ফারহিম ভীনা:
সেবার মহা আয়োজন করে হাবিবপুর গ্রামে চড়ক মেলা বসেছে। ত্রৈলোক্যনাথ বাবু জমিদার বাড়ি নন, ছুটছেন মেলার দিকে। কাঁধে তার তিন বছরের ক্ষুদি। এইটুকুন ছেলে এতো দস্যি যে কোথায় দৌড়ে চলে যাবে ঠিক নেই-বরং কাঁধে চড়ে যাক মেলায়। কাঁধে চড়ে ক্ষুদির আনন্দ আর ধরে না। বাবার কাঁধে চড়লে পৃথিবী কত বড় হয়ে ওঠে। চারপাশে কত কিছু দেখা যায়। ছেলেপুলেরা সব হৈ হৈ করতে করতে মেলায় ছুটছে।
মেলায় রং চঙে চৌকো এক বাক্স নিয়ে বসেছে এক যাদুকর। রং বেরঙ্গের একটি টুপি পরে সে খোকা বুড়ো সকলের সামনে আশ্চর্য জগৎ তুলে ধরছে। ঐ বাক্সে চোখ রাখলে এক পলকে কত রাজ্যের জিনিষ যে দেখা যায়। কখনো মস্ত জমিদার বাড়ি পর মুহূর্তে তারচেয়েও খাসা বিশাল রাজপ্রাসাদ-দেখা যায় সৈন্য সামন্ত। কখন যেন রূপকথার রাজকন্যা এসে ক্ষুদে দর্শকদের সম্মোহিত করে ফেলে। ত্রৈলোক্যনাথ ছেলে ক্ষুদিকে নিয়ে চৌকো বাক্সে চোখ রাখেন। ক্ষুদি দেখছে আর যাদুকর বলে যাচ্ছে অপূর্ব সব বর্ণনা। ‘দেখো দেখো কী আশ্চর্য দুনিয়া দেখো। রাজা দেখো। রানী দেখো। দিল্লী-আগ্রার রংমহল দেখো। দুনিয়াদারির তামাশা দেখো।’ সত্যি এক পয়সা দিয়ে জগতের অত্যাশ্চর্য সব জিনিষ দেখে নিল ক্ষুদি।
মেলায় বসেছে শোলার পাখি, মাটির পুতুল, কাগজের কুমির আর হাঁড়ি পাতিলের পসরা। বাবা এরমধ্যে ক্ষুদিকে একটি মাটির ঘোড়া কিনে দিয়েছেন। আস্ত মাটির ঘোড়াটি বুকের কাছে চেপে নেচে নেচে দৌড়ে চলেছে ক্ষুদি। ওর ফাঁকে কে একজন ডুগডুগি বাজিয়ে সর্বরোগহরণকারী মহৌষধ বিক্রি করছে। ‘পায়ে ব্যথা, মাথা ব্যথা এমনকি অম্বল সব রোগের এক চিকিৎসা!’ ত্রৈলোক্যনাথ আর সেদিকে পা বাড়ালো না-ক্ষুদির আর সে মজা দেখা হয় না। এক পয়সায় ঠোঙ্গা বোঝাই বাতাসা আর মাটির ঘোড়া নিয়ে সে বাসায় ফিরে এলো এক আশ্চর্য দুনিয়ার স্বাদ নিয়ে।
ক্ষুদিরাম বড় হচ্ছে দামাল ছেলে খ্যাতি নিয়ে। দস্যিপনায় সে চারপাশের সব বালককে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। বর্ষা বাদল কোন কিছুই তার দুরন্তপনাকে থামিয়ে দিতে পারে না। কোন কোনদিন আকাশ মেঘ করে বর্ষা নামলে পূর্ব থেকে পশ্চিমে হাওয়া বয়ে যায় কেমন শোঁ শোঁ। পুকুরটা তখন জলে টইটুম্বুর হয়ে ওঠে। বাঁশবাগানের বাঁশগুলি সেসময় শন -শন করে জেগে ওঠে। আম-কাঁঠালের ঝরা পাতা নাচতে নাচতে উড়ে যায় আর ক্ষুদিদের হাঁসগুলি কাঁপতে কাঁপতে উঠানে এসে ঠাঁই নেয়। ক্ষুদির মা লক্ষ্মীপ্রিয়া খুব খুশি। বর্ষার কারণে একটু হলেও ছেলেকে কাছে পান। ক’দিন খুব বরষা গেল। বিরামহীন সে বৃষ্টি। রিম-ঝিম বৃষ্টি। শন -শন বৃষ্টি এবং শো শো বৃষ্টি। বৃষ্টির দিনে হাবিবপুর গ্রামের সবাই বন্দি। লক্ষ্মীপ্রিয়া বুঝতেই পারলেন না কখন তার ছেলেটি বৃষ্টি-বাদলা আর মেঘের সকল হুংকার ও আষ্ফালন তুচ্ছ করে বাগানে ছুটে গেছে। পাঁচ বছরের এই ছেলের এতোটুকু ভয়-ডর নেই।
বৃষ্টি ঝমঝমিয়ে নামলে মা শাসন করেন আঙ্গুঁল উঁচিয়ে, ‘আজ একদম বাড়ির বাইরে পা দেবে না। কেমন ঝড় বাদল নেমেছে দেখছো তো।’ মেঘের হুংকার ধ্বনি শোনা গেলে বালক ক্ষুদি বলে ওঠে,
‘দেখো মা, দেবতারা কেমন ঝগড়া করছে।‘ মায়ের হাতের বাঁধন পেরিয়ে সে কোন সময়ে ঠিকই দৌড়ে যায় বাগানে। এতো বরষায় কোন ব্যঙের সর্দি হলো কিনা, বাগানে আম পড়েছে কতটা, সবটাতেই তার প্রবল আগ্রহ। মা আর পারেন না- এমনিতে কেমন তার শরীরটা দুর্বল থেকে দুর্বলতর হচ্ছে-তার ওপর ছেলের নিত্য-নতুন দস্যিপনা। বড় ভয় করে তার ছেলে নিয়ে। মা ঠাকুরণের উদ্দেশ্যে একটা পেন্নাম ঠুকে বলেন,
‘দুর্গা। দুর্গা। মা তুমি আমার ছেলেকে একটু সামাল দাও। তাকে তুমি দুধে-ভাতে রেখো। তাকে তুমি হাজার বছরের পরমায়ু দিও।’
জগৎ দেখার আনন্দে-প্রকৃতিকে আবিস্কার করার উদ্দীপনায় ক্ষুদির দিন কেটে যাচ্ছে। এরকম এক ঝড় জলের বিকেলে বাড়ির কোথাও ক্ষুদিকে পাওয়া গেল না। লক্ষ্মীপ্রিয়া দেবী কিঞ্চিত তপ্ত মেজাজে বাগানে গেলেন। দেখা গেল ক্ষুদির নেতৃত্বে গ্রামে ছেলের দল এগিয়ে চলেছে। ক্ষুদির হাতে একটা ডাল ধরা -তাতে একটা মৃত ঢোঁড়া সাপ ঝুলে আছে। পেছনে যে জনা দশেক ছেলে হৈ হৈ করছে তারা নয় থেকে বারো বছরের বালক। ক্ষুদে নেতা ক্ষুদিরাম বীর বিক্রমে মরা সাপ নিয়ে হেঁটে চলেছে-যেন ভারি এক যুদ্ধ জয় করেছেন তিনি।
আঁতকে ওঠেন লক্ষ্মীপ্রিয়া দেবী। তিনি গলা উঁচিয়ে বলেন,
কী ডাকাত ছেলে তুই ক্ষুদি! এই বয়সে সাপ মেরেছিস?’
ক্ষুদি হেসে জবাব দিল, ‘মা আমি একদিন রাক্ষস মারবো।’
মা ছ’বছরের ছেলের মুখে হাত চাপা দিয়ে বলেন,
বালাই ষাট। এ যুগে আবার রাক্ষস কোথায়?
ছেলে মায়ের হাত সরিয়ে হাসতে হাসতে বলে,
‘মা তুমি ভয় পেয়েছ?’ যেন রাক্ষস বধ করার চেয়ে মজার কোন খেলা এ বালকটির জানা নেই। অসীম সাহসী এই একরত্তি ছেলেটির দিকে মা দুরু দুরু বুক নিয়ে অপলক তাকান। বাইরে ঝড় বৃষ্টি কমে এলেও মায়ের বুকে তখন চলছে কালবৈশাখীর তুফান।
লেখাপড়ায় ক্ষুদিরামের মন দেখা গেল না। পাঠশালায় ভর্তি হয়েছে সে- তবে পড়ার কোন আগ্রহ দেখা গেল না। বারান্দায় ক্ষুদি কেবল কোন্ গাছে প্যাঁচার আস্তানা তাই খোঁজার চেষ্টা করছিল। এসময় মা এসে হাজির। তিনি ক্ষুদিকে একটু রাগ করেই বললেন
‘খুব দস্যিপনা হচ্ছে প্রতিদিন।’
ক্ষুদি সাথে সাথে হাতের ডালাটা দিয়ে মাটিতে একটি অক্ষর এঁকে বলে যায়-
‘এই দ্যাখো মা অ, আ, ই। লেখাপড়া তো করছি।’ মা তাতেও খুশি হোন না, বরং বলে যাচ্ছেন-
‘এই- এতোসব ডাল মাটিতে সার বেধে দাঁড় করিয়েছিস কেনরে?’ ক্ষুদি এইবার লজ্জিত হয়ে বলে-মা ও তুমি বুঝবে না।’
‘বুঝবো না মানে?’ মাও ক্ষান্ত দেবার পাত্রী নন। এতোটুকু ছেলে কিনা বলছে তার খেলা বুঝতে পারবে না লক্ষ্মীপ্রিয়া দেবী।
ক্ষুদি বাধ্য হয়ে বলে-
‘ মা এখানে যুদ্ধ হচ্ছে। এরা সব সৈন্য-যুদ্ধ করছে। আর বড় যে আমডাল সে হলো সেনাপতি।’ মা বকে যান,
‘এহ্ ছেলের পড়ায় মন নেই। একে নিয়ে আমি কী করি? আজ বাবা আসুক।’
তবে তিনি এ ছেলের উপর রাগ করতে পারেন না। ক্ষুদি মাকে জাড়িয়ে ধরে বলে-
‘মা রাত্তিতে তুমি কিন্তু গল্প শোনাবে। তার পরই মাথা সরিয়ে বলে- মা তোমার জ্বর। অসুখ করেছে?’
নিত্য দিন লক্ষ্মীপ্রিয়ার জ্বর হচ্ছে আর শরীর দুর্বল হচ্ছে। তিনি ছেলের উৎকন্ঠা দূর করার জন্য বললেন,
‘একটু নিমপাতা নেই। নিমপাতা জ্বরে ভাল কাজ করবে। দুদিনেই এ জ্বর ভালো হয়ে যাবে।’
ততক্ষণে সন্ধ্যে ঘন হয়ে এলে মা তুলসীতলায় প্রদীপ জ্বালিয়ে ক্ষুদিকে নিয়ে বসেন আর বলেন, ‘আগে একটু গীতা শোনাই, তারপরে গল্প বলবো। কেমন?’ তিনি পড়ে যান গীতা-‘আত্মার জন্ম নাই, মৃত্যু নাই, ক্ষয় নাই। আত্মাকে আগুনে পোড়ানো যায় না, জলে ভেজানো যায় না- অস্ত্র দিয়া কাটা যায় না, বাতাসে উড়ানো যায় না। আত্মা অবিনাশী ও সর্বব্যাপী।’ ‘অবিনাশী-তু তদবিদ্ধি যেন সর্বমদংততম।’
ক্ষুদি মুগ্ধ হয়ে শোনে-কতকটা সে বোঝে। বেশির ভাগই তার অজানা-না বোঝা। তবু ভালো লাগে-কেমন বুকের ভেতরটা স্পর্শ করে-‘মানুষ মরিলে বা মানুষকে হত্যা করিলে তাহার শরীর নষ্ট হয়, আত্মা নষ্ট হয় না। আত্মা অন্য দেহ গ্রহণ করে। মানুষ যেমন ছেঁড়া কাপড় পরিত্যাগ করে, আত্মাও তেমনি নতুন দেহ গ্রহণ করে। ইহাই জন্মান্তর। ইহাই পুনর্জন্ম।’
ছোট ক্ষুদি তন্ময় হয়ে শুনতে শুনতে কখন যেন ঘুমের রাজ্যে ডুবে যায়। তার কানে কেবলি ভেসে আসে-আত্মা অবিনাশী ও সর্বব্যাপী। অবিনাশী-তু তদবিদ্ধি যেন সর্বমিদংততম।’ কালো পেড়ে শাড়ির আঁচলে ঘেরা মায়ের কাজল টানা মুখটা ক্রমে ঝাপসা হয়ে আসে।
মা কোন কোনদিন শোনান মহাভারত, রানাপ্রতাপ, শিবাজী আর প্রতাপাদিত্যের বীরত্বের কাহিনি। মায়ের গল্পে এক সোনার দেশের ছবি ভেসে উঠে ছেলের সামনে যেখানে মানুষগুলো স্বাধীন ও সাহসী। রাজার গল্পের চেয়ে এ ভারী মজা -কত কিছু কল্পনা করা যায়। বিন্দুর মত ছেলেটি মায়ের কোলে বসে সেই সোনার দেশে চলে যায়।
লক্ষ্মীপ্রিয়া দেবীর জ্বর ভালো হলো না। যতরকম জানা অজানা টোটকা ঔষধ আছে-সবই তিনি চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিয়েছেন। কন্যা অপরুপার জামাই বাড়ি আসবেন। অসুস্থ শরীরে তিনি যৎসামান্য রান্নার আয়োজন করতে বসলেন। কলাগুলো সব নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বাগানে একসাথে প্রায় সব কলা পেকেছে। চারপাশে পড়শীদের মধ্যে বিলিয়েও তা শেষ হচ্ছে না। তিনি গতরাতে স্বামীকে বললেন, তুমি তো সন্ধ্যার আঁধারে পাশের গ্রামের হাটে ক’কাদি কলা বিক্রি করতে পারো। স্বামীর চেহারা দেখে কথা ঘোরান-‘আহা আমি ঠিক বিক্রির কথা বলিনি। হাটে গিয়ে কলার কাদির বদলে যদি দুটো গামছা, ক্ষুদির একটা চপ্পল আর তেল-নুন পাওয়া যেতো, তাহলে ভালই হতো।’ স্বামীর রাগী চোখ দেখে সংসারে আর কী কী দরকারি জিনিষের হিসাব করেছিলেন তা বেমালুম ভুলে গেলেন।
মায়ের রান্নার কাজে অপরুপা এগিয়ে আসে। মা কলা দিয়ে পিঠে বানাবেন জলখাবারের জন্য। মেয়ে পাকা কলা চটকে তাতে চিনি আর চালের গুড়ি মেশায়। মা স্বাদের জন্য কটা পুরনো নারকেলের নাড়ু ভেঙে দিলেন। ক্ষুদিরামকে দেখে দু হাতে কাছে টেনে বললেন, ‘সারাদিন বাগান দাবড়ে বেড়াস- সাঁতরে পুকুর এ পার-ওপার করিস-কেবল মায়ের কাছে আসার সময় নেই। তিনি ছেলেকে কাছে নিয়ে আগুন গরম পিঠা খাওয়ালেন। শরীর যেমন খারাপ হচ্ছে আর কতদিন কাছে নিয়ে খাওয়াতে পারবেন ভগবান জানেন। পিঠে ভাজতে ভাজতে মায়ের অসুস্থতা আর ভাইটির দস্যিপনার জন্য অপরুপার চোখ সজল হয়ে উঠলো। বিয়ের পরও দীর্ঘকাল সে বাবার বাড়িতে আছে -মা আর ছোট ভাইটির উপর তার যেন অধিকার বেশি। চোখের জল সত্যিই মানছে না। চুলায় আগুন দেওয়ার ছলে সে কান্না লুকালো। কিন্তু ঠিক তার দুদিনের মাথায় মায়ের মৃত্যু এসে হাজির হলে সে কেঁদে বুক ভাসালো। ক্ষুদিরাম এ মৃত্যু সহ্য করতে পারলো না। শোকের বাড়ি ফেলে ছয় বছরের খুদিরাম পুকুর পাড়ে দৌড়ে গেল।
পৃথিবী যেন এক বিস্ময়ের রাজ্য। কোন কোন মানুয়ের জীবন জন্ম থেকেই সংগ্রাম। দুঃখেই তাদের জীবন গড়া। মায়ের মৃত্যুর পর ক্ষুদিরাম আরো ছন্নছাড়া হয়ে উঠল এইটুকুন বয়সে। বাবা ত্রৈলোক্যনাথ দ্বিতীয় বিবাহ করে ছেলের জন্য মা নিয়ে এলেন। বিমাতার সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে না করতেই ছ’মাসের মাথায় ক্ষুদি হারাল তার বাবাকে। ক্ষুদি এইবারে প্রকৃতই অনাথ হয়ে পড়ল। জীবন থেমে থাকে না। ক্ষদিরামের দুরসম্পর্কের পিসতুতো দাদা রাজি হল তার দায়িত্ব নেওয়ার। কিন্তু সে অন্য গপ্প। অন্য জীবন। অন্যরকম তার বেদনা।
(চলবে)