাবদিহি করতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি।
কী আজিব ব্যাপার! আমি বুঝতে পারি না, কিছু মানুষের জ্ঞান কি সত্যি কম, নাকি সব জেনেই তারা ইচ্ছা করে চোখ বুঁজে থাকেন? পাশ্চাত্য পোশাক মানে যে শুধুই বিকিনি, এই তথ্য আমাদের সো কলড ধর্মপরায়ণ ভাইবোনদের কে দিয়েছে?
আমি একটি পাশ্চাত্য দেশের নাগরিক। এতো বছরে আমার তো চোখে পড়েনি এখানকার নারীরা/মেয়েরা রাস্তায় বিকিনি পরে চলাফেরা করছে! তারা যেসব পোশাক পরে, সেগুলো যথেষ্টই শালীন। অন্যদের ধর্মের জ্ঞান দিতে আর গালি দিতেই যাদের সময় পার হয়, তারা ভুলে যান মানুষের সমালোচনা করা, নোংরা কথা বলা, সত্য না জেনে এবং বুঝে একজনকে দোষী সাব্যস্ত করা এবং মিথ্যা অপবাদ দেয়া, এগুলো সবই ধর্মে নিষেধ করা আছে….অথচ এগুলো তারা নিষ্ঠার সাথে করে যাচ্ছেন। এরকম লোকেদের মুখে ধর্মের জ্ঞান কতটা হাস্যকর শোনায় তা যদি তারা বুঝতেন!
পুরুষতান্ত্রিক পুরুষ সমাজের বিরুদ্ধে হাজারও কথা আছে, হাজার প্রতিবাদ আছে ,সমঅধিকার আদায়ের যুদ্ধও আছে, অথচ নারীরা যখন নারীদের ছোট করে, একটি মেয়ে হয়ে আরেকটি মেয়েকে দাবিয়ে রাখতে চায়, সেই নারীরাও যখন পুরুষতান্ত্রিক, তখন সেটার বিপক্ষে জোর গলায় আওয়াজ তোলার বা সেটা বন্ধ করার জন্য শক্তিশালী পদক্ষেপ নিতে আজ পর্যন্ত কাউকে তেমন অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে দেখলাম না। আমাদের নিজেদের মধ্যে যে অন্ধকারগুলো আছে, সেগুলো কেন আমরা মুছে ফেলার প্রয়াস চালাই না?
যাই হোক, যেটা নিয়ে কথা শুরু করেছিলাম সেই বিয়ের প্রসঙ্গে ফিরে আসি, আমরা স্বীকার করি বা না করি, ৯০% মেয়ের মধ্যে নায়িকা হওয়ার সুপ্ত বাসনা থাকে। এই বাসনা পূরণ করার সুযোগ সে পায় তার বিয়ের অনুষ্ঠানের সময়। বিরাট বড় একটা সেলিব্রেশন শুধু তাকে ঘিরে আবর্তিত হয়। পুরো ঘটনাটির মধ্যমনি সে। লাইট, ক্যামেরাসহ আমন্ত্রিত শত শত লোকের দৃষ্টি শুধু তার উপর নিবদ্ধ। তাকে ঘিরে এবং তাকে নিয়ে এতোকিছু। এ ব্যাপারটি ভালো না লাগার বা এনজয় না করা মেয়ের সংখ্যা হাতে গুণে হয়তো বলা যাবে।
কোনো কোনো মেয়ের ক্ষেত্রে তার সারাজীবনের শখ, আহ্লাদ ও ইচ্ছেগুলো কিছুটা হলেও পূরণ করার এটিই প্রথম ও শেষ সুযোগ। কত রকমের স্বপ্ন থাকে বিয়ের সময়কার প্রতিটি ইভেন্ট নিয়ে মেয়েদের। আর সেটাই তো স্বাভাবিক। কোন মেয়েটা চাইবে না তার জীবনের এই স্পেশাল দিনটি তার মনের মতো করে সাজানো হোক, সে যেভাবে মুহূর্তগুলোকে স্মরণীয় করে রাখতে চায় সবকিছু সেরকম ভাবে হোক? এই চাওয়ার মধ্যে অন্যায় কোথায়? হ্যাঁ, চাওয়া এবং চাওয়াকে বাস্তবায়ন করার মধ্যে আরো অনেকগুলো ধাপ থাকে। সমস্যাটা এখানেই তৈরি হয়।
অনেক মেয়ে আছে যাদের মা-বাবার সামর্থ্য নেই সেটা জানার পরও অবুঝের মতো আচরণ করে… এটা অন্যায়। আমার পরিচিত একটি মেয়ে ছিল, যার বিয়েতে তার বাবা নিজের সাধ্যের বাইরে গিয়েও মেয়ের বিয়েতে অনেক খরচাপাতি করেছিলেন, যত রকমের গয়না লাগে মোটামুটি সব বানিয়ে দিয়েছিলেন। তাও মেয়েটি জিদ ধরে বসেছিল তার নোলক, ঝাপটা , সিঁথিপাটি এই সব অপ্রয়োজনীয় গহনাও চাই-ই চাই, এগুলা সব তাকে স্বর্ণ দিয়ে গড়িয়ে দিতে হবে।
এই ধরনের দাবি বিবেকহীনতা ছাড়া আমার কাছে আর কিছু বলে মনে হয় না। এসব ক্ষেত্রে দুটো উপায় আছে বলে আমার ধারণা। এক, নিজের শখগুলোকে বাস্তবতার সাথে মিলিয়ে কমিয়ে ফেলা। আর না হয়, নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে, নিজের উপার্জন করা অর্থ দিয়ে সেগুলো পূরণ করা। শখ থাকা ভুল না, কিন্তু সেটা করার জন্য নিজের মা-বাবাকে এরকম অত্যাচার করা অমানবিক। নিজের ইচ্ছেগুলো বিসর্জন দিতে না চাইলে, নিজের টাকা দিয়ে সেগুলো করাই কি ভালো না? একুল-ওকুল সবদিক রক্ষা হলো….নিজের মতোন সবকিছু করাও হলো, আবার পরিবারের লোকের ওপর প্রেসারও পড়লো না।
অনেকে বলেন, আজকাল বিয়ের অনুষ্ঠানগুলো শো অফ ছাড়া আর কিছুই নয়….অতিমাত্রায় শো অফ ঢুকে বিয়ের অনুষ্ঠানগুলোর মিষ্টতা নষ্ট হয়ে গেছে। তার উপর শুরু হয়েছে এক অদ্ভুত প্রতিযোগিতা। অমুকে এটা করেছে, তাই আমাকেও করতে হবে। অমুকের থেকে বেশি করে তাকে দেখিয়ে দিতে হবে যে আমিও কম না ইত্যাদি ইত্যাদি।
এটা স্ট্যাটাসের লড়াই না হিংসে, সে বিষয়ে তর্ক হতে পারে। তাই সেদিকে যাবো না।
শুধু এটুকু বলতে চাই, আজকাল যখন এই বিয়ের অনুষ্ঠানগুলোর বিপক্ষে অনেক কিছু বলা ও লেখা হয়, তখন সেখান থেকে সবচেয়ে বড় যে পয়েন্ট সেটিই বাদ পড়ে যায়…. হ্যাঁ, পয়েন্টটি হলো, একটি অবিবাহিত মেয়ের আজীবনের স্বপ্ন ও আকাঙ্খা। এই জিনিসটাকে এতোটা তুচ্ছ করে দেখারও কারণ নেই। মেয়েটির পরিবার যদি তার শখ পূরণ করতে অর্থনৈতিকভাবে সক্ষম হয় এবং নিজেদের খুশিতে সেটা করতে চায়, তাহলে আমাদের তো সেটা নিয়ে সমালোচনা করার কিছু নেই। আমার যদি ভালো না লাগে, তাহলে আমি আমার বিয়েতে বা আমার সন্তানের বিয়েতে সেটা না করলাম! তাহলেই তো হলো… কিন্তু যারা করছে তাদেরকে নিয়ে কেন নেতিবাচক কথা বলবো?
এটা ঠিক যে সবার সবকিছু ভালো লাগে না, বা সবাই পরিবর্তনের সাথে সহজে খাপ খাওয়াতে পারে না। এক্ষেত্রে তাদের উচিত ব্যাপারটি এড়িয়ে যাওয়া এবং চুপ করে থাকা। যার যার সুখ তার তার নিজস্ব ব্যাপার। অন্যের ত্রুটি না খুঁজে আমরা নিজেদের ভুলগুলো আগে শুধরানোর চেষ্টা করি বরং।
মনের জানালাটা খুলে সেখানে কিছু ঝকঝকে পরিষ্কার আলো ঢুকতে দেই। নিজেরা ভালো থাকি, অন্যদেরও ভালো রাখি।
সারা বুশরা দ্যুতি
বেডফোর্ড, যুক্তরাজ্য